৪র্থ পর্ব

জানুয়ারি মাসের শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে বাগবাজারের গাছগাছালিময় এঁদো গলিতে। শুধু নিবেদিতা কেন সকল বিদেশিদের পক্ষে বেশ আরামদায়ক সময় এটা। দুপুরে মনোরম রোদ। আজ ২৮ জানুয়ারি সোমবার। আজকে নিজের ঘরটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন। স্কুলের এক ছাত্রীর মা তৈরি করে দিয়েছে বেশ বড় একটি আসন। আসনের মাঝে সুতোয় কাজ করা এক মস্ত বড় ফোটা পদ্ম। উজ্জ্বল। সেটিকে তক্তপোশের চাদরের ঠিক মাঝখানে রেখেছেন। টেবিলের উপর মাটির সরায় রেখেছেন গাঁদা ফুল। টেবিলের ঢাকা পাল্টেছেন। ক্রচেট কাজ করা সুতোর টেবিল কভার রেখেছেন। এটাও নিবেদিতা পেয়েছেন এলাকার কোনও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের থেকেই। যোগানন্দ, যোগিনের মা আর ঝি সারা সকাল চেষ্টা করে গেছে বারান্দার উপরের খাঁজে খাঁজে বসত করা পায়রাদের তাড়াতে। কারণ, বারান্দায় অতিথিরা বসলে নিশ্চিতভাবেই তাঁদের দামি পোশাক নষ্ট করে অপদস্থ করবে এই পায়রারা। প্রথম-প্রথম নিবেদিতা অসম্ভব বিরক্ত হতেন। এখন সয়ে গেছেন। সকাল থেকে কিন্তু বহুঘণ্টা ব্যয় করে একটি পায়রাকেও তাড়াতে পারেনি ওরা। সাময়িক স্বস্তি দিয়ে উড়ে বাইরে চলে গেল আকাশে, পাশের বাড়ির ছাদে, কার্নিশে। যাক পায়রাদের বকবকানি আর নোংরা করা থেকে বাঁচানো গেছে, এই ভেবে যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছে যোগানন্দ, তখনই বকমবকম করে গায়ে-মাথায় তপ্ তপ্ বিষ্ঠা ফেলে ওরা জানান দিল যে তারা ফিরে এসেছে স্বমহিমায়! নিরুপায় হয়ে ঠিক হয়েছে খোলা উঠোনেই বসবে আজ বিকেলের চায়ের আসর। কলকাতার স্বনামধন্য অতিথিরা আসবেন আজ নিবেদিতার ছোট্ট দোতলা বাড়িতে। নিবেদিতা অসম্ভব উত্তেজিত বোধ করছেন। আবেগাপ্লুত নিবেদিতা। লিখেছেন, “I feel excited at being a hostess once more – with such a very big lion on show.” ( Letters 1899, Page-31) বাংলার দুই সিংহ মুখোমুখি হবেন আজ।

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ। উভয়ের বয়সের ফারাক মাত্র দু’বছর কয়েক মাস। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা দু’জন। দূরত্ব কমবেশি এক মাইলেরও কম। কিন্তু পারস্পরিক দূরত্ব যোজন যোজন। হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে দুই ভিন্ন পথের দুই পথিক। নিরাকার ও সাকার-এর দ্বন্দ্বে দীর্ণ বাংলা তখন। ব্রহ্ম ও ব্রাহ্ম। একদিকে আদুল-গা, অপরিমার্জিত ভাষা, মেঠো, ঘেমো, মূর্তি পূজার্চনা, ভাবান্দোলনে উত্তাল সাধারণ মানুষ। আর অপর দিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ হিন্দু ধর্মের আচার-আচরণ, নিদান, বিধি, কু-সংস্কার এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ব্রাহ্ম সমাজ তৈরি করার মধ্য দিয়ে সংস্কার করতে চাইছে হিন্দু ধর্মের ছুৎমার্গ বিষয়গুলো। দক্ষিণেশ্বর আর জোড়াসাঁকো। আরও পরিষ্কার করে বলা যায় বেলুড় ও জোড়াসাঁকো। মাঝে উত্তাল বহমান গঙ্গা নদী। নিবেদিতা কি সাঁকো হিসেবে কাজ করছেন! তৈরি করছেন ‘in roads’, অনুপ্রবেশের পথ!

