বাবুরাম পারলো না
আমরা ছোটবেলায় যে মফঃস্বল শহরে থাকতাম তার নাম কেউ একটা শোনেনি। আগেকার দিনে লোককে বললে চিনতেই পারতো না। এখন জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য কলকাতার পাশাপাশি মফঃস্বল শহরের মতো আমাদের রাজাহাটিতেও তৈরি হয়েছে অনেক বড় বড় বাড়ি, উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট। গ্রামের বা জেলাশহরের সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে মেয়েরা যাদের চাকরিসূত্রে বা পড়াশোনার জন্য কলকাতা যেতে হয় তারা কলকাতার পাশাপাশি সাধ্যমতো ফ্ল্যাট বা ভাড়াবাড়ি জোগার করতে না পেরে এখন ক্রমশঃ এই দিকেই চলে আসছে। রাজাহাটি জায়গাটা কলকাতা থেকে খুব একটা দূরে নয়। ট্রেনে বা বাসে ঘন্টা দেড়েক লাগে। আগে জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা ছিল। এখন ক্রমে ক্রমে ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠছে। গত কয়েকবছর ধরে একটা নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজাহাটির যারা পুরনো বাসিন্দা তাদের বেশিরভাগেরই নিজেদের বাড়ি, বাগান, জমি, পুকুর আছে। এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের জায়গা জমি প্রোমটারদের বিক্রী করে দিচ্ছে আর না হলে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করছে বহুতল আবাসন। চুক্তি অনুযায়ী নবনির্মিত আবাসনের কয়েকটি ফ্ল্যাট পাচ্ছে জমির মালিক। ফলে আগে যে পরিমাণ জমিতে একটি বা দু’টি পরিবার বাস করতো এখন সেই একই পরিমাণ জমিতে পঞ্চাশ-ষাটটি পরিবার। আমরাও রাজাহাটির পুরনো বাসিন্দা। বাজারের কাছেই রাস্তার ওপর দু বিঘা জমির ওপর তিনতলা বড় বাড়ি আমাদের। সঙ্গে লাগোয়া বাগান আর পুকুর। আমার জ্যাঠামশাই ছিলেন ডাক্তার।
রাজাহাটি বাজারে জ্যাঠামশাইএর ডাক্তারখানা ছিল। সেটা এখন ওষুধের দোকান করেছে আমার মেজদা অর্থাৎ জ্যাঠামশাই এর মেজছেলে। মেজদা এই বাড়িতেই থাকে। বড়দা অর্থাৎ জ্যাঠামশাই এর বড় ছেলেও ডাক্তার, থাকে লন্ডনে। বড়দাও দেশে এলে আমাদের রাজাহাটির বাড়িতেই ওঠে। বড়দার ঘর নিয়মিত পরিষ্কার করা হলেও তালা দেওয়া থাকে অন্যসময়। আমার বাবা ছিলেন রাজাহাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমরা দু’ভাই কলকাতায় চাকরি করি এবং ফ্ল্যাটে থাকি। আমরা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রাজাহাটি আসতাম। তখন বাবা-মা , জেঠু-জেঠিমা সবাই বেঁচে ছিলেন। কোভিডের সময় জেঠু-জেঠিমা দু’জনেই মারা যান। আর অতি সম্প্রতি বাবা চলে গেলেন। তারপর থেকে মা আমাদের কাছেই থাকেন। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার চাপও আস্তে আস্তে বেড়েছে। শনি-রবিবার গান-বাজনা, ছবি আঁকার ক্লাস করে রাজাহাটি আসা সবসময় হয়ে ওঠে না। তবে মা এবং আমাদের পরিবারের সকলেরই রাজাহাটির প্রতি একটা অদ্ভুত টান আছে। আসলে যখন আমরা স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের প্রকৃত অর্থে যৌথ পরিবার ছিল। আমাদের বাড়ির সবাই বাবার কড়া অনুশাসনে রাজাহাটি স্কুলেই পড়েছি। স্কুলের পরে সবাই কলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছি। শনি-রবিবার বাড়ি আসার আনন্দই ছিল অন্যরকম। তারপর জীবন যত এগিয়েছে রাজাহাটির সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়লেও টান এতটুকু কমেনি। সুখের কথা এই আকর্ষণ সংক্রামিত হয়েছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেও। কে জানে একেই হত বলে মাটির টান। মেজদা ছাড়াও রাজাহাটিতে পাকাপাকিভাবে থাকেন আমার ছোটকাকা। ছোটকাকা পড়াশুনায় বাবা বা জেঠুর মত অত ভালো না হলেও গ্রাজুয়েশন করে জুট মিলে কাজ করতো। বছরে তিন-চার মাস জুট মিল বন্ধ থাকত। কাকিমা আর ছেলে নিলুকে নিয়ে তিনজনের সংসার ছিল ছোটকাকার। রাজাহাটির মানুষজনের বোসবাড়ির প্রতি একটা সম্মান ছিল। বাবা আর জেঠুর কাছে গ্রামের লোকজন দরকারে অদরকারে আসত প্রায়ই। