সিঁড়ি যে কতরকমের হয়!
ঐ যে পূর্ণেন্দু পত্রী বলেছেন না, “সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি /পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি/ অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি /কদম ফুলের গন্ধ সিঁড়ি/ ওঠার এবং নামার/ চলতে চলতে থামার।”
আমরা সবাই কমবেশি এইসব হরেক কিসিমের সিঁড়ির সাথে পরিচিত।
অনেক ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে একজন সম্পন্ন কৃষকের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। সেখানে তারা ঘুরে ঘুরে তাদের ধানের গোলা , সদর অন্দর দেখাতে দেখাতে একটা সিঁড়ির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অবাক হয়ে দেখি সিঁড়ির মাথায় দরজা! তিনি সেই দরজাটা ফেলে উপরে ওঠার রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন ,এটাকে চাপা সিঁড়ি বলা হয়। যদি ডাকাত আসে তাহলে আমরা উপর থেকেই এই সিঁড়ি ফেলে পথ বন্ধ করে দিলে খুব সহজে ডাকাতরা আর ওপরে আসতে পারে না।
জীবনের নানা কাজে যখন বারবার বিফল হয়েছি প্রতিকূলতা যখন মুহুর্মুহু রাস্তা রোধ করে দাঁড়াচ্ছে আলো যখন একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে তখন কি জানি কেন মাথার ওপর দরজা পড়ে যাওয়া সেই সিঁড়িটার কথা আমার বারবার মনে পড়তো।

আচ্ছা সিঁড়ি কি একটা পথ?
পথই তো ,এগিয়ে চলার সোপান, আগামীর পথে উচ্চতা স্পর্শ করার এক বিকল্পহীন আরোহিনী।
এ সিঁড়ি কাঠের নয়, কংক্রিটের নয়, স্বপ্ন দিয়ে সাজানো কঠিন বাস্তবের অদৃশ্য সিঁড়ি।

সেদিন রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছি। একটা স্কুল বাস এসে দাঁড়ালো। খাঁকি প্যান্ট, সাদা জামা , পিঠে ব্যাগ , গলায় ওয়াটার বোতল ঝুলিয়ে বাস থেকে বাচ্ছারা এক এক লাফে নেমে স্টপেজে অপেক্ষমান মায়েদের দিকে দৌড়ে গেল। মনে হল ওদের জীবনের সামনে এখন সেই সিঁড়ি, যা অতিক্রম করে একদিন সাফল্যের দুয়ার খুলবে। আপাতত মা বাবা হাত ধরে একটা একটা করে সেই সিঁড়ি পার করে দেবেন।


যার ধাপে ধাপে আছে অধ্যবসায়, প্রচেষ্টা, অদম্য জেদ, সংকল্প, ব্যর্থতা এবং উত্তীর্ণ হবার সুদৃঢ় মানসিকতা।
জীবনের এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে কত অপমান,যন্ত্রণা, নির্যাতন, উপেক্ষা, অবহেলা নীরবে সহ্য করতে হয়।
কিন্তু এই যাত্রাপথ সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয় ওই স্কুল ফেরত বালকের দল, এখন তো তারা অভিভাবক ,শিক্ষকের আজ্ঞাবহ। কিন্তু একদিন এই সময়কে পিছনে ফেলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠে যাবে।
পিছনে যে সিঁড়ি পড়ে রইল তার দিকে তাকিয়ে দেখতেও পারে, আবার ভুলেও যেতে পারে। হয় গর্বিত হবে পিতামাতা, না হয় দুঃখ হতাশা তীব্র যন্ত্রণায় পরস্পরের দিকে নীরব দৃষ্টি ফেলে নিজেরাই নিজেদেরকে প্রশ্ন করবে। ‘ যে পথ দিয়ে চলে এলি সে
পথ এখন ভুলে গেলি রে!

রক্ত মাংসের শরীর দিয়ে স্পর্শ করা হয় যে সিঁড়ি,সেই সিঁড়ির বাঁকে আমার কৈশোরে জীবনের প্রথম কদম ফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম।
সিঁড়ি বেয়ে পড়ে মারা গিয়েছিল ঠাকুর বাড়ির সেই ছোট্ট মেয়েটি ,যার মৃত্যুর কারণ হিসাবে নতুন বৌঠান নিজেকে দায়ী করেছিলেন।
জীবনের পথে বন্ধুর সিঁড়ি ভাঙার সময় ভাগ্যবান যারা তারা ধরবার মতো একটা হাত অথবা রেলিং পায় যারা সেটা পায় না তারা একলা চলো রে মন্ত্রকে বুকে নিয়ে অদম্য জেদে আছাড় খেতে খেতে একসময় ঠিক লক্ষে পৌঁছে যায়।
অনেক বছর আগে গড় পঞ্চকোটে প্রাচীন মন্দিরটায় উঠতে গিয়ে সিঁড়ির মাঝখানেতে আটকে গেছিলাম। সিঁড়ি তখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ । ওপরে ওঠা অতীব কষ্টকর। তখন মনে হয়েছিল এই ভাঙ্গা সিঁড়ির মতো আমাদের ইতিহাসও থমকে আছে। আমরা সিঁড়ি ভেঙে অতীতের গর্ভে নেমে উদ্ধার করতে পারছি না সত্যিকারের ইতিহাস।

সেদিন পত্র সাহিত্যের একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে অনেক বছর পর একটা স্কুলের সিঁড়িতে পা রাখলাম। ছোট্ট ছোট্ট সিঁড়ি। ওপরে উঠতে কোনো কষ্ট হয়না।
একদিকে রেলিং আর একদিকে দেয়াল। যেমন হয় আর কি। সিঁড়ির নিচের ধাপে দাঁড়িয়ে ওপর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল বছরের পর বছর ধরে কত ছোট ছোট পা এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেছে। তারা কেউ মানুষ হয়েছে কেউ অমানুষ কেউ অমানুষের মুখোশ পরা মানুষ।

সেখানে দাঁড়িয়ে আমি যেন মানস চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম নীল পাড় সাদা শাড়ি পরে দল বেঁধে আমরা মেয়েরা আমাদের স্কুলের সিড়ি দিয়ে উঠছি নামছি।
আমাদের স্কুলের বড়দি মেজদি,আমাদের বন্ধুরা,কত
স্মৃতি গোল হয়ে উঠছে উঠছে আর উঠছে…

অনেক বছর পর একদিন উঠতে উঠতে লক্ষ্য ছুঁয়ে আবার মাটি স্পর্শ করে সিঁড়ির অভিমুখ বদল করেছিলাম আমরা।
সারাজীবন ধরে এ এক অনির্দিষ্ট যাত্রা। ওঠা নামা চলছে তো চলছেই । বিরামহীন রকমারি সিঁড়ি রূপে অরূপে ভাস্বর হয়ে জীবনকে বুঝিয়ে দিচ্ছে ” চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ”

[পরম্পরা ওয়েবজিন, নভেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
2 months ago

কত রকমের সিঁড়ি, আর কি গভীর তার অর্থ, ব্যঞ্জনা!
কবি নন্দিতার ভাব ফুটে উঠেছে তার এই গল্পে!
অভিনন্দন!