বাইরে ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ। তাহলে কি? নিবেদিতা দোতলার ঘর থেকে দ্রুত নেমে আসেন। ততক্ষণে যোগানন্দ দরজা খুলে দিয়েছে। নীল বেনারসি শাড়ির জমি ঢেকে আছে সোনালি বুটি। মনে হচ্ছে এক আকাশ তারা নিয়ে প্রবেশ করছেন সরলা ঘোষাল। রুচিসম্মত সাজে তিনি সিদ্ধহস্ত। অসামান্যা সুন্দরী। মনীষা তার চলনে বলনে ফুটে ওঠে। সুন্দর গয়না পরেছেন। উজ্জ্বলতর তিনি। সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবী। বিদূষী। সাহিত্যিক হিসেবে নাম করেছেন খুব। তাঁর লেখার কদর বাড়ছে বিদ্বজ্জনেদের কাছে। সাদা সিল্কের শাড়ি। জরির পার। জরির ফুল তোলা নক্সা শাড়ির জমিতে। নিবেদিতা এগিয়ে গেলেন। নমস্কার প্রতি-নমস্কার ইত্যাদি শেষ হবার পর নিবেদিতা তাঁদের নিয়ে এসে বসালেন উঠোনে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশ করলেন ড. প্রসন্নকুমার রায় ও তাঁর স্ত্রী সরলা দেবী। নিবেদিতা খুব উত্তেজিত। তাড়াতাড়ি তাঁদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন। প্রিয় মানুষটি এলেন খুব সুন্দর পোশাকে। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু। প্রিয় ‘বেয়ার্ন’ ও ‘বো’। এলেন মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। সবাই এসে একবার করে খোঁজ করছেন রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দকে। বাইরে গাড়ির আওয়াজ। নিবেদিতা বলে উঠলেন, ওই তো তিনি বোধহয় এসে পড়েছেন। সবাই প্রায় দরজার কাছে এসে উপস্থিত তিনি গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই। উজ্জ্বল হলুদ সিল্কের জোব্বা, তার উপরে কালোর উপর নানা রঙের সিল্কের সুতোর কারুকাজ করা কাশ্মীরি আলোয়ান লম্বা হয়ে দু’কাঁধ ছুঁয়ে নেমে এসেছে হাঁটুর নীচে অবধি। মাথায় শীতের টুপিতেও সিল্কের সুতোর কাজ। কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়েছে ঝরনার মতো চুলের ঢাল। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন তাঁর রুচি ও আভিজাত্যের দিকে। হেসে নমস্কার করলেন। সবাইকে প্রীতি জানিয়ে প্রবেশ করলেন ধীরে ধীরে। শশব্যস্ত সবাই। মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সরাসরি ঢুকে পড়লেন বিবেকানন্দ একদম ভেতরে। নিবেদিতা দ্রুত এলেন। এগিয়ে দিলেন চেয়ার। প্রীতি-বিনিময় হল সবার সঙ্গে। নিবেদিতা কিঞ্চিৎ উত্তেজনায় ভুলে গেছিলেন চায়ের জন্য দুধের ব্যবস্থা করতে। ড. প্রসন্নকুমারের বউ সরলা দেবী দ্রুত পাশের এক চেনা বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে এলেন। কাপ-প্লেটের ব্যবস্থা করলেন। সবাইকে চা দেওয়া হল। শীতের বিকেল ক্ষণস্থায়ী। আলো কমে এল দ্রুত। খুব মশা উঠোনে। সবাই গিয়ে বসলেন উপরে নিবেদিতার ঘরে। জানালা দিয়ে হালকা গোধূলির রক্তিম আলো পড়েছে রবীন্দ্রনাথের হলুদ সিল্কের জোব্বায়। সেই আলো ছড়িয়েছে বিবেকানন্দের গেরুয়া পোশাকে।
রবীন্দ্রনাথ ধীরে অতি ধীরে গান ধরলেন সবার অনুরোধে।
‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে
শূন্য ঘাটে একা আমি পার
করে নাও তোমার নেয়ে…’


সবাই তন্ময় চুপ। মাথা নিচু করে নিবেদিতা বিছানার এক কোণে সরলা দেবীর পাশে বসে আছেন। জানালা দিয়ে গোধূলির রক্তাভ হলুদ নরম আলোয় ভাসছে ছোট্ট ঘরখানি। ভাসছে সুরেও। কবির আকুল কণ্ঠে মিশ্র পূরবীর চলনে চলনে সন্ধ্যা নেমে এল। নিবেদিতা ধীরে ধীরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলেন। ছায়া দীর্ঘতর হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। দেওয়ালে দীর্ঘ হল বিবেকানন্দের ছায়াও। রবীন্দ্রনাথ অতি যত্নে শেষ করলেন —
‘এসো এসো শ্রান্তিহরা
এসো এসো শান্তি-সুপ্তি-ভরা
এসো এসো তুমি এসো
এসো তোমার তরী বেয়ে।’
চোখ খুললেন রবীন্দ্রনাথ।

তিনটি গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেদিন। কোন তিনটি গান গেয়েছিলেন সে নিয়ে বিতর্ক আছে। থাক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান সেদিন পূর্ণ করেছিল অনেক শূন্যতা। শব্দহীনতার শূন্যতা! অবাক বসে থাকার চেয়ে সবাক গানে গানে সময় বয়ে যাবার পথ তৈরি করলেন সহজেই। নিবেদিতা চেষ্টার ত্রুটি করেননি এক অসামান্য সন্ধ্যা অতিথিদের কাছে উপহার দিতে। পেরেছিলেন নিবেদিতা। কিন্তু…।

