প্রবাসী মাটির গন্ধ
মুরোরান বন্দরে জাহাজ যখন পৌঁছালো তখন সবে ভোর হচ্ছে। পুবের আকাশ জুড়ে রামধনুর নরম আভা ঠিক তার পিছনেই আকাশ লালে লাল। সূর্যোদয়ের দেশে সূর্য উঠছে।
জাহাজ থাকবে দুটো তিনটে দিন। কিন্তু দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার পারমিশন এবার পাওয়া গেল না। দূরে যাওয়া গেল না তো কি হয়েছে? আশেপাশে চারদিক ঘুরে দেখতে আপত্তি কি? ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু এই থিওরিটাকে তো মান্যতা দিলেই ভ্রমণের তৃষ্ণা মিটে যায় খানিকটা।
আমি বেড়াতে গেছি জাহাজী স্বামীর সাথে। তিন সাগরের বুকে ভেসে লম্বা ভয়েজে আটটি মাসের জন্য।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে হক্কাইডো দ্বীপের একটি শিল্প বন্দর শহর হল মুরোরান । এর অসাধারণ উপকূল রেখা প্রাণবন্ত নীলবর্ণ জল মাথার ওপরে ওড়া সি-গাল এবং স্বচ্ছ শান্ত লোনা জলে মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠা ডলফিন মুরোরানের সম্পর্কে একটা সুন্দর আকর্ষণীয় ছবি মনের মধ্যে তৈরি করে রেখেই ছিল।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বন্দরের গেট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল নামী শিল্পীর আঁকা কোন পোর্ট্রেট বুঝি! নিখুঁত পরিষ্কার ঝকঝক করছে চতুর্দিক। এমনকি সারি দিয়ে সাজানো গাছগুলোর পাতা পর্যন্ত চকচক করছে কচি সবুজে । রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে থরে থরে । কী তাদের রূপ, লাবণ্য ! অথচ কোথাও কোনো হর্ন নেই । কিছু পথচারী আছে পথে অথচ কোন কোলাহল নেই। যেন ‘কোলাহল তো বারণ হলো’…
আমরা সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আশ্চর্য যতবার মানুষজনের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে ততবার তাঁরা মাথা হেট করে অভিবাদন জানাচ্ছেন আমাদের। এমনকি একটা দুটো গাড়ি স্পিড কমিয়ে আমাদের লিফটও দিতে চাইল। কেউ কেউ তো গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে অভিবাদন করে জিজ্ঞেস করল, ইউ আর ফ্রম ইন্ডিয়া? নেতাজি সুভাষ কান্ট্রি ? গর্বে তখন বুকটা ভরে যাচ্ছিল। আমাদের ভারতীয় বলে চিনতে পারছে ওরা? সুভাষচন্দ্র বসুর সশ্রদ্ধ উপস্থিতি আমরা বহন করে চলেছি আমাদের উত্তরাধিকারে! দেশের কথা মনে করে সেই পরবাসের মাটিতেই প্রণাম জানালাম মনে মনে।
আসলে চিনতে পারার একটা কারণ ছিল। জাহাজে সেল করবার পারমিশন পাওয়ার পরেই বাবা বলে দিয়েছিলেন, নিজের ঐতিহ্য যেটুকু আছে সেটুকু বহন করবে তোমার পোশাকে ব্যবহারে। শাড়ি পরিহিত আমাকে দেখে তাই ভারতীয় বলে চিনে নিতে হয়তো বা বিদেশীদের ভুল হচ্ছিল না।
ছোট ছোট বাচ্চারা দল বেঁধে স্কুলে যাচ্ছে সাইকেলে। শিশুর চরিত্র সর্বত্রই সমান। তারা নিজেদের মধ্যে হাসি গল্প করতে করতে প্যাডলিং করছে। কিন্তু আশ্চর্য সবকিছুতেই একটা পরিমিতি বোধের ছাপ। পাহাড়ের বুকে গড়ে ওঠা শহরটির রাস্তা যথেষ্ট উঁচু নিচু। চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ। ছবির মত সুন্দর সুন্দর বাড়ি সব। ততোধিক সুন্দর সব বিপনী।