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বিপদ নামল হঠাত একদিন। ছোটকাকার জুট মিলে তখন লক-আউট চলছিল। ইউনিয়ন আর মালিকের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে লক-আউট উঠিয়ে নেওয়া হত প্রতি বছরই। কিন্তু সে বছর লক-আউট চলছিল একটু বেশি সময় ধরেই। সবাই আশা করছিল দেরি হলেও মিল নিশ্চয়ই খুলে যাবে। কিন্তু যে কোনও কারণেই রফা হলনা সেবার। মালিকপক্ষ নোটিস জারি করে মিল বন্ধ করে দিল পাকাপাকিভাবে। নিলু তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আকাশ ভেঙ্গে পড়লো ছোটকাকুর মাথায়। সারা বাড়িতে বিষাদের পরিবেশ। কয়েকদিনের মধ্যে জেঠু সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে ছোটকাকুর এবং তার পরিবারের দায়িত্ব আমাদের সকলের। বাবা এবং জেঠু বাড়ির সকলকে ডেকে পরিষ্কার বলে দিলেন যে কোনওভাবেই যেন এমন কিছু করা বা বলা না হয় যাতে কাকিমা এবং নিলু আঘাত পায়। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে কোনও ক্ষেত্রে যদি অগ্রাধিকারের প্রশ্ন ওঠে তাহলে কাকিমা এবং নিলুর অবস্থান সর্বাগ্রে। যদি কোনও জিনিস প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে তাহলে কাকিমা এবং নিলুকে তাদের প্রাপ্য পুরোপুরি দিয়ে যা বাকি থাকবে তা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে হবে। বেশ ভালোই কাটছিল আমাদের যৌথ জীবনযাপন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেও বা কর্মসূত্রে রাজাহাটি ছেড়ে যেতে হলেও আমাদের যৌথ পরিবারের অলিখিত বিধিনিয়ম আমাদের বেঁধে রেখেছিল এবং আজও বেঁধে রেখেছে। আমাদের রাজাহাটির বাড়িতে আজও একটাই রান্নাঘর।
সময় পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে রাজাহাটির মানুষদের যে ভালো হচ্ছে না সে কথা বলা যায় না। যে দোকানগুলো আগে খদ্দেরের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকতো তারা এখন খদ্দের সামলাতে পারেনা। আগে নিজেরা একাই দোকান চালাতো, এখন খদ্দেরের চাপে লোক রাখতে হয়েছে। দোকান বন্ধের পর বাড়ি বাড়ি জিনিসপত্র দিয়েও আসছে দোকানদারেরা। রাজাহাটির ছোট দোকানগুলোর বিক্রি-বাটা বেড়েছে। মেজদার দোকানেও বিক্রি ভালোই বেড়েছে। এখন সকাল ৯টা থেকে রাত্রি ১০টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। একটা ছেলে কাজ করছে দোকানে। সে থাকে ২টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। বিকালে সন্ধ্যায় খুব ভিড় হয়, মেজদা একা সামলাতে পারেনা। নিলুকে বলেছিল বসতে কিন্তু নিলু রাজি হলো না। নিলু সারাদিন খুব ব্যস্ত। ওর সঙ্গে দেখা হওয়াই মুস্কিল। কাকিমার কাছে যা শুনলাম তাতে যে চিন্তা একটু হচ্ছেনা তা বললে অন্যায় হবে। মেজদার সঙ্গেও একান্তে কথা বললাম। বুঝলাম মেজদাও বেশ চিন্তিত ব্যাপারটা নিয়ে। ওর হাতে নাকি বেশ ভালোই টাকাকড়ি আসছে। কাকা-কাকিমা স্বভাবতই বেশ খুশি। ওদের চোখে মুখে সেই খুশির ছায়া দেখেছি আমি। গত একবছর ধরে প্রমোটারদের হাতে বেশ কিছু জমি এসেছে। সেইসব জমিতে নির্মিত হচ্ছে বহুতল। লোকাল মিউনিসিপ্যালিটি আইনের তোয়াক্কা না করে প্রচুর প্ল্যান পাস করে দিচ্ছে বলে কানে আসছে। প্রথমে একজন ছোট প্রমোটারের কাছে কাজ করত নিলু। কাজ ছিল সিমেন্ট বালি লোহা যাতে সময়মতো পৌঁছে যায় তার দেখাশোনা করা। মূল কাজটা ছিল বিল্ডিং মেটেরিয়ালের দোকানদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আর ঠিক সময়ে সাইটে মালপত্র পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা। সব ঠিকই ছিল। যাই হোক কিছু পয়সা হাতে আসছিল। পড়াশুনায় খুব একটা মন ছিলনা নিলুর গোড়া থেকেই। কেমন যেন একটু বাড়িছাড়া ছিল ও। বেশিরভাগটাই পাড়ার ক্লাবে আড্ডা মেরে, ক্যারাম-ফুটবল খেলে কাটতো ওর।একটু আধটু বুঝিয়ে বলা ছাড়া কারুরই কিছু করার ছিল না। বকাবকি করা তো কাকা-কাকিমা ছাড়া কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাকা কাকিমা কিছু বলতো না বরং প্রশ্রয়ই দিত বলা যেতে পারে আর তারপর হাতে টাকা আসতে শুরু করার পর নিলুর প্রতি আদর অনেকগুন বেড়ে গেল কাকা-কাকিমার। আমরা কোনও কোনও সপ্তাহে বাড়ি গেলে ওকে দেখতেই পেতাম না। কাকিমা বলতো হয় ঘুমোচ্ছে আর না হয় কাজে বেরিয়ে গেছে। ভালো আছে এটুকু জেনেই খুশি থাকতাম আমরা কিন্তু চিন্তাটা মাথা থেকে গেলনা। সময় খারাপ। টাকার লোভে কিছুতে জড়িয়ে না পড়ে। চিন্তাটা আরও বাড়লো দু’মাস আগে।