মাঝের একদিন কেটে গেল নানা কাজে। ঠিক তার একদিন পরে ৩০ জানুয়ারি ১৬ নং বোসপাড় লেন থেকে নিবেদিতা লিখলেন তাঁর প্রিয় য়ুমকে — “It was quite a brilliant little gathering, for Mr. Tagore sang 3 of his own compositions in a lovely tenor – and Swami was lovely. Only there was some cloud – I could not tell what.” ( Letters -1899 page – 43)। রবীন্দ্রনাথ কোন তিনটি গান গেয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ‘there was some cloud’ এই কথাটি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। মেঘ ছিল। এই চায়ের আসরে যতই শীতের অস্তমিত সূর্যের আলো থাকুক প্রকৃতিতে, নিবেদিতার ঘর রোদে উদ্ভাসিত হলেও, কোথাও কোথাও মেঘ ছিল। ‘there was some cloud’ এই শব্দবন্ধে নিবেদিতা বোঝাতে চেয়েছেন অনেক কিছু তাঁর প্রিয় ‘য়ুম’কে। কিন্তু মেঘের পর মেঘ জমে ওঠার কারণ তিনি বলতে পারবেন না। পারেননি। কিন্তু উপলব্ধির কোনও এক স্তর থেকে উচ্চারিত হয়েছিল ঘনীভূত মেঘের কথা।


নিবেদিতা খুব সহজ ও সরলভাবে ভেবেছিলেন যে স্বামীজির সঙ্গে তাঁর ব্রাহ্ম বন্ধুদের একসঙ্গে বসালেই সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয়েই কাছাকাছি আসতে পারবেন। নিবেদিতার পক্ষে সাঁকো নির্মাণ সহজ হবে। নিবেদিতার কাছে একটিই প্রশ্ন — শ্রীরামকৃষ্ণের সন্তানেরা যে-অদ্বয়তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, ব্রাহ্মসমাজের বন্ধুরা কি তা-ই করেন না? তাঁরাও তো হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে চান। ভেঙে ফেলতে চান নানা রকম বিধান ও নিদানের বাধা। নিবেদিতা ভাবেন, ‘এ পর্যন্ত এমন কিছু তো চোখে পড়ল না, যাকে নিছক জড়োপসনার কোঠায় ফেলতে পারি। অথচ ব্রাহ্ম-সমাজের বন্ধুরা বলেন, ভারতবর্ষ নাকি পৌত্তলিক!’

নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন স্বামীজির দিকে।
স্বামীজি বলেন, ‘একটা জাতিকে বুঝতে হলে তার সব-কিছু গ্রহণ করতে হবে। ভারতবর্ষ পৌত্তলিক? সে যা তা-ই থাক, আমাদের কাজ শুধু তাকে সাহায্য করা।’

প্রোটেস্ট্যান্ট ঘরের নিবেদিতা ধর্মের বাইরের আড়ম্বর বর্জন করার পাঠ নিয়ে বড় হয়েছেন। যুক্তিবাদী তিনি। তিনি এক সংঘর্ষের আবর্তে জড়িয়ে পড়ছেন। একা ছাদে সন্ধ্যায় বসে থাকেন নিবেদিতা। নির্ঘুম রাত কাটে জানালা দিয়ে জোনাকির আলপনা দেখে দেখে। সহস্র শিয়ালের সমস্বর শুনতে পান দূরে-কাছে। অন্ধকার গভীর হয়। চোখের পাতায় ভারী হয়ে নেমে আসে ঘুম। এক আশ্চর্য সকালের অপেক্ষা করেন। তাঁর গুরু, তাঁর স্বামী যা চাইছেন। জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান সাধনায় সাহায্য করার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে আছে। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে বসে বিভিন্ন ধর্ম সমন্বয় নিয়ে আলোচনা, উপনিষদ ও বেদের ব্যাখ্যা, এবং অবিশ্রান্ত গানের ধারায় স্নানের নির্মল আনন্দ হয়। ভীষণ ভীষণ ভাবে খুব ভেতরে মোমবাতির আলোর মতো কী যেন গলে গলে পড়ে। অসম্ভব সুন্দর মনের মানুষদের থেকে দূরে থাকতে পারেন না নিবেদিতা। সেই সব শিক্ষিত অভিজাত মহিলাদের সান্নিধ্যে আলোচনায় উঠে আসে স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ও প্রচারের আধুনিক পথ। নিবেদিতা তাকিয়ে থাকেন অন্ধকার রাতের দিকে। সামনে খোলা লেখার প্যাড, কালির দোয়াত, ফেল্টের কলম, ব্লটিং পেপার ইত্যাদি ইত্যাদি। কলমটা তুলে নিলেন। ভাবছেন গত সোমবার আলবার্ট হলে তাঁর কালী নিয়ে বক্তৃতার কথা য়ুমকে তো বলতে হবে। শুরু করলেন — “Well- my lecture on Kali came off on Monday. The Albert Hall crammed.”