একটা বিষয়ে খুব আশ্চর্য লাগছিল আমরা যেখানেই যাচ্ছিলাম কোন দোকানে ঢুকছিলাম ,না দাঁড়িয়ে কেবল দেখছিলাম সেখানে সবাই আমার পাঁচ বছরের শিশুর জন্য কোনো না কোনো উপহার দিচ্ছিল যার কিছু কিছু আজও যত্নে সংরক্ষিত আছে।
সেদিন দুপুরে এস সি আই এজেন্ট আমাদের লাঞ্চে নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমরা তাই বেশি দূরে কোথাও যাবো না বলেই হাঁটা শুরু করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে একটা লেভেল ক্রসিং এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। গেট পড়ে আছে। ট্রেন আসবে । না গেট বলতে আমাদের এখানকার মতো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত আটকানো লোহার রড নয়। সুন্দর শিল্পিত দুটি রড দুদিক থেকে এগিয়ে গেছে ফুট দশেক। সেই গেট টপকে কেউ যাবার চেষ্টা করছে না। সবাই থেমে গেছে। অবাক হয়ে ভাবছি মানুষজন সব বোবা নাকি ! কত লোক রেলগেটের দুধারে অথচ কোনো জনরব নেই!
বেশ কিছুক্ষণ পরে ট্রেন এল । সেই ট্রেন দেখে তো আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ। সবই কি এখানে রং তুলি দিয়ে আঁকা! চকচক করছে এতো যেন ট্রেনটি স্নান সেরে লাইনে নেমে এসেছে এক্ষুনি।
ট্রেন চলে যাবার পরে দুদিক থেকে এগিয়ে আসা দুটো মেটাল রড ফোল্ডিং হয়ে আবার ঝুলে গেল ল্যাম্পপোস্টের মত দন্ডায়মান দুটো পোস্ট এর গায়ে।
পথে পথে মহামূল্যবান গাড়ি চড়ে যাওয়া মানুষ যেমন দেখছি তেমনি সবজিওয়ালাও দেখছি। যারা সাইকেলের পেছনে টাটকা সবজি বেঁধে হয়তো কোন দোকানে বা শপিং মলে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনে সেই প্রথম আমি অত বড় মুলো দেখেছিলাম কলা দেখেছিলাম ! পাহাড়ের ঢালু রাস্তায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর আমরা ক্লান্ত হয়ে গিয়ে বসে ছিলাম একটা ছোট্ট টিলার উপরে ।তখন সেখানে নতুন কোন আবাসন হয়তো গড়ে উঠবে। কিছু মানুষজন কাজ করছিল একটু দূরে। ঘন গাছের ছায়া ঘেরা নিবিড় নির্জন প্রকৃতি।
আমরা যেখানে বসেছিলাম ঠিক তার কাছে একটু খালি জমিতে মাটি কোপাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। কিছু কচি গাছের চারা গোছা করে করে রাখা। হয়তো সেগুলোই বসাবেন তিনি। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর দামী গাড়ি। আমরা বিদেশীরা যে সেখানে গিয়ে বসলাম তিনি একবার শুধু মুখ ঘুরিয়ে অভিবাদন করলেন। তারপর আবার নিজের কাজ করতে লাগলেন অসংকোচে। এত সুন্দর গাড়ির মালিক নিজে হাতে মাটি কোপাচ্ছে নিজের জমিতে! আমরা অবাক হয়ে হচ্ছিলাম।
চারপাশের অনুপম সৌন্দর্য ঘন নীলের সাথে কচি সবুজের নিখুঁত পারিপাট্য মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ডাক আর সমুদ্র ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস আমাদের সম্মোহিত করে দিচ্ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে আরেকটি চমৎকার গাড়ি করে একটি কমবয়সী মেয়ে এসে নামল। বাবার সাথে কিছু কথা হলো, তারপর লাজুক লাজুক মুখে সেই মেয়েটি গাড়ির ভেতর থেকে ছোট্ট আধুনিক কোদালের মতো কোন একটা ইকুপমেন্ট বার করল। অ্যাপ্রন পরে জিনস গুটিয়ে তারপর সেও মাটি কোপানোর কাজে হাত দিল। ভদ্রলোক তখন চলে গেলেন।
আমরা ভাবছিলাম ওমনি ওমনি একটা দেশের এত উন্নতি হয় না। যদি প্রত্যেকটি মানুষ না সুশৃংখল হয়, শ্রমের মর্যাদা বোঝে। আমরা বাংলা রচনা বইয়ে এই বিষয়ে প্রবন্ধ পড়ি কিন্তু নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে এইভাবে শ্রমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কাজ করার কথা ভাবতেও পারিনা।
দুপুরে আমরা লাঞ্চ করতে ঢুকেছিলাম একটা দামি রেস্তেরায়। সেখানে হাজব্যান্ড এর জাহাজের অফিসারদের ফ্যামিলি সমেত লাঞ্চের নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা আমাদের প্রাতঃকালীন সফর সেরে সেই ঠিকানায় পৌঁছে গিয়েছিলাম।
সেখানে খাবার ধরনটি ভারী অদ্ভুত। মেঝেতে দুসারি করে লম্বা কার্পেট পাতা। খাবার জায়গাটা স্কুলে বসার বেঞ্চ যেমন হতো তার থেকে আরেকটু নিচু লম্বা লম্বা বেঞ্চ। তার ওপর কার্পেট পাতা। মাটিতেও কার্পেট পাতা। মাটিতেই দু সারিতে আমরা মুখোমুখি বসলাম। বেঞ্চের উপরেই ছোট্ট ছোট্ট বার্নার এর উপরে পাত্র বসানো। সামুদ্রিক শামুকের কিছু একটা সুপ খেয়েছিলাম। তার নাম এতদিন পরে আর মনে নেই। সাথে রামেন নুডুলস যার ওপরে ভাসছিল সেদ্ধ পেঁয়াজ মাশরুম এবং সবুজ সবুজ আরো কিছু শাক পাতা আর কচি বাঁশের কান্ড ( আমাদের এখানে যাকে কোরোল বলে।) খেয়েছিলাম অপূর্ব সুস্বাদু ‘ ইয়াকিটুরি’ নামের একটা খাবার । শুকরের মাংসের তৈরি সে খাবার অনেকটা বারবিকিউ জাতীয়। কাঠকয়লায় ভাজা এবং উপরে গোলমরিচ এবং কোন একটা সস দিয়ে ব্রাশ করা। অসাধারণ সেই খাবার! মুরোরান এজেন্টের নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম আমরা তাই সেদিন মেয়েরা কিমানো পরে আমাদের খাবার সার্ভ করেছিল। এইটা ওখানে একটা বিশেষ প্রথা। সম্মাননীয় অতিথিদের কিমানো পরে খাবার সার্ভ করা। ডল পুতুলের মত সুন্দরী মেয়েরা বিনম্র ভঙ্গিতে কত যত্নে আমাদের খাইয়েছিল! তাদের আতিথেয়তা, সৌজন্য ,ব্যবহার আমাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মানবিক গুণাবলীতে মাখামাখি হয়ে জাপানের মুরোরান বন্দরের ওই একটা দিন আমার কাছে এক আনন্দকুম্ভ । চোখ বন্ধ করে আমি মনে ফুটিয়ে তুলতে পারি ভোরের রামধনুর বিন্যাস, স্বচ্ছ নীলজলের তরঙ্গায়িত সুষমা কিংবা বন্দরে নোঙর করা জাহাজের রাতের আলোয় মনকেমনের
চাপা দুলুনি।
সেলিংয়ের সময় জুড়ে যা আমাকে মাটি ছোঁয়ার বাসনায় বুভুক্ষু করে রেখেছিল অনুক্ষণ।
[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]
খুব ভালো লাগলো।
ভাল লাগল।