আমি রাজাহাটি এলে বিকালবেলা একটু হাঁটতে বেরিয়ে পড়ি। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। সেদিন বিকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরতলীর সীমানা বেরিয়ে বিশাল চাষের মাঠটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই জায়গাটা ছোটবেলা থেকে আমার খুব প্রিয়। যখন স্কুলে পড়তাম প্রায়ই দৌড়ে এসে বিকালবেলায় এখানে দাঁড়াতাম। খুব একটা কাছে নয় তবুও ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসতে বেশ ভালোই লাগে আমার। পথে চেনা পরিচিত দু- একজনের সঙ্গে দেখাও হয়ে যায়। স্থানীয় লোকেরা এই দিগন্তবিস্তীর্ণ চাষের জমিকে ভূতের জলা বলে ডাকে। শোনা যায় অনেক অনেক কাল আগে এখানে নাকি ভূতের উপদ্রব ছিল। কিন্তু কেউ কোনওদিন সেই ভূতেদের দেখেছে বলে শোনা যায়নি। ক্রমশঃ লোকজন বুঝেছে ছোট ছেলেদের একা একা এতদূরে সন্ধ্যার পর আসতে ভয় পাওয়াবার জন্যই এই গল্প। এখন নামটা ভূতের জলা হলেও কেউ ভয় পায়না এদিকে আসতে। তারপর রাস্তায় অটো, টোটো, বাস, গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। বিদ্যুতের আলোয় সন্ধ্যার পরের গা ছমছম ভাব কবেই বিদায় নিয়েছে ভূতের জলা থেকে। দু’পাশে যতদূর দেখা যায় সবুজে সবুজ। দূরে দিগন্ত এসে মিশেছে মাঠে। লাল টকটকে অস্তগামী সূর্য ভেসে যাওয়া মেঘের গায়ে রঙ মাখাতে মাখাতে অদৃশ্য হয়ে যায় মাঠের ওপারে। তারপর গোধূলির আলোছায়ায় মায়াবী হয়ে ওঠে ভূতের জলা। মাঠের এই রূপ যারা একবার দেখেছে তারাই জানে এই ভূতের জলার টান। জনান্তিকে বলে রাখি ভূতের জলার সূর্যাস্তের আকর্ষণ আজও আমাকে বারে বারে টেনে আনে আনে এইখানে। গোধূলিশেষে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে ভূতের জলায়। আমি গুটি গুটি রওনা দিই বাড়ির দিকে। আমাদের বাড়ি পেরিয়ে একটু হেঁটে গেলেই বাজার। আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বড় রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই রায়েদের বাড়ি। ওদের বাড়ির ছেলেরা সবাই কলকাতাতেই থাকে। ছুটিছাটায় সপরিবারে রাজাহাটির বাড়িতে শুনেছি ঐ বাড়িটা রায়েদের ছেলেরা প্রোমোটারদের দিয়ে দেবে। একজনের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় পাকা। রায়েদের বাড়ির গেটের পাশে দু’তিনটে গুমটি আছে। ওরমধ্যে একটা পান-সিগারেটের দোকান। সবাই ওটাকে কানুর দোকান বলেই জানে। কানু মারা যাবার পর ওর ছেলে ছোটু ওটা চালায়। তারপাশেই তেলেভাজার দোকান। ওর মালিক ছিল পরীক্ষিৎ, উড়িষ্যার লোক। পরীক্ষিৎ মারা যাবার পর ওর পরিচিত একজন দোকানটা চালায় কিন্তু দোকানটা খুব একটা চলে না। তাছাড়া আজকাল বাজারে বেশ বড় বড় তেলেভাজা , সিঙ্গারার দোকান হয়েছে। তার পাশেরটা বাবুরামের জুতো তৈরি আর সারাইয়ের দোকান। বাবুরামের বাবা জীবনকাকুকে আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসতে দেখেছি ছোটবেলায়। তখন সকালে দিকে সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জুতো সারানো , জুতোপালিশের কাজ করতো জীবনকাকু। বিকালবেলা দোকান খুলতো। জীবনকাকু অর্ডারি জুতো ছাড়াও কিছু জুতো নিজের পছন্দমত তৈরি করে বিক্রীর জন্য দোকানে রাখতো। বিকালের পর দোকানে বসে জুতো তৈরি করতো জীবনকাকু। পুজোর আগে রাত্রি দশটা এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকত জীবনকাকুর দোকান। জীবনকাকু ছিল বাবার চেয়ে