বইমেলা শেষ৷ কলকাতা জুড়ে এখন নাট্যমেলার সমারোহ৷ এই অবসরে জানাই ভাল লাগা একটা নাট্য প্রযোজনার কথা ৷ কিছুদিন আগে পৃথ্বীশ রানার পরিচালনায় দক্ষিণ দমদম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রর “বাদাবন” নাটকটা দেখে আলোড়িত হয়েছি এর বিষয়বস্তুর বহুস্তরীয় বুনন দেখে৷ সুন্দরবনের জল-জঙ্গল-রুক্ষজীবনের বাস্তবে একদিকে যেমন ঝুমুর, দক্ষিণ রায় পাঁচালী, পালাগান সহ সরস শিল্পজীবনের প্রবাহ , অন্যদিকে তেমনই মরিচঝাঁপির উচ্ছেদ ও হত্যাকান্ডের মতো ভদ্রজনসমাজের বেইমানির ঘটনার বিরুদ্ধে হাঘরে বাদাবনবাসীর চোখে- জ্বালা-ধরানো ক্ষোভ-অভিমানের ইতিবৃত্ত৷

এই দুইয়ের মাঝে বোনা এর কাহিনি পরিসর৷ দক্ষিণ রায়ের পালা বাঁধিয়ের দল, জল জঙ্গলের মানুষ, স্থানীয় রাজনীতির লোক, বাদাবন দেখতে আসা টুরিস্ট কিংবা শুটিং পার্টিকে টুপি পরিয়ে টু পাইস ইনকাম করা ফড়ে সবাই মিলে হৈ হৈ করে ঠাঁই পেয়ে গেছে সেই কাহিনির ভেতরে৷ আর বাদাবন কাঁপিয়ে মাঝে মাঝেই হুংকার ভেসে এসেছে স্বয়ং দক্ষিণরায়ের৷ দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার৷ বাঘ যেভাবে একই সঙ্গে প্রতীক ও বাস্তব হয়ে ওঠে এই নাট্য প্রযোজনায় তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়৷ নির্দেশক পৃথ্বীশ রানা একদল নবীন অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে কি বিপুল পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন নাচে-গানে-আলোয়-বাজনায় মুখরিত এই প্রযোজনার বিশাল ক্যানভাস তা দেখে আশ্চর্য হয়েছেন হল ভরা দর্শক৷ হততালি পড়েছে বার বার৷ আলো আর মঞ্চ এ নাটকে অবাক করে দিয়েছে আমাদের৷ অন্ধকারকে আলোর পিঠে বসিয়ে কি করে এত রঙিন আর অর্থবহ করে তোলা যায়, মঞ্চবস্তুর স্থান অল্পসল্প বদলে নিয়ে কি করে বিরাটের ব্যঞ্জনা তৈরি করা যায় , তা যেন আরও একবার দেখিয়ে দিল বাংলা থিয়েটার