আলবার্ট হলে তিলধারণের জায়গা নেই। সমস্ত কলকাতার মানুষ যেন ভেঙে পড়েছে। বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষ। নিবেদিতার কালী বিষয়ে বক্তৃতা সেই সময় কলকাতার জনসমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। মার্গারেট নোবেল একজন বিদেশিনী হয়েও হিন্দু হয়েছেন, তার উপর তিনি কালীপুজো নিয়ে বলবেন! কী এমন বলবেন এই মাটিতে দাঁড়িয়ে যেখানে কালীপুজোর উৎস! একজন বিদেশিনী কী ব্যাখ্যা দেবেন! কৌতূহল দিকে দিকে। বিবেকানন্দের বিদেশিনী শিষ্যার হিন্দুত্ব গ্রহণ এবং কালীপুজো নিয়ে বক্তৃতা নিয়ে বিতর্ক বিবাদও কম হয়নি। ড. যদুনাথ সরকার ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসের ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এ লিখেছিলেন, “আপনারা আজ অনুমানও করতে পারবেন না কলকাতার শিক্ষিত সম্প্রদায় নিবেদিতার বক্তৃতার বিষয় শুনে কী রকম আঁতকে উঠেছিল!”
এই বক্তৃতা সভার শিক্ষিত সর্বজনগ্রাহ্য একজন সভাপতি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। স্বনামধন্য অনেকেই এড়িয়ে গেছেন এই বিষয়টিতে। সভাপতি পাওয়াই মুশকিল হয়ে উঠেছিল। বিদ্যাসাগর কলেজের প্রিন্সিপাল এন.এন. ঘোষ প্রথমে রাজি হয়েও পরে পিছিয়ে গেলেন। নিবেদিতা ঠিক করেছিলেন সভাপতি ছাড়াই সভা করবেন। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নন এমন কাউকে সভাপতি করা হয়েছিল। নিবেদিতা খুব খুশি ছিলেন না এইরকম সভাপতি নিয়ে। তাই কালী বিষয়ক পরের বক্তৃতায় তিনি সভাপতি হিসেবে কাউকে রাখেননি। কলকাতা উৎসুক। কিন্তু খবরের কাগজ তথা সংবাদমাধ্যম দ্বিধাবিভক্ত। একমাত্র ‘ইন্ডিয়া মিরর’ ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিজ্ঞাপিত করে — “Miss Margaret E. Noble (Sister Nibedita) will deliver a lecture at the Albert Hall on Monday, the 13th February, at 6 p.m. Subject – ‘Kali- Worship’.”

নির্দিষ্ট সময়ে সভাপতি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘উপস্থিত সুধীজনদের যথাযথ সম্ভাষণ নিবেদন করে মিস মার্গারেট নোবেল বর্তমানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সিস্টার নিবেদিতাকে তাঁর বক্তৃতা শুরু করতে অনুরোধ করব। একজন খ্রিস্টান আয়ারল্যান্ডবাসী মার্গারেট নোবেল ভারতবর্ষে এসে ভারতবর্ষের আর্তজনকে সেবা করার জন্য হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে আজ নিবেদিতা নামে ভূষিতা। তাঁর আজকের বক্তৃতার বিষয় — কালী ও কালীপূজা। আমি সিস্টার নিবেদিতাকে অনুরোধ করছি তাঁর বক্তব্য উপস্থিত দর্শক মণ্ডলীর কাছে উপস্থাপন করুন।’
নিবেদিতা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। হাততালির শব্দে কান পাতা দায়। চারপাশে তাকাচ্ছেন। খুব ভিড় । বিবেকানন্দ, সারদানন্দ, যোগানন্দ অন্যান্য কয়েকজন সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারীরা বসেছেন মাঝামাঝি জায়গায়। সামনের সারিতে বসে আছেন ব্রাহ্ম বন্ধুরা। সরলা, ইন্দিরা, মিসেস সালজার সব সামনের সারিতে আলো করে বসে আছেন। মহেন্দ্রলাল, সুরেন্দ্রনাথ, মনোমোহিনী ছাড়াও ব্রাহ্ম সমাজের অনেক গণ্যমান্যরা এসেছেন। নিবেদিতা নিজেকে গুছিয়ে নিলেন। আজ তাঁর পরীক্ষা এবং একাধারে সুযোগও। গলাটা কি একটু শুকিয়ে যাচ্ছে?

‘এখানে দাঁড়িয়ে কালীপূজার বিষয়ে বক্তৃতা করার অধিকার আমার অল্পই আছে, এ-বিষয়ে আমি সচেতন। সংস্কৃত-জ্ঞান বা ভারতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে এমন জ্ঞান আমার নেই, যার দ্বারা এই উপাসনার বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নানা মতের বিচার আমি করতে পারি। ভারতে মাত্র এক বছর আমি এসেছি…।’

হল নিশ্চুপ। স্বামীজির মুখে প্রসন্নতা।

নিবেদিতা খুব ধীরে তাঁর সদ্য উপলব্ধ ধারণাকে প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে দু’-একটি কথা বললেন। তারপর আগ্রহী শ্রোতাদের সামনে তুলে আনলেন প্রতীককে পূজা করার বিষয়টি। তারপরেই বললেন— ‘কলকাতার এখনকার জীবনে একদল লোকের মধ্যে মাতৃরূপে ঈশ্বর আরাধনার ভাবটিকে অশ্রদ্ধা ও অগ্রাহ্য করার যে মনোভাব রয়েছে, ধন্যবাদের সঙ্গে জানাতে পারি, মাতৃসাধনার ভাবকে শক্তিশালী ও পরিষ্কৃত করার ব্যাপারে তার চেয়ে সুপরিকল্পিত উপায় আর কিছু হতে পারে না। আমরা যেন ভুলে না যাই তাঁরাও আমাদের মতো সত্যসন্ধানী… তাঁরা যা বলতে চান সাবধানে তার বিচার-বিবেচনা করা দরকার… স্বয়ং জগন্মাতা তাঁদের কণ্ঠে আমাদের কাছে তাঁর কথা বলছেন, যাতে তাঁদের এবং আমাদের ভালবাসা ত্রুটিহীন হয়ে ওঠে।’