বয়সে একটু বড়। তবুও জ্যাঠামশাইকে বড়বাবু আর বাবাকে মেজবাবু বলে ডাকত। অনেক বুঝিয়েও বড়বাবুকে বড়দা আর মেজবাবুকে মেজদা করতে পারেনি জ্যাঠামশাই। বাবা কিন্তু জীবনকাকুকে জীবনদা বলে ডাকতো। বড়দা, মেজদা জীবনকাকু বলতো বলে আমরাও জীবনজেঠু না বলে জীবনকাকু বলেই ডাকতাম। বাবার কাছে শুনেছি জীবনকাকুর তৈরি করা জুতোর নাম জ্যাঠামশাই দিয়েছিলেন বাবুজুতো। জীবনকাকুর ছেলে বাবুরামের অন্নপ্রাশনের সময়। বাবুজুতো একসময় রাজাহাটের সাধারণ মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল। সস্তায় বেশ টেঁকশই জুতো ছিল বাবুজুতো। যদিও পুজোর সময় আমাদের সকলের কলকাতার বড় দোকানের জুতোই হত তবুও জীবনকাকার বাবুজুতো একজোড়া করে অর্ডার হত সকলের জন্যই। বাবা যতদিন ছিল ততদিন এই নিয়ম বহাল ছিল। জীবনকাকার পর দোকানের হাল ধরেছে বাবুরাম। বাবুরাম আমাদের ছোটবেলার খেলার সঙ্গী। পাড়ার মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাতেই বাবুরাম আমাদের সঙ্গে থাকত সবসময়। প্রায় সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে দাদাভাই বলে ডাকত আর নিলুকে ডাকত ভাই বলে। নিলু যখন খুব ছোট ছিল ওকে নিয়ে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে বেড়াত বাবুলাল। নিলুও খুব ন্যাওটা ছিল বাবুলালের। ওর সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্য খুব বায়না করতো ছোটবেলায়। তারপর বাবুলাল একটু রাস্তায় ঘুরিয়ে নিয়ে এলে তবে শান্ত হতো। জীবনকাকু কাজেকর্মে আমাদের বাড়ি আসত মাঝেমাঝে। বাবুলাল কিন্তু ছোটবেলা থেকেই প্রায় প্রতিদিনই কারণে অকারণে আমাদের বাড়ি ঘুরে যেত একবার। মা, জেঠিমা খুব স্নেহ করতো বাবুলালকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবুলালের ব্যবসাও পাল্টেছে। ও জীবনকাকার মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে জুতো সারাইএর কাজ করেনা। ও সকাল থেকেই দোকানে বসে। জুতো সারাই বা পালিশের জন্য ওর দোকানে যেতে হয়। নিজে জুতো তৈরি করা ছাড়াও প্লাস্টিক বা রবারের জুতো কিনে এনে দোকানে বিক্রি করে বাবুলাল। বাবুজুতোর বিক্রি এখন কমে গেছে। ছোটবড় অনেক জুতোর দোকান এখন রাজাহাটির বাজারে।
রায়বাবুদের বাড়ির পাশের গলি দিয়ে এগিয়ে রায়বাবুদের পাঁচিলের পর থেকেই রাজাহাটির বস্তি এলাকা। ঐ রাজাহাটি বস্তিতেই বাড়ি বাবুরামদের। অনেকদিনের পুরনো বস্তি। আমরা খেলতে খেলতে বাবুরামদের বস্তিতে চলে যেতাম। ওদের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় কতবার জীবনকাকু আমাদের দাঁড় করিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে সুজি বিস্কুট এনে আমাদের হাতে দিয়েছে তার হিসাব নেই। সেসব দিন কোথায় চলে গেছে। এখন সবই স্মৃতি। বস্তির বাড়িগুলোর ছাদে ডিস অ্যান্টেনা আর এসির আউটডোর ইউনিট ছাদে উঠলেই দেখা যায়।
রাজাহাটিতে এলে সন্ধ্যাবেলা ঘুরতে ঘুরতে বাবুলালের দোকানে এসে অন্তত ঘন্টাখানেক তেলেভাজা-চা সহযোগে গল্প করা আর রাজাহাটির খবরাখবর নেওয়া আমার বহুকালের অভ্যাস। বাবুরামও বলে আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য মুখিয়ে থাকে সে। সেদিনও হাঁটতে হাঁটতে বাবুরামের দোকানে গিয়ে বসলাম। এটা ওটা কিছু গল্প করার পর বাবুরাম বললো,’ দাদাভাই, অনেকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো বলে বলতে পারছি না। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে এখন আর না বললেই নয়।‘ আমি বললাম,’ এত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে। কী হয়েছে বল আমাকে।‘ ভাবলাম হয়ত টাকা পয়সা নিয়ে কিছু সমস্যায় পড়েছে কোনও কারণে। বাবুরাম বললো,’ তুমি কিন্তু কাউকে কিছু বলবে না। বলবে না যে আমি তোমাকে বলেছি।‘ আমি বললাম,’ কী হয়েছে বাবুরাম? খুব সিরিয়াস কিছু মনে হচ্ছে।‘ও বলল,’ হ্যাঁ, কথাটা নিলুর ব্যাপারে।‘আমি অবাক হয়ে বললাম,
-নিলুর ব্যাপারে? কী হয়েছে?
