কীর্তন এক বিশেষ ধরণের লোকসংগীত । অভিধানগত অর্থে ‘গুণবর্ণনা’ , ‘যশঃপ্রচার’। এর ইতিহাস দীর্ঘ । চর্যাপদ থেকে শুরু করা যায় তাহলে এর ইতিহাস প্রায় হাজার বছর । আর যদি গীতগোবিন্দ থেকে শুরু করা হয় তাহলে প্রায় ৮০০ বছর। শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের আগে কীর্তন ছিল গণ-বিনোদনের একটি অঙ্গ । সব সময় এর মধ্যে ভক্তিভাব প্রকাশ পেত না । নরনারী প্রেমই ছিল মূখ্য।

কীর্তন সম্রাজ্ঞী ছবি বন্দোপাধ্যায়

‘শ্রীচৈতন্যদেবই কীর্তনকে জনসংযোগের একটি বিশেষ এবং সার্থক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন । তাঁর কীর্তন ছিল ‘নামকীর্তন’ ও ‘নগরকীর্তন’ । কীর্তন , সংকীর্তন ও নামকীর্তনের মধ্যে কীর্তন গানই বেশি মাত্রায় ভক্তিমূলক’। ‘ হৃদয় আবেগের অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম এই কীর্তন গান । এতে রয়েছে বহু প্রকারের তাল ও মাত্রার সমাবেশ । রাগাশ্রায়ী কীর্তন এক বিশেষ ধারা । এই উচ্চাঙ্গ কীর্তনে প্রায় একশো আট রকমের তাল ব্যবহৃত হয় । ‘কীর্তনের সুরে প্রাণ মেতে ওঠে , শব্দের ঝঙ্কারে চিত্ত মুগ্ধ হয়’।
হাজার বছরের এই কীর্তনের ইতিহাসে যে তিনজনের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় । এঁদের একজন অবশ্যই ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দু’জন যথাক্রমে রথীন ঘোষ এবং রাধারানী দেবী। রথীন ঘোষের গানে রাগের ব্যবহারের কিঞ্চিৎ আধিক্য লক্ষিত হয়। এখনকার প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে এঁরা সবাই গুরুতূল্য।
ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৪ সালের ৬ অক্টোবর । দক্ষিন কলকাতার যতীন দাস রোডে । বাবা নলিনী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে । বাবা ছিলেন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী , স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং জনপ্রিয় সমাজসেবী । মা অমলা দেবীর কাছে তাঁর গানের হাতে খড়ি । মায়ের গান সহজেই শিখে নিতে পারতেন তিনি । ‘আলবার্ট হলে’ আয়োজিত এক সভায় সরোজিনী নাইড়ু সহ বিশিষ্ট জনের সামনে উদ্বোধনী গান পরিবেশন করেছিলেন ছোট্ট ছবি । কমলা গার্লস স্কুলে পড়াশুনা । পরে নবদ্বীপ চন্দ্র ব্রজবাসী এবং রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে দীর্ঘদিন কীর্তন এবং রাগাশ্রায়ী গানের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন । কৌশোরে আলাপ হয়েছিল আনন্দময়ী মায়ের সঙ্গে । তাঁরই দেওয়া রাধামাধবের যুগল মূর্তিকেই আজীবন সঙ্গী করে নিয়েছিলেন । মায়ের কাছে দীক্ষা নিয়ে ব্রহ্মচর্যের পথে ব্রতী হলেন । ‘গানই ছিল তাঁর পূজা ও সাধনা । গান ছিল তাঁর মন্ত্র , পূজার উপকরণ ও নৈবেদ্য । পূজা এবং কীর্তনই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান । অনেকগুলি বাংলা ছায়াছবিতে কীর্তনাঙ্গ ও অন্যান্য ভক্তিগীতি পরিবেশন করেছেন । ‘রাইকমল’, ‘ত্রিযামা’ , ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ , ‘মহাপ্রভু’, ‘ঠাকুর হরিদাস’ , ‘নদের নিমাই’ , ‘শ্রীরাধা’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সংগীত বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন এবং পরে ওখান থেকেই সাম্মানিক ডক্টোরেট লাভ করেছিলেন । ২০১২ সালের ২৩ মে দক্ষিণ কলকাতার এক নার্সিং হোমে তাঁর জীবনাবসান হয়। এ বছর তাঁর জন্ম শতবর্ষ ।