নিবেদিতা একবার দেখে নিলেন সুরেন্দ্রনাথের উজ্জ্বল মুখ। সরলা ঘোষাল খুশি মনে হচ্ছে এই শেষ কথাটিতে। নিবেদিতা বক্তৃতা-মঞ্চটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন। তৃপ্ত তিনি। গত একমাস ধরে তিনি এই বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়েছেন। বারবার লিখেছেন, স্বামীজির কাছে দৌড়ে গেছেন, দেখিয়েছেন, আলোচনা করেছেন। আজ তাঁর উজ্জ্বল চোখ দুটো আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে নিবেদিতাকে। ধীরে, অতি ধীরে নিবেদিতা প্রবেশ করছেন। দু’-একজন উসখুস করলেও সবাই খুব মনোযোগী শ্রোতা। ভারতীয় দর্শনে নারীর অবস্থান নিয়ে বলতে বলতে তিনি সুন্দরভাবে ভারতীয় নারীত্বের ধারণা থেকে মাতৃত্বের ধারণায় গেলেন — ‘সর্বত্রই ভারতীয় নারীর সেই একই সরল, সুন্দর জীবন, যা ছিল প্রাচীন আর্য গ্রামে। অপরিমেয় পরিচ্ছন্নতা এবং সরলতা, অনন্ত শুচি-সাধনা, এবং সর্বসময়ে একই সুগভীর মাতৃত্ব।’

নিবেদিতা তাঁর অন্তরস্থ দৃঢ়তা উপলব্ধি করছেন। স্বামীজি যেন বলছেন ‘চরৈবেতি চরৈবেতি’। নিবেদিতা এবার প্রবেশ করলেন সরাসরি ঈশ্বরভাবনার মাতৃরূপে —

‘বিলাস ও আত্মপ্রীতি থেকে এই মুক্তিই ভারতীয় নারীত্বের আদর্শরূপ — এই জিনিসটি সুযোগ্য প্রতীক লাভ করেছে ভারতের ঈশ্বরভাবনার বিশিষ্ট রূপটির মধ্যে, যাকে বোধহয় পৃথিবীর সর্বাধিক মূল্যবান প্রতীক বলা যায় — মাতৃরূপিণী ঈশ্বর — রাজ্ঞীরূপিণী ঈশ্বর নয়। মাতৃরূপিণী ঈশ্বরের তিনটি রূপ : দুর্গা, জগদ্ধাত্রী ও কালী।’

একটি চাপা ফিসফিসানি চলছিল। ডা মহেন্দ্রলাল সরকার ঝুঁকে কথা বলছেন পাশের কারো সঙ্গে। লক্ষ্য করেছেন নিবেদিতা। চাপাস্বরে কথা চলছে উত্তেজিত ভাবে। ব্রাহ্মদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ বয়স্ক ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমরা এই সব কুসংস্কার দেশ থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছি, আর তোমরা বিদেশিরা আবার এইসব প্রচার করতে উঠে পড়ে লেগেছ!’

কেউ মহেন্দ্রলালের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। এক পক্ষ চিৎকার করে বলতে চাইছে, ‘একজন বিদেশিনীর কাছ থেকে শিখতে হবে আমাদের কালী পুজোর মাহাত্ম্য!’

অপরপক্ষ থেকে ধেয়ে আসছে, ‘শিখলে অসুবিধা কোথায়! ভুল কী বলেছেন!’
‘মিশনারি সাহেবদের পোঁ ধরে নষ্ট করছে সনাতনী হিন্দু ধর্ম!’
‘কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গড়ে তোলার সময় এখন আর এনারা আবার কুসংস্কারে ডোবানোর ফিকির করেছে!’
‘চুপ করুন আপনারা!’
‘চোপ্!,
‘চোপ্!’
বাদ-প্রতিবাদে পণ্ড হতে বসেছে সভা। নিবেদিতা নিজে সবাইকে হাতজোড় করে বসতে অনুরোধ করেন।