-তুমি নিশ্চয়ই এতদিনে জেনেছো যে নিলু প্রোমোটারদের সঙ্গে কাজ কারবার করে। তুমি জানো কি না জানিনা মন্ডলদের বড় ছেলে অশোক এখন কেরোসিনের ব্যবসা ছেড়ে প্রোমোটারি করছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রোমোটার এখন। প্রচুর পয়সা করেছে। ওর কাছেই এখন কাজ করে নিলু। অশোক মণ্ডল পরের বছর মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে দাঁড়াবে। রুলিং পার্টির সঙ্গে খুব দহরম মহরম। এলাকার এম এল এ, এম পি দের সঙ্গে বেশ মাখামাখি। থানা পুলিশেও ভালো যোগাযোগ। রায়বাবুদের বাড়িটা ওকেই দেবে বলে কথাবার্তা প্রায় পাকা। কিন্তু অশোক এখনও ফাইনাল কথা দেয়নি। বাড়ির পিছনের লাগোয়া আমাদের বস্তিটা দখলের চেষ্টা করছে অশোক। বস্তিটা হাতে এলে তাহলে রায়েদের বাড়ি আর বস্তি মিলিয়ে সামনে মল আর পিছনে ফ্ল্যাট বানানোর প্ল্যান আছে ওর। রায়েদের জায়গাটা মল বানানোর জন্য একটু ছোট তাই বস্তিটা ওর খুব দরকার। বস্তি দখলের জন্য বাড় বাড়ি গিয়ে টাকা অফার করছে ওর লোকেরা। আমার কাছেও এসেছিল বাড়ি আর গুমটির জন্য কত চাই জানার জন্য। আমি মুখের ওপর না বলে দিয়েছি। আমার মত আরও অনেকেই ঘর ছাড়তে রাজি নয়। যা টাকা দেবে বলছে তাতে এককামরার ফ্ল্যাটও হবে না। অনেকে বলেছে টাকা চাইনা বদলে রাজাহাটিতে এককামরার ৩৫০-৪০০ স্কোয়ার ফিটের ওয়ান বি এইচ কে ফ্ল্যাট , চব্বিশ ঘন্টা জল আর আলোর ব্যবস্থা করে দিলে তারা বস্তি ছেড়ে যেতে পারে। এই নিয়ে একটা চাপা উত্তেজনা আছে বস্তিতে।
-বাবা, এত কান্ড! বলিসনি তো আগে। কিন্তু নিলু কী করেছে?
-নিলু আশোকের হয়ে বস্তির ঘরে ঘরে যাচ্ছে। বোঝাচ্ছে , না মানলে হুমকি দিচ্ছে। বলছে ভালো কথায় না শুনলে ভুলভাল কেসে ফাঁসিয়ে দেবে। নিলুর সঙ্গে এলাকার কিছু গুন্ডা বদমাইসদেরও দেখা যাচ্ছে। তোমাদের বাড়ির ছেলে বলে বস্তির লোকেরা এখনও কিছু বলেনি। ঘরদোরে হাত পড়লে ওরা কিন্তু কাউকে ছাড়বে না। আমারও কিন্তু নিলুর কথাবার্তা , ব্যবহার ভালো লাগছে না। দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় টিটকারি করে, আজে বাজে কথা বলে। তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে আছি। রুটিরুজি, থাকার জায়গায় হাত পড়লে কিন্তু আমিও ছেড়ে কথা কইবো না। তোমরা লক্ষ্য করেছো কিনা জানিনা নিলু কিন্তু অনেক পাল্টে গেছে। তোমাকে সবকথা মন খুলে বলছি। তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে বলো। বলতে খারাপ লাগছে কিন্তু সব দেখে জেনেও তোমাদের আগে থেকে সাবধান না করা খুব অন্যায় কাজ হয়ে যাবে, দাদাভাই।
সব শুনে চিন্তা খুব বেড়ে গেল। যেটা মনে মনে আশঙ্কা করছিলাম অবশেষে সেটাই সত্যি হলো। একদিকে নিলুর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অন্যদিকে বাড়ির মান-সম্মান সব মিলিয়ে নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছিলাম না। নিলুর ভালোমন্দ কিছু ঘটে যাওয়ার আগে একটা কিছু তো করতেই হবে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে কাকা-কাকিমার ঘরে কড়া নাড়লাম। কাকাকে বলে ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম,’ কাকা, নিলু কোথায়? একটা জরুরি দরকার ছিল।‘
-নিলু এখনও ফেরেনি। রাত্রে ফিরতে দেরি হয়।
-আমি কাল সকালে বেরিয়ে যাব। সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ দেখা করা যেতে পারে?