৯ মার্চ ২০২৪ শনিবারের বসন্ত বিকাল তিনটায় ‘গীতশ্রী কীর্তন সম্রাজ্ঞী ড. ছবি বন্দোপাধ্যায় শতবর্ষ স্মরণ অনুষ্ঠান’ নিবেদিত হল গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের শিবানন্দ হলে । আয়োজনে ছিলেন ‘গীতশ্রী ছবি বন্দোপাধ্যায় শতবর্ষ স্মরণ কমিটি’ ও ‘টেগোর সোসাইটি কলকাতা’ । সঞ্চালক তাপস চৌধুরি তাঁর চমৎকার বাচিক ভঙ্গিমায় শ্রোতাদের সমগ্র অনুষ্ঠানসূচি জানিয়ে আহ্বান জানালেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী সুপর্ণানন্দ মহারাজ-জীকে । মহারাজ-জী বাংলা সংগীতে কীর্তনের বিশেষ স্থানকে মনে করিয়ে দিলেন এবং ছবি বন্দোপাধ্যায়ের অনন্য অবদানকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করলেন । প্রকাশ করলেন স্মরণগ্রন্থ ‘নও শুধু ছবি’ এবং ‘এ মোর নিবেদন’ নামক একটি মিউজিক কার্ড । এই কার্ডে রয়েছে ছবি বন্দোপাধ্যায় গীত অশ্রুত রবীন্দ্রসঙ্গীত , অতুলপ্রসাদী , দ্বিজেন্দ্রগীতি , রজনীকান্তের গান , ভজন , শ্রীরামকৃষ্ণের ভালোলাগা গান এবং কীর্তন সংকলন ।
প্রথমেই গান পরিবেশনের জন্য এলেন অধুনা আমেরিকা প্রবাসী মন্দিরা সরকার । উনি ১৮ বছর ধরে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছেন । জানালেন ‘উনি ছিলেন একদিকে স্নেহময়ী মাতার মতন , আরেক দিকে কড়া একজন শিক্ষিকা । ছিলেন অতি নীতি পরায়ণ । বলতেন যে ‘গানের কথা এবং ভাব, এই দুয়ের বন্ধন হলে তবে তা গান হয়ে ওঠে’। গান ছিল তার পূজা । আনন্দময়ী মার ভক্ত ছিলেন এবং তাঁর কাছে যাবেন বলে অনেক অনুষ্ঠানের অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন । এটি একেবারেই সহজ কাজ ছিল না । প্রথমে শোনালেন ‘ অখন্ড মঙ্গলা কারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম / তদপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ’। দ্বিতীয়টি ‘ও… মা পতিত পাবনি’ গঙ্গে । তৃতীয়টি রজনীকান্তের ‘তুমি আবার অন্তঃস্থলের খবর জান’। এবং শেষ গানটি ছিল ‘দেখে এলাম তারে সই দেখে এলাম তারে / এক অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে’। বেশ ভাল নিবেদন।
শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক প্রশান্ত ঘোষ প্রথমে শোনালেন ‘প্রভু, তোমার লাগি আঁখি জাগে ; দেখা নাই পাই পথ চাই , সেও মনে ভালো লাগে’। ভরাট গলায় গান শুনতে ভাল লেগেছে । দ্বিতীয় গানটি শোনানোর আগে উনি জানালেন যে এই গানটি শাপমোচন গীতিনাট্যের গান । অনুশীলনের সময় স্বয়ং শান্তিদেব ঘোষ এসে বলেছিলেন শুনো হে বাপু, এই গান এক বিশেষভাবে গাইতে হবে । প্রশান্ত বাবু ওই বিশেষ গায়কীতেই শোনালেন ‘ তুমি কি কেবলই ছবি , শুধু পটে লিখা / ওই-যে সুদূর নীহারিকা ‘। এই নিবেদন সত্যিই এক অনন্য মাত্রা ছুঁতে পেরেছিল।
মিলি চক্রবর্তী জানালেন, ‘তিনি যেদিন গান শিখতে যেতেন তাঁর মন এক অনির্বচনীয় আনন্দে ভরে যেত’। শোনালেন প্রথমে ‘ডুব ডুব ডুব ডুব সাগরে আমার মন’ এবং দ্বিতীয়টি ‘আমি কি হেরিনু মধুর মূরতি’। পরিবেশনটি যথাযথ ছিল।
এরপর গান পরিবেশন করলেন ইন্দ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় , অংশু সেন , অমৃতা মুখোপাধ্যায় , অরিজিৎ মৈত্র , গার্গী দাস বক্সী ।
অমৃতা মুখোপাধ্যায় প্রথম নিবেদন ছিল একটি অতুলপ্রসাদের গান ‘বধূ ক্ষণিকের দেখা তবু, তোমারে ভুলিতে পারে না আঁখি’। দ্বিতীয়টি ‘বঁধু তোমার গরবে গরবিনী আমি , রূপসী তোমারি রূপে’। তাঁর সুরেলা গলা এবং মরমী গায়কী গানগুলিকে শ্রুতিমধুর করে তুলেছিল । তাঁর নিবেদনের গভীরতা অনবদ্য , মন ছুঁয়ে গেছিল ।
এরপরে লং প্লেয়িং রেকর্ডে ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯৪১ সালে রেকর্ড করা গান বাজিয়ে শোনালেন সংগ্রাহক রতন চন্দ । গানটি ‘মম অন্তর মন্দিরে নিত্য বিরাজ’ । তৈরি হয়েছিল অসাধারণ এক পরিবেশ। যেমন সুরেলা গলা, তেমনি তার নিবেদন । পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ অধীর আগ্রহে শুনেছিলেন এই সুমধুর গান ।