বিবেকানন্দ চুপচাপ বসে বসে দেখছেন। তিনি আঁচ পেয়েছেন যে, কলকাতার সুশিক্ষিত বঙ্গসমাজ আতঙ্কিত ও শিহরিত। সাংস্কৃতিক রাজধানীর বুকের উপর এক ইংরেজ মহিলা কালীর বিষয়ে বক্তৃতা দেবেন, এই বিষয়টি ঠিক হজম করতে পারেনি তারা। নিবেদিতাকে দিয়ে এই বক্তব্য উপস্থাপন করিয়ে তিনি কী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন সংস্কারপন্থী, মিশনারি ভাবাপন্ন, একেশ্বরবাদী বাঙালির সামনে! ব্রাহ্মরা মূর্তি পূজার বিরোধী, বিশেষ করে কালী মূর্তির। শিক্ষিত সমাজে যথেষ্ট প্রভাব আছে। মিশনারিরা গাদা গাদা ধর্মগ্রন্থ ছাপাচ্ছে, ধর্মান্তরিত করছে দরিদ্রদের বিশেষ করে। বিবেকানন্দ গুরু রামকৃষ্ণের কালীসাধনায় সমর্পণ করেছেন তাঁর বিদ্রোহী অদ্বৈতবাদের চেতনা নিয়েই। মিশনারি ভাবধারা ও ব্রাহ্ম পৌত্তলিকতা বিরোধিতার বিরুদ্ধে বিবেকানন্দ দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এক ইংরেজ মহিলাকে। যদিও বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে বলেননি কালী-বক্তৃতা করতে। কিন্তু নিবেদিতার আগ্রহ ছিল প্রবল এই ধরনের সভা আয়োজনে। স্বাধীনচেতা নিবেদিতার আগ্রহকে বাধা দিতে চাননি বিবেকানন্দ। তবে নিবেদিতার কালী-বক্তৃতা প্রকারান্তরে হয়ে উঠেছিল বিবেকানন্দের তীব্র প্রতিঘাত।



হই-হট্টগোলের মধ্যেই একজন গোঁড়া রামকৃষ্ণ ভক্ত হঠাৎ মহেন্দ্রলালকে উদ্দেশ্য করে ‘শয়তান বুড়ো’ বলে গালাগাল দেয়। তাই নিয়ে প্রায় হাতাহাতি হবার জোগাড়।

নিবেদিতা তথা বিবেকানন্দ তথা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষে একদল চিৎকার করে নিবেদিতাকে অপমান করার কথা তুলছে। আর একদল মহেন্দ্রলালের তথা ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ নিয়ে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে চিৎকার করছে। তাদের বক্তব্য এই পৌত্তলিকতার গুণকীর্তন শোনার জন্যই ডেকে আনা হয়েছে। শ্রোতৃমন্ডলীর এক অংশ থামাবার চেষ্টা করে চলেছেন। মঞ্চের উপর থেকে নিবেদিতা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সবাইকে শান্ত করার। একসময় সবাই শান্ত হয়। নিবেদিতা আবার শুরু করেন।
‘তাহলে কি ঈশ্বর আর প্রকৃতি সংঘাতে অবতীর্ণ, যার জন্য প্রকৃতি এমন অশুভ স্বপ্ন বিস্তার করেন!’

নিবেদিতা সুন্দর করে আবৃত্তি করলেন বেশ বড় একটি কবিতা। সবাই চুপ। নিবেদিতা দুর্গা, জগদ্ধাত্রী এবং কালীর রূপ ব্যাখ্যা করেন। এবার গুটিয়ে আনেন বক্তব্য।

‘শুধু সুন্দর, সহজ, মধুর কোমলকে বিশ্বাস করা, পূজা করার চেয়ে দারুণ বিশ্বাসঘাতকতা আর কী হতে পারে? আমরা যেন স্বেচ্ছায়, সানন্দে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে পারি রূঢ় কঠিনের, বীভৎসের, ভয়ঙ্করের। ঈশ্বর জীবন দিয়েছেন — সত্য। কিন্তু নিহন্তাও তিনি। ঈশ্বর কালাতীত নিত্য, — এই ভাবের সঙ্গে জেগে ওঠে নাকি মহাকালের কৃষ্ণচ্ছায়া, যার শুরু ও শেষ দুর্জ্ঞেয় রহস্যে?’

থামলেন নিবেদিতা। টেবিলের উপরের রাখা কাচের গ্লাস থেকে চুমুক দিয়ে জল খেয়ে ঢাকা দিয়ে রাখলেন ছোট্ট পিতলের রেকাবি দিয়ে। একবার আঁচ করে নিলেন শ্রোতাদের মন। একটু থেমে শুরু করলেন।
‘যদি তোমার হাত পা অসদাচরণ করে, কেটে ফেলো তাদের…। যিনিই সত্যের দেবতা তিনিই বলির দেবতা। শেষ কথা, মাতৃ-উপাসনার মহাগৌরব হল — পৌরুষ দেয় তা। যুগে যুগে কালী ভারতকে মানুষ দিয়েছেন।… যদি বাংলা দেশ, মাতৃ পূজার এই আদিপীঠ, মাতৃসাধকদের এই জন্মভূমি — মাতৃপূজা ত্যাগ করে, তাহলে নিজ পৌরুষকেই ত্যাগ করবে। প্রাচীন পূজাকে দশগুণ বেশি ভক্তির সঙ্গে এখন করতে হবে, না করলে এ দেশের চির দুর্দশা ও অপমান।’
সকলকে নমস্কার ও অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন।
নিবেদিতার গাল দু’টি লাল হয়ে উঠেছে উত্তেজনায়। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলেছেন। তৃপ্ত তিনি নিজের উপস্থাপনায়। নেমে এলেন মঞ্চ থেকে। অনেকেই এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভ্রান্ত লোকজন সব। নিবেদিতা করজোড়ে গ্রহণ করছেন। সামগ্রিকভাবে মনটা উৎফুল্ল হয়ে আছে। সুরেন্দ্রনাথ তার বন্ধুদের নিয়ে এসেছে নিবেদিতার কাছে। তার উপরে কালীঘাট মন্দির থেকে কয়েকজন এগিয়ে এসে নিমন্ত্রণ করে গেলেন কালীঘাট মন্দিরে মাতৃরূপা কালী বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য। সব নিয়ে নিবেদিতা খুশি। খুশি বিবেকানন্দ।