-না, ওতো অনেক রাত্রে ফেরে। দেরিতে ওঠে। তাই অত সকালে দেখা করা যাবে না।
ওর সঙ্গে আমার কথা বলাটা কাকা এড়িয়ে যেতে চাইছে বুঝতে পেরে ঠিক করলাম ব্যাপারটা কাকাকে বলে যাই। বললাম,’ তোমরা দু’জনেই আছো তাই কথাটা তোমাদেরই বলে যাই। নিলুকে বললেই হয়ত ভালো হতো। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হবে না তাই।‘
কাকিমা বললো,’ কেন? কিছু জরুরি দরকার ছিল? আমাদের বলে যা, আমরাই বলে দেব।‘ বললাম,’ না, দরকারটা আমার নয়। নিলুর ভালোর জন্যই বলছি। আজকে বাজারে শুনলাম রাজাহাটি বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে একটা গোলমাল বাঁধতে চলেছে। আশোক নাকি ওখানে বড় একটা প্রজেক্ট করবে। দেখ ও সব প্রমোটার, সিন্ডিকেটের ব্যাপার। পার্টি, প্রশাসন ওদের সঙ্গে আছে। নিলুও শুনলাম কিছু বাজে ছেলেপুলের সঙ্গে বস্তিতে যাতায়াত করছে। আশোকের হয়ে তদ্বির করছে, ভয় দেখাচ্ছে। তোমাদের কানে এসেছে কি না জানিনা। তবে আমার শুনে ব্যাপারটা ভালো লাগলো না তাই ভাবলাম নিলুকে একবার জিগ্যেস করে দেখি ব্যাপারটা কী।‘ কাকা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,’ আসলে কী জানিস এখন অশোকের সঙ্গে কাজ করে ভালো টাকা রোজগার করছে নিলু। ওরা বুঝেছে ও কাজের ছেলে।অশোক তো বলেছে এই মলের প্রজেক্টটাতে ওকে পার্টনার করে নেবে। বস্তিটা খালি করার দায়িত্ব ওকেই দিয়েছে। টাকাকড়ি দিয়ে ওরা যাতে ভালো জায়গায় গিয়ে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করার জন্য বলেছে ওকে। পার্টির লোকেরা বলেছে বস্তির লোকেদের পুনর্বাসন দেবার জন্য যা সাহায্য দরকার ওরাও করবে। এটাতো ভালো কাজ। কিন্তু নিলুর রোজগার বাড়া কিছু লোকের সহ্য হচ্ছে না। তাই তারা ওর নামে এখানে ওখানে বদনাম করে বেরাচ্ছে। লোকগুলো নিজেরাও কিছু করবে না আবার অন্য কেউ কিছু করলে বলতেও ছাড়বে না। ওসব কথায় কান দিসনা তুই।‘ বুঝলাম বলে কোনও লাভ হবে না। কাকা-কাকিমাকে ভুল বুঝিয়েছে নিলু। ঝুঁকির ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে। নিলু কি বুঝতে পারছে না যে ওকে পয়সার লোভ দেখিয়ে সামনে ঠেলে দিয়েছে ওরা? কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে কাকা ডেকে বললো,’ কিন্তু তোকে কে এত কথা বললো? তুই কী করে এতসব জানলি?’ আমি উত্তর দেবার আগেই কাকা ঝাঁঝিয়ে উঠলো।‘ বলতে হবে না। আমি জানি ঐ মুচির বাচ্ছাটা বলেছে। ওটাই নাটের গুরু। বস্তির লোকেদের ওই খ্যাপাচ্ছে। গুমটি ভেঙে দোকান করেছে। ভাবছে এই সব করে দোকান বাঁচাতে পারবে। দোকান ওকে ছাড়তেই হবে। এক নম্বরের নিমকহারাম একটা।‘ আমার মনে হলো আমার কানে কে যেন গলা লোহা ঢেলে দিচ্ছে। আর একমুহূর্ত দাঁড়াতে পারলাম না আমি। কাকার এরকম চেহারা আমি আগে কোনওদিন দেখেনি। কাকার মুখের ভাষা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অর্থের লোভ মানুষকে কোথায় নামিয়ে আনে আজ নিজের চোখে তা দেখলাম। কেবলমাত্র টাকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে নিলুর যে কোনও বিপদ হতে পারে সে কথা ভাবতেও পারছে না কাকা-কাকিমা। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে গেল আমার। সেদিন সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারলাম না আমি।
তারপর কলকাতায় এসে এক মাস কেটে গেল। নানা কারণে রাজাহাটি যাওয়া হয়নি। সেদিন হঠাত লাঞ্চের সময় বাবুরামের ফোন এলো। বেশ চিন্তিত হয়েই ফোনটা ধরলাম। বাবুরাম বললো,’ দাদা, পারলে এক্ষুনি রাজাহাটি চলে আসুন। এলে সব বলবো।