কীর্তন পরিবেশনায় সুমন ভট্টাচার্য


সর্বশেষ শিল্পী ছিলেন সুমন ভট্টাচার্য। শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবনের অধ্যাপক। শোনালেন কীর্তন গানের ইতিবৃত্ত। বললেন ‘চর্যাপদে রয়েছে পটমঞ্জরী রাগ । কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে যে প্রচলিত রূপ আছে সেটিরই বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত । কারণ তা গুরু পরম্পরায় কন্ঠ থেকে কন্ঠে প্রবাহিত হয়েছে’ । শোনালেন প্রথম গান , ‘যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু , এবার এ জীবনে / তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে’। গানের মাঝে মাঝেই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন শ্রোতাদের । জানালেন শ্রী চৈতন্যদেব আটটি গান বেঁধেছিলেন । লিখেছেন শ্রীরূপ গোস্বামী । গাইলেন ‘মরিব মরিব সখি , নিশ্চয় মরিব / আমার কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব?’ তবে তিনি যখন ‘কৃষ্ণ নাম লিখে দিও অঙ্গে আমার’ এই গানটি পরিবেশন করছিলেন , তখন তাঁর নিবেদনে বহু শ্রোতার পক্ষে চোখের জল আটকে রাখা সম্ভব হয় নি। শোনালেন শ্রীরাধার পায়ে লিখে দেওয়া কানুর চিঠিখানির কথা । শোনালেন ‘দাসখৎ’ শব্দটির বিশেষ ব্যাখ্যা । তাঁর সর্বশেষ নিবেদন ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ওহে জীবনবল্লভ , ওহে সাধনদুর্লভ , আমি মর্মের কথা অন্তরব্যথা কিছুই নাহি কব- / শুধু জীবন মন চরণে দিনু বুঝিয়া লহো সব’।
অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেও এই গানগুলির রেশ রয়ে গেছিল অনেকক্ষণ । আজও যেন মনকে অন্য এক ভুবনে নিয়ে চলে যায় । আশা করা যায় সারা বছর ধরেই আরও অনেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে এমন এক মহান ‘সাধিকা গায়িকা’ ছবি বন্দোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষ ।
তথ্যঋণ
১) বঙ্গীয় লোকসংগীত কোষ
২) নও শুধু ছবি – শতবর্ষ স্মরণগ্রন্থ – টেগোর সোসাইটি কলকাতা

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
5 months ago

খুব ভালো লাগলো। অভিনন্দন।