জানালা দিয়ে হিম হাওয়া ঢুকছে ঘরে। হিমের পরশ ভাল লাগছে নিবেদিতার। বাগবাজার এখন সাদা পাতলা হিমের চাদরের নীচে গুটিসুটি ঘুমে। মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক কাছে-দূরে। রাস্তায় লোহার কেয়ারি করা কেরোসিনের লন্ঠনের আলো ঘিরে আবছা জমাট কুয়াশা। অলৌকিক লাগে এই শহর শীতের রাতে। এই নিস্তব্ধ সময়ে নিবেদিতা টেবিলে বসেন লিখতে। খবরের কাগজের লেখা, ডায়রি, আর চিঠির পর চিঠি। সব সবকিছু লিখে রাখা চাই তাঁর। অকপট বলে যাওয়া। লেখা শুরু করলেন চিঠি তাঁর প্রিয় ম্যাকলয়েডকে, আদরের য়ুমকে।

আলবার্ট হলে যা যা বিশৃঙ্খলা ঘটেছে, সব ঘটনা বললেন। নাম করেই মহেন্দ্রলাল সরকারের কথা বললেন। তারপর ভাল লাগার কথা —
“ One lovely gift my lecture has brought me. The heart, friendship and enthusiasm of a young Tagore boy full of noble impulses and freshness… These things must do good in the end. To have a chance of showing that seed seems enough.
Of course I read Swami’s poem – and did not tell him till I got home – when I saw that he was pleased and touched.”
টেবিলের উপর সেজবাতির নরম আলো। নিবেদিতা টেবিলের উপর ঝুঁকে লিখে চলেছেন। গালের দু’পাশে গড়িয়ে নেমেছে চুলের ঝাড়। কমলা রঙের চাদরটি জড়িয়ে নিলেন ভাল করে গায়ে। ঘরের কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। গলিতে কতগুলো কুকুর হঠাৎ চিৎকার করে উঠল ঘুম ভেঙে একসঙ্গে। অচেনা কিছু দেখেছে! ঠান্ডা হাওয়া আসছে। নিবেদিতা উঠে জানালা বন্ধ করে দিলেন। আবার বসলেন লিখতে।‌ গত সপ্তাহে ঘন ঘন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নিমন্ত্রণ ছিল। তাঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে যেতে হয়েছিল নিবেদিতাকে বেশ কয়েকবার। কখনও কখনও রাতের খাবার খেয়েও ফিরেছেন। য়ুমকে জানাচ্ছেন সব নিবেদিতা। জানাচ্ছেন ভাল লাগার কথা। প্রবেশ না অনুপ্রবেশ! ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে তাঁর সখ্যের কথা জানাতে জানাতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছেন তিনি। ঠাকুর পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ বালকবন্ধুটি নিবেদিতার গুণমুগ্ধ হয়ে উঠছে। বীজ বপনের কাজ শুরু হয়েছে! ঠাকুরবাড়ির বালকটির সেদিনের উচ্ছ্বাস নিবেদিতার কাছে উপহার বলে মনে হচ্ছে। বিশৃঙ্খলার এই সভার শেষে ভাল সমাপ্তি হিসেবে দেখছেন এই জোড়াসাঁকোর কনিষ্ঠ সদস্যদের তাঁর এবং কালীপুজো নিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা!

টিকটক টকরটক। একটা টিকটিকি আছে এই ঘরে। সে কখনও সখনও ডেকে ওঠে- টিকটক টকরটকর টক টক টক! টিকটিকিটা মোক্ষম জায়গায় ডেকে ওঠে প্রায়শই। টিকটিকির ডাক নাকি ফলপ্রসূ হয়। সত্যি হয় মনের কথা। তবে কি সত্যি হবে!

‘যদি ওঁরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আপনি কি তাঁদের সঙ্গে কথা বলবেন?’ নিবেদিতা তাকায় বিবেকানন্দের দিকে। সন্ধ্যারতির পরে এসে বসেছেন শিষ্যার সঙ্গে। সামনে প্রবহমান গঙ্গা।


‘আমি জানি, ওঁরা আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন কথায় কথায়! তাই …। আপনি তো জানতে চান ওঁরা কী তর্ক করছেন, আমিও বা সেইসব প্রশ্নের উত্তর কী দিচ্ছি! তাই বলছিলাম!’ চুপ করে গেলেন নিবেদিতা। অপেক্ষা করলেন উত্তরের। নীরবতা। দৃষ্টি তাঁর গঙ্গার প্রবাহে।