‘ ফোনটা রেখে দিল বাবুরাম। আমার মন কিছুতেই মানছিল না। বাবুরামকে তিন চারবার ফোন করে অবশেষে পেলাম। বুঝতে পারছি মুখে হাতচাপা দিয়ে কথা বলছে। তাড়াহুড়ো করে যা বললো তা সংক্ষেপে হলো এই যে আজকে নিলু সকালে দলবল নিয়ে বস্তিতে গিয়েছিল। হুমকি দিয়ে এসেছে আজ রাত্তিরের মধ্যে বস্তি খালি না করলে কাল সকালে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বস্তি। রায়বাড়ি আর সামনের গুমটিও ভেঙে ফেলা হবে কাল সকালে। এই নিয়ে বস্তিতে অসন্তোষ চরমে। ওরাও ঠিক করেছে বস্তির গলির মুখে রাস্তা অবরোধ করবে ওরা। প্রশাসনের থেকে কথা আদায় করে তবেই অবরোধ তুলবে। বাবুরাম ভয় পাচ্ছে যদি কোনও ভাবে নিলু অবরোধকারী বস্তির লোকেদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা আছে। বস্তির লোকেরা নিলুর ওপর বেশ ভালোই ক্ষেপে আছে। সুযোগ পেলে ওরা কিন্তু কিছু একটা ঘটিয়ে দিতে পারে। ওদের হাতে ছুরি, পিস্তল দেখেছে বাবুরাম। শুনে হাড় হিম হয়ে গেল আমার। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা তো যায়না। অফিসে সেকেন্ড হাফ ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়ে সব বুঝিয়ে বেরিয়ে গেলাম রাজাহাটি। বিকালের একটু আগে রাজাহাটি পৌঁছে দেখি বাজার রণক্ষত্রের চেহারা নিয়েছে। লোকজন থিকথিক করছে। সামনের রাস্তা অবরোধ করেছে বস্তির লোকেরা। লোকজন দৌড়াদৌড়ি করছে। বুঝলাম সামনে একটা বড়সড় ঝামেলা হচ্ছে। সামনের রাস্তা বন্ধ। গাড়িগুলো আটকে গেছে। রাজাহাটির রাস্তাগুলো আমি হাতের চেলোর মতো চিনি। গাড়িটা বাজারের ডান দিকে একটা গলির মধ্যে দিয়ে ঘুরপথে গিয়ে ভূতের জলার পাশে রেখে দৌড়ে এসে ভিড় ঠেলে একটু এগিয়ে দেখি বস্তির লোকেরা রাস্তা অবরোধ করে বসে আছে। আর তার ঠিক পাশেই গলির মুখে দু’পক্ষের তুমুল বচসা। কোনও পুলিসের দেখা নেই। বাবুরামের দোকান বন্ধ। ভিড়ের মধ্যে বাবুরামকে খুঁজে পেলাম না। কাদের মধ্যে বচসা হচ্ছে দেখার জন্য ঠেলেঠুলে আর একটু যেতেই দেখলাম একদিকে নিলু আর তার দলবল, অন্যদিকে বস্তির ছেলেরা। গলার শিরা ফুলিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় চিৎকার করছে আর হুমকি দিচ্ছে নিলু। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। বস্তির ছেলেগুলোও ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে তেড়ে তেড়ে আসছে নিলুদের দিকে। তারই মধ্যে নজরে পড়লো বস্তির একটা ছেলের হাত পকেটের মধ্যে আর্দ্ধেক ঢোকানো। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হাতে ধরা আছে পিস্তল। পিস্তলের খানিকটা দেখা যাচ্ছে হাত আর পকেটের মাঝখানে। ভালো করে দেখে মনে হলো আরও কয়েকজনের হাতে কিছু না কিছু আছে। কারও হাত পিছনে লোকানো, কারও হাত গেঞ্জি দিয়ে আর্দ্ধেকটা ঢাকা। ভয়ে আমার বুক উড়ে গেল। সামনে এত ভিড় যে কাছে গিয়ে এক ঝটকায় নিলুকে টেনে নিয়ে আসবো সে উপায় নেই। যে কোনও মুহূর্তে কিছু ঘটে যেতে পারে। রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কয়েক মিনিট কেটে গেল এইভাবে। হঠাৎ দেখলাম ভিড়ের মধ্যে কোথা থেকে বাবুরাম প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিলুর ওপর। নিলু কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওকে এক ঝটকায় মাটিতে চিত করে শুইয়ে ওর বুকের ওপর চেপে বসলো বাবুরাম। বাবুরামের চোখ দুটো লাল টকটক করছে। দুটো চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মুখটা লাল, ঘর্মাক্ত, চোয়াল দুটো চেপে বসেছে একটার ওপর আরেকটা। ওর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রাণ উড়ে গেল আমার। ওর হাতে একটা চওড়া ছুরি, ফলাটা ধারালো, চকচকে। এক ছোঁয়ায় কন্ঠনালী দুভাগ হয়ে যাবে। ছুরিটা ধরা ওর শক্ত হাতে, নিলুর গলায় প্রায় ঠেকিয়ে। একটু হাত কাঁপলেই অবধারিত রক্তপাত এবং মৃত্যু। মৃত্যু নিশ্চিত এবং আসন্ন বুঝতে পেরে ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে নিলু। মুখটা কাগজের মত ফ্যাকাসে। শ্বাস প্রশ্বাস স্থির। মৃত্যুভয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে নিলু। ভয়ে আমার বুক কাঁপছে। হাত দিয়ে নিজের চোখ চেপে ধরেছি আমি। নিলু মাটিতে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর দলবল বাইকে চেপে চম্পট দিয়েছে। বুঝেছে ব্যাপারটা সুবিধের নয়। প্রাণভয়ে নিলুকে ফেলে পালাবার আগে একটুও ভাবেনি ওরা। