কানাইলাল জানা


আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্নাতকোত্তর ডাক্তারি পড়া মহিলা ডাক্তারকে নৃশংসভাবে খুন ও ধর্ষণকান্ডে সিবিআই গত সপ্তাহের গোড়ায় (সেপ্টেম্বর ‘২৪) প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে দুর্নীতিকান্ডে গ্রেপ্তার করলে বোঝা গেল মূল বিষয় বিশ বাঁও জলে। এই সময় জামাল-দার একটি পোস্ট এল ফেসবুকে: ‘আমাদের কাজ এখন কবিতা লেখা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পড়া বন্ধ রেখে বিষয়টার ওপর নজর রাখা।’ কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করা যাবে যখন মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং স্বয়ং সিবিআই কেউ চান না অপরাধীরা ধরা পড়ুক। যা হচ্ছে লোক দেখানো।

তার ওপর আমার আছে গাছে জল দেওয়া, আসন্ন চাষবাসের প্রস্তুতি সবার ওপরে বাংলাদেশ সফর। রংপুর বইমেলার নিমন্ত্রণে যাওয়া হয়নি, ঈদের সময় বন্ধুপ্রতীম খুলনা জেলা কারাধ্যক্ষ রফিকুল কাদের ছুটি নিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজার ঘোরাবেন যাওয়া হয়নি। তাই ভিসাকাল শেষ হওয়ার আগে এবার যাওয়া। বাড়ির প্রবল বাঁধা কারণ সীমান্তে কড়াকড়ি ও বাংলাদেশের অস্থিরতা। তবুও গেলাম এবং এতো সহজ ছিল এবারকার যাওয়া যে সকাল সকাল উঠে গাছে জল দিয়ে, উঠোন ঝাঁট দিয়ে, স্নানপর্ব সেরে, মেট্রোরেল ও ট্রেন ধরে পেট্রাপোল ও বেনাপোল পেরিয়ে তাঁর পাঠানো গাড়িতে করে যশোর শহরকে বাঁয়ে রেখে ঝিকরগাছা হয়ে ফসলভরা সবুজ মাঠ দেখতে দেখতে ভায়া কেশবপুর মোড়ে বড় বড় গাছের আড়ত ছুঁয়ে যশোর -খুলনা প্রশস্ত ও ঝকঝকে সড়ক দিয়ে ঝলমলে খুলনা শহরে যখন এলাম বেলা আড়াইটা। অধ্যক্ষ সাহেব আমার অপেক্ষায় বসে আছেন খাবার বেড়ে। কী খাবার: ট্রে ভর্তি ইলিশ ভাজার সারি, বাটি ভর্তি খাসি মাংস, কাতলা মাছের ঝোল, নানা তরকারি, ফুলের মতো সাদা ভাত, প্লেটের পর প্লেট ভর্তি মরসুমি ফল, দই ও মিষ্টি গোটা টেবিল জুড়ে! খাইয়ে লোক নই তবু খেলাম এক গোছা ভাজা ইলিশ। খেতে খেতেই দুতিন জন স্টাফকে বলছেন: ‘আমার অতিথিকে দেখবে তাঁর একটি টাকাও যেন খরচ না হয়।’ এমন কথা তো আগুনে পুড়বে না, জলে ভাসবে না, হাওয়ায় উড়বে না কেবল হৃদপুকরে টুব্ করে ডুবে যাওয়া ছাড়া।


দুয়ারে প্রস্তুত একটি গাড়ি এবং একটি বাইক। বিকেলে রওনা দিলাম খুলনার ফুলতলার দক্ষিণডিহি। রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি। মামাবাড়িও কারণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও শ্বশুরবাড়ি এটি। বাংলাদেশ, সাফদেশ ও বিদেশের জন্য পৃথক প্রবেশ মূল্য। আমার প্রবেশ মূল্য কতো দেখতে দিলেন না আমার পাইলট আবুল বাশার। সব সময় যুক্তিপূর্ণ কথা বলেন।
মোট সাত একর জমি। বেদখল কিছু জমি বাদ দিলে সমস্তটা অতি সুন্দর করে সাজানো। নানা স্মারক দিয়ে গোছানো বাড়িটি এতো ভাল আছে যে এখনো বাস করা সম্ভব। যদিও আমরা জানি জোড়াসাঁকোতেই বিয়ে হয়েছিল রবির সঙ্গে ফুলতলার ফুলি তথা ভবতারিণীর। গোধূলি বেলায় চমৎকার কাটলো সময়টা। ট্রি-হাউস ঘিরে ফুটে আছে কতরকমের ফুল! নানা নাম এক একটি বাগানের….

দুদিন পরে গেলাম কবিগুরুর পূর্ব পুরুষদের ভিটা ‘পীঠাভোগ’ গ্রামে। ভৈরব নদীর উত্তরে পিঠাভোগে কুশারি বংশের দুটি বাড়ি বর্তমান আছে। অরুণ কুশারির পরিবার ও তাঁর জ্যেঠতুতোদাদা গোপাল কুশারির বসবাস। দুপাশে।আমরা জেনেছি এই বংশের জগন্নাথ কুশারি কলকাতার কাছে গঙ্গার ধারে গোবিন্দপুরে বসবাস শুরু করেন যখন শহর গড়ে ওঠেনি। তীরে ভেড়া জাহাজের কর্মী ও আশপাশের নিম্নবর্গের লোকজন বাহ্মণ ভেবে ‘ঠাকুর’ ডাকতে ডাকতে কুশারিরা হয়ে গেলেন ঠাকুর।
বাংলাদেশ সরকার আদিবাড়ির প্রবেশ পথে সুন্দর তোরণ করে দুটি বাড়ি বানিয়ে নানা স্মারকে সুসজ্জিত করে রেখেছে। মনে হল ৫ ই অগাস্ট২৪ শের পর দর্শক কম এসেছেন। অপরিষ্কার উঠোনে দেখলাম অরুণবাবু গরুর গা ধোয়াচ্ছেন। কুশারিদের বাধাঁনো ঘাটের দিঘি ও বিশাল বাগান বাড়ি কিনে নিয়েছে মোবারক রহমান। কুশারিদের মূল বাড়ি ভাঙা হয়েছে ১৯৯৫ সালে। পাওয়া গেছে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রদর্শিত হয়েছে ভেতরের ঘরে।


রাস্তার বেরিয়ে আড্ডা হল গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাঁরা জানালেন পিঠাভোগে অর্ধেকের কিছু বেশি হিন্দু। মিলেমিশে শান্তিতে আছেন আপাতত। পাশেই কালীমন্দিরে তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা। সকলে মাতবেন উৎসবে।
এক সময় কুশারিদের সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িরও বনিবনা ছিল না যখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শুরু করেন নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা। পিঠাভোগ থেকে চলে যাওয়ার পেছনেও ছিল কুশারিদের মধ্যে কলহ ও জমি জায়গা নিয়ে বিবাদ। যে বিবাদের পরিণতি ঠাকুরবংশে এমন যুগন্ধর পুরুষমহিলাদের জন্ম ভাবা যায়না। বাঁশবনসহ ঘন গাছপালায় ভর্তি গ্রামখানি ছায়া ঢাকা এবং বড়ই মনোমুগ্ধকর। দুদন্ড সময় কাটালে যে আরাম পাওয়া যায় তা ভোলা যাবে না কখনোই…

[পরম্পরা ওয়েবজিন, নভেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]