বিবেকানন্দ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘মায়ের ইচ্ছা… যদি মা চান… তিনিই করাবেন। আমার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই… সবই তাঁর কাজ। আমার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষায় যদি দ্রুত করতে যাই তার ফল ভাল হবে না, পণ্ড হবে সব। আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে উৎসাহী নই। তাঁরা যদি আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী হন তাঁরা আসবেন, যেমন সারা পৃথিবীতে হয়েছে। তাঁরা আসবেন — মা তাঁদের আনবেন।” ( “…I need not stir to meet them. If they are mine they will come – She will bring them.” Letters dated 15 February 1899, pg.55)

নিবেদিতা ফিরে এসেছিলেন বেলুড় থেকে সন্ধ্যা নামার পর। সঙ্গে সদানন্দ। বক্তৃতা দেওয়া থেকে এখন এই আলোচনা অবধি বিশ্রাম হয়নি একটুও। মানসিক চাপ তো গেছেই। বুঝতে পারছেন কোথাও একটা দেওয়াল আছে। অদৃশ্য দেওয়াল। জোড়াসাঁকো ও বেলুড়। বুঝে বা না বুঝে তাঁরা একদিন মানবতার ঈশ্বরের কাছে আসবেনই। আসবেন সবাই। তাঁদের জড়ো করা যাবেই মায়ের পদতলে।‌

ক্লান্ত নিবেদিতা। সারাদিন অসম্ভব পরিশ্রম হয়েছে তাঁর মানসিক ও শারীরিক। সদানন্দের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি আসার পথে। উপরে নিজের ঘরে চলে এসেছিলেন। ভারী হয়ে আছে মন। তাহলে কি স্বামী নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছেন নিবেদিতার কাছে। বক্তৃতাসভার শেষে সরলাকে দেখেছেন নিবেদিতা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্বামীজির সঙ্গে কথা বলছেন। কথা বলার ভঙ্গিতে শ্রদ্ধা ও ভক্তি দেখেছেন নিবেদিতা। সুরেন্দ্রনাথ ও এক বাদশা তো গুণমুগ্ধ হয়ে ওখানেই বলল, আসবে নিবেদিতার কাছে কালী মাতৃদেবতার কথা শুনতে। মোহিনীবাবু তো স্কুলের জন্য মাসে ১৫ টাকা করে অনুদান দেবেন বলে কথা দিয়েছেন নিবেদিতাকে। ব্রাহ্মদের মধ্যে তরুণ সম্প্রদায়কে আগ্রহী করা গেছে। কিছুটা হলেও সত্যি তো! নিবেদিতা তাঁর বিছানায় বসলেন। উঠলেন। বাথরুমে টিনের বালতিতে জল ভরা আছে। টিনের মগ। চৌবাচ্চার কালো জলে কেঁপে উঠল তাঁর ছায়া। মাঝে মাঝে লন্ঠনের আলোয় নিজের ছায়া দেখে নিজেই ভয় পেয়ে যান। অন্ধকার, ছায়া, প্রচ্ছায়া, আলো এই নিয়ে আশ্চর্য এক দেশে তিনি আছেন আলো জ্বালাবার জন্য। পড়ার টেবিলে আলোটি দপ্ দপ্ করছে। নিবেদিতার ছায়া কেঁপে কেঁপে বিরাট হয়ে দেওয়ালে পড়েছে, দেওয়াল ফাটিয়ে ছায়া দীর্ঘতর হতে হতে বাগবাজার থেকে বাংলা পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে।

আবার আকাশ কালো হয়ে আসছে। আজ জুলাই মাসের ৫ তারিখ। গতকাল রাতে মহানির্বাণ হয়েছে গুরুদেবের। সকল তর্ক, বিতর্ক, আদেশ, উপদেশের পরিসমাপ্তি। নিবেদিতা স্থির তাকিয়ে থাকেন গঙ্গার স্রোতের দিকে। স্রোতের বিপরীতে চলেছেন তিনি। অদূরে ওই বেলুড় মঠ। পৌঁছাতে হবে শেষকৃত্যে। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

[ক্রমশঃ]

[পর্ব ৩]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
নবনীতা দে ।
নবনীতা দে ।
2 months ago

নিবেদিতার ওপর এই তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটি খুবই ভালো লাগছে , লেখার চলনটিতেও নতুনত্বের ছোঁয়া , পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় আছি ।

Rajat Chakraborti
Rajat Chakraborti
2 months ago

আপনারা সঙ্গে আছেন বলেই সবকিছু।
সঙ্গে থাকুন। পড়তে থাকুন।

শিপ্রা ভৌমিক
শিপ্রা ভৌমিক
2 months ago

ছবির মতো লেখা!সময়টাকে দেখতে পাচ্ছি!পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি।

RAJAT KANTI CHAKRABORTI
RAJAT KANTI CHAKRABORTI
1 month ago

আমিও সমৃদ্ধ হচ্ছি।

Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
2 months ago

খুব ভাল লাগছে লেখাটি পড়তে। সমৃদ্ধ হচ্ছি প্রতি পর্বে।

RAJAT KANTI CHAKRABORTI
RAJAT KANTI CHAKRABORTI
1 month ago
Reply to  Syamali Bhadra

আমারও ভালো লাগছে। আপনারা সবাই আছেন। চলুন সঙ্গে সঙ্গে কতদূর যাওয়া যায়।