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। সমস্ত জায়গাটা নিস্তব্ধ। কারও মুখে কোনও শব্দ নেই। রদ্ধশাস পরিস্থিতি। এমনি করে প্রায় একমিনিট কাটার পর এক প্রচন্ড চিৎকারে চোখ খুলে দেখি হাতের ছুরিটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে নিলুর দু’দিকে দুই পা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে হাউ হাউ করে কাঁদছে বাবুরাম। মনে হচ্ছে কী যেন ভর করেছে ওর শরীরে। ভয়ে কেউ ওর ধারে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে না। এমনি করে খানিকক্ষণ থাকার পরে হাত দু’টো নামিয়ে মাথা নামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে বাবুরাম পাথরের মূর্তির মতো। অবধারিত মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসে বিস্ময়বিস্ফারিত স্থির চক্ষুতে বাবুরামের দিকে তাকায় নিলু। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে ও সত্যিই জীবিত। কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পায় সে। সামনে দন্ডায়মান জীবনদাতার দিকে কৃতজ্ঞ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে বসে বাবুরামের পা দু’টো জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিলু। ওর ঘন চুলের মধ্যে নিজের আঙুলগুলো পরমস্নেহে ডুবিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বাবুরাম। স্পষ্ট দেখলাম ওর যে দু’টো চোখ থেকে আগুন ছিটকে বেরোচ্ছিল কিছুক্ষণ আগে সে চোখদুটো থেকে বেরিয়ে আসছে এক অপূর্ব দ্যুতি। দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে এক জ্যোতিষ্মান পুরুষ যার শরীর থেকে নির্গত জ্যোতিতে ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর। মায়াবী আলোয় ভরে উঠেছে রাজাহাটির আকাশ। বাতাসে ভেসে আসছে অমৃতবাণী -এই মৃত্যুর অন্ধকার সত্য নয়, সত্য সেই জ্যোতি যা যুগে যুগে মোহের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আসছে। যুগে যুগে মানুষ অজ্ঞানের ভিতর থেকে জ্ঞানকে পাচ্ছে, যুগে যুগে মানুষ পাপকে, মলিতাকে বিদীর্ণ করে পুণ্যকে আহরণ করছে। বিরোধের ভিতর দিয়ে সত্যকে পাচ্ছে, এ ছাড়া সত্যকে পাবার আর-কোনো উপায় মানুষর নেই। । ভয় কোরো না, অন্ধকার সত্য নয়, মৃত্যু সত্য নয়, তোমাদের অমৃতের অধিকার। মৃত্যুর কাছে দাসখত লিখে দিয়ো না। প্রবৃত্তির হাতে আত্মসমর্পণ করে অমৃতত্বের অধিকারকে অপমানিত কোরোনা।
গোধূলির রাজাহাটি তখনও বিস্ময়ের ঘোরে নিস্তব্ধ। আমি আস্তে আস্তে ভিড় কাটিয়ে ভূতের জলায় গিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সূর্যাস্তের এই পবিত্র নৈঃশব্দ জীবনের এক অন্য অর্থ বহন করে নিয়ে এলো আমার কাছে। ধানক্ষেতের ওপারে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে স্থানুর মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই। অনুভব করছিলাম প্রতিটি সূর্যাস্তই জন্ম দেয় এক নতুন সূর্যোদয়ের সম্ভাবনার।
ঐ ঘটনার পর দীর্ঘদিন রাজাহাটি যাইনি। ঐ ভয়ঙ্কর মানসিক আঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে নিলুর প্রায় ছ’মাস লেগেছিল। ঐ সময়ে বাবুরাম ওকে আক্রমণ না করলে কী যে হত কে জানে! বাবুরাম জানতো কি না জানিনা কিন্তু আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম অন্তত তিন-চার জন পিস্তল উঁচিয়ে সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বাবুরাম রাজাহাটি ছেড়ে চলে গেছে। ওখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে সোনারহাট বলে একটা জায়গায় থাকে এখন। একটা দোকানঘর ভাড়া নিয়ে আগের মতোই জুতোর ব্যবসা করে। রাজাহাটি বস্তি যেমন ছিল তেমনই আছে।
[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]
খুব ভালো লাগলো। শেষের দিকে একটা চমক আছে। তবে বস্তিটার আগের অবস্থায় থেকে যাওয়াটা এখনকার পরিস্থিতিতে খাপ খাচ্ছে না।