
বিষ্ণুপ্রিয়া
মামার বাড়ি ছিল দুর্গাপুরে ৷ প্রথম যেখানে মামার কোয়ার্টার ছিল –তার উল্টোদিকে স্কুল আর স্কুলের লাগোয়া বিশাল এক মাঠ ৷ মাঠের পর মাঠ ৷ ছোটবেলা থেকে মাঠকে একটা বা একা কখনো দেখি না ৷ দেখতে চাইও না ৷ মাঠ দেখলেই কোনো খেলাটেলা নয় -এপার থেকে ওপারের শেষ অব্দি হাঁটতে চাইতাম। ওপারে পৌঁছে মনে হতো- আরে আমি তো এপারে চলে এলাম। নাও –চল এবার ওপারে। অর্থাৎ একটু আগে যেটা এপার ছিল -সেইখানে। ফলে একটা মাঠ আমার কাছে সবসময় দুটো হয়ে থাকত। দুটো মাঠ হলে সেটা চারটে। এই করে হৃদয় আমার মাঠে ভরেছিল ছোট্ট থেকে।
দুর্গাপুরে অবশ্য স্কুলবাড়ির মাঠে এপার ওপার করতে হত না। কারণ সে মাঠের শেষে আবার একটা এবড়োখেবড়ো জমি শুরু হয়েছিল। ছোট কটা লাল মাটির ঢিবি। সাঁওতাল ছেলেমেয়েরা দিনরাত ঢিবি থেকে জমির ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে নামত -খানিক মাটি মাখত -আবার দৌড়ে ঢিবি চড়ত। মনে হত –ওই জায়গাটা ওদের জন্মভূমি -আমার ভারত। তখন সবে জন্মভূমির মানে বুঝতে শুরু করেছি। আমাদের সময় অবশ্য বই পড়ে জন্মভূমি -দেশপ্রেম শিখতে হত না ৷ ও আমি এমনি বুঝেছিলাম ৷
-এই আমায় আর আমার মাকে খেলতে নিবি? আমরাও খুব ভালো গড়াতে পারি। নিবি? দেখবি মা আর আমি গড়গড় করে নেমে যাব৷ মা চলে এস -ওরা মনে হয় আমাদের খেলায় নেবে।
কালো ছেলেমেয়েগুলো অবাক। একটা সুতোর মতো রোগা ছেলে সাদা মূলো (দাঁত) বের করে বলল-
-তোর মাও খেলে বুঝি? আমরা কিন্তু খেলার মাঝে বদ কথা বলি। তোর মাকে সাবধান করে দিবি- ওইসময়টায় যেন কান বুজে থাকে- বলে দিবি একদম।
মা- তোমার কানে খোল আছে? থাকলে খোল দিয়ে কানের ফুটো দুটো ভালো করে ঢেকে নাও। এস –হাত ধর আমার। উফ ! এদিক ওদিক তাকাচ্ছ কেন মা? এখন টিলায় চড়ব আমরা –টিলার মাথা দেখবে শুধু। এই সুতো –দেখছিস না -আমার মার পা হড়কাচ্ছে ! মায়ের ওই হাতটা টেনে ধরে রাখ।

জীবনে ভালো ও বদ- দুটো শব্দের দুটো রেলগাড়ি সবসময় চলতেই থাকে। সমান্তরালে নয় – শঙ্খলাগা সাপের মতো চলে। তাই শেষমেশ সুতো, আমি, মা আর সুতোর বন্ধুরা একসঙ্গে টিলায় উঠেছিলাম। কী আশ্চর্য ! কেউ আগেও না। পরেও না। এমনভাবে লাইন ম্যানেজমেন্ট করছিল সুতো। বলতে ভুলেছি- টিলায় উঠতে উঠতে আমি ঐ মূলোদাঁতের ছেলেটার নাম দিয়েছিলাম সুতো ৷ আর ও আমায় ডাকল –সাদা পেত্নী।
এরপর থেকে প্রায়ই আমাদের খেলা চলতে লাগল। টিলার ওপরে হু হু হাওয়া চলত। আমাদের মা মেয়ের চুল এলোমেলো উড়ত। সুতো শুকনো ঘাস দিয়ে দুজনের ঝুঁটি করে দিত। শুকনোর জোর থাকে না -আবার খুলে যেত।
একদিন বিকেলে সবকটা টিলায় বসে গল্প করছি। সন্ধে নামছে। হঠাৎ সুতো বলল – মাসি চল। তোমার শয়তান মেয়েটাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চল আজ। মুড়ি খাবে আর তোমাকে একটা পরী দেখাব।
সুতোর টান দেওয়ার ক্ষমতা ছিল বটে। গুল বুঝেও মায়ের সঙ্গে গেলাম সাঁওতাল পাড়ায়। কটা মাত্তর বাড়ি একজায়গায় মুখ গুঁজে। আর লম্বা লম্বা কটা গাছ। সুতোর মা আমার মায়ের সঙ্গে কথাই বললেন না। মুড়ি অবশ্য দিলেন। মনখারাপ —বসে আছি। সুতো বন্ধুদের জড়ো করছে –বোধহয় আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
চাঁদ উঠল — ঝকঝকে সাদা আলোয় সুতো আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করাল উঠোনের মাঝখানে। নিজে পালাল দূরে..! আরে ! মা – বাকি ছেলেমেয়েগুলোই বা গেল কোথায় ! রাতে একটা বাচ্চামেয়েকে একা করে কেউ ! সুতোটার সঙ্গে মিশে মা টাও হাড় বদমাশ হয়েছে আমার- বাড়ি যাই। দিদুকে বলে পিটুনি খাওয়াবই মাকে! এত ভালোবাসি –তাও আমার সঙ্গে এমন করলি তো মা? —গজগজ করেই যাচ্ছি৷
চারপাশ দিয়ে মুরগী ঘুরছে -দানা খেয়ে সন্ধের ডাক ছাড়ছে পুষ্টিদাত্রী প্রাণী৷
হঠাৎ…
মাসি –ওই দেখো উঠোনে পরী। তোমার সাদা মেয়ের গায়ে চাঁদ এসে একদম রুপোর লক্ষ্মী বানিয়ে দিয়েছে গো। কালই এর পুজো করে মুসুর ডালের খিচুড়ি খাওয়াবে মাসি।
বলতে বলতে সুতো- তার বন্ধু- তার মুরগী সব আমার চারপাশে নাচতে লাগল। বাজনা নেই -গান নেই –নিঃশব্দ নাচ।
ফেরার পথে দেখলাম ওই চাঁদের আলোয় সুতো নিজের কালো হাত বারবার মেলে ধরছে। বাড়ি ফেরার দেরী হচ্ছে। তাও সুতোর হুঁশ নেই ৷ এক হাতে আমায় ধরে- আর এক হাত চাঁদের দিকে উঁচু করে। তার মুগ্ধ চোখ আলো মাখা হাতের চামড়ায় নেই আর। সে চোখ চরম এক আলোর দিকে। কালো চৈতন্য বউ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। মিছে বউ -ঘর বর সব মিছে -সত্য শুধু চৈতন্য ৷
As usual very symbolic.
As usual very symbolic.
খুব সুন্দর গল্প। অভিনন্দন