সাগরদাঁড়ি-র দত্তবাড়ি

অনেক দিনের ইচ্ছে বাংলাদেশ গেলে যশোরের সাগরদাঁড়ি গিয়ে কপোতাক্ষ নদ এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত-র বাড়ি দেখব। কিন্তু সে দেখা যে বাংলাদেশের ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে সম্ভব হবে ভাবিনি। প্রত্যেক দিন স্বচ্ছন্দে বেড়িয়েছি সঙ্গী বন্ধু রফিকুল কাদেরের দেওয়া আবুল বাশার। বিভিন্ন জায়গায় নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে কিন্তু বোঝার উপায় নেই। বাড়ি ফেরার দিনই আজকের দেখা। খুলনা- সাতক্ষীরা জাতীয় সড়কে বেশ কিছুটা গিয়ে কুমিরা মোড় থেকে সোজা উত্তরে কেশবপুর উপজেলায় সাগরদাঁড়ি। পথের দু’ধারে নানা ফসলে সবুজের অভিযান। যদিও সকল মাঠঘাট আরো বৃষ্টির প্রত্যাশায়। এখনো পাট চাষ হয় নিবিড় ভাবে। রাস্তায় রাস্তায় পাটের আঁশ ও পাটকাঠির বিপুল সমাবেশ। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তেই দৌড়ে এলেন তরুণ গৃহস্বামী যদি দরদাম করি। পাটের দর কিন্তু এখনো আছে বাংলাদেশে। এবার এদেশে কিন্তু একটি অভিযোগ পেলাম: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষে জয়ী ভারতীয় সেনারা নাকি জুটমিলের যন্ত্রাংশ খুলে ভারতে নিয়ে গেছেন! আমার অবশ্য জানা ছিল না কী উত্তর দেব?

মধু কবির জন্মভিটে এতদিন সুরক্ষিত আছে সরকারিভাবে। এখনো খোলেনি গেট। এগিয়ে গেলাম নদীর দিকে। ফর্সা ও দোহারা কপোতাক্ষে তীব্র স্রোত। ফর্সা বলছি এই কারণে যে পশ্চিম বঙ্গের গাইঘাটা থেকে দেখেছি কচুরিপানায় ভর্তি নিশ্চল কপোতাক্ষকে। এখানে আছে যাত্রীবাহী ডিঙি নৌকোর মুহুর্মুহু খেয়া পারাপার। ওপারে সারসা। জোয়ার -ভাটায় মহিমান্বিত ১৮০ কিমি দীর্ঘ কপোতচক্ষুর মতো স্বচ্ছ জলের কপোতাক্ষ তিতাস বা ইছামতী নদীর মতোই একাধিক শাখায় বিভক্ত। এই শাখাটি ভৈরব নদী থেকে বেরিয়ে পড়েছে শিবসা নদীতে। ছবিতে মাইকেল মধুসূদনের মূর্তিটি বাড়ির মধ্যে নয়, নদীর কাছে কারণ তাঁর স্বপ্নে কপোতাক্ষ আজন্ম সজীব: ‘সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে। সতত তেমার কথা ভাবি এ বিরলে,… বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে ?’ নদীর পাড়ে আছে আড়াইশ বছরের সেই কাঠবাদাম গাছটি যার তলায় তাঁবু গেড়ে মধুকবি বাস করছিলেন কয়েক দিন পিতার মৃত্যুর পর। বাবার ত্যজ্যপুত্র, বাড়িতে থাকতে চাননি, দেখতে চাননি চিরঅভিমানী জননীর আরও অশ্রু ঝরুক।
বেশ বড় এলাকা পিতৃভূমিসহ তাঁর জন্মভিটে। চারপাশ ঘেরা এলাকায় বিশাল দিঘি। দিঘির চারপাশে আম জাম কাঁঠালসহ নানা দামি বৃক্ষ। আছে পিতা রাজনারায়ণ দত্তের কাছারি, হলঘর, কোঠাবাড়ি, ঠাকুর দালান, দরবার হল, গোলাপ বাগান। টানা হলঘরে সাজান আছে মাইকেলের সারা জীবনের নানা স্মৃতি: ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, মাদ্রাজ, কলকাতা ও হুগলির যে যে বাড়িতে বাস করেছেন তার ছবি ও এবাড়ির পালঙ্ক ইত্যাদি। দেখা হল ঠাকুর দালানে আসন্ন দুর্গোৎসবে মূর্তি তৈরিরত মৃৎ শিল্পী এবং মহাকবি-র বংশধর উজ্জ্বল দত্তের সঙ্গে। উজ্জ্বল আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন এবং খুব খাতির করলেন। এখনো যোগাযোগ রেখে চলেছেন। জানালেন সম্প্রতি ঝড়ে উপড়ে পড়েছে সেই বাদামগাছ। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছেন লিয়েন্ডার পেজ। তাঁর পরিচয়: মাইকেল মধুসূদন ও হেনরিয়েটার ছেলে অ্যালবার্ট নেপোলিয়ন। তাঁর ছেলে মাইকেল লরেন্স ডটন। তাঁর মেয়ে জেনিফার পেজ ও ভেস পেজের ছেলে লিয়েন্ডার পেজ। উজ্জ্বল জানালেন ১৯৮২ সালে জেনিফার পেজ একবার সাগরদাঁড়ি এসেছিলেন কিন্তু লিয়েন্ডার পেজ কখনো আসেননি। তাতে কি? মাইকেল মধুসূদন যেমন আধুনিক ভারতের প্রথম মহাকবি লিয়েন্ডার পেজ তেমনি টেনিস অলিম্পিকে দেশের প্রথম পদক প্রাপক…
বাড়ি ফিরে ফোন পেলাম যশোর থেকে অনুপম ইসলামের। আমি বাংলাদেশ গেছি জানলে তিনি বাড়িতে নিয়ে যেতেন, যখন অধীর আগ্রহে চোখে চোখে রাখছি সমগ্র বাংলাদেশকে ঠিক কেথায় গিয়ে থিতু হয়। আর প্রার্থনা করছি হাঁসের পালক থেকে যেমন ঝরে পড়ে অপ্রয়োজনীয় জল তেমনি সে দেশের গা থেকে চলকে পড়ুক লাগামছাড়া অস্থিরতা…

[পর্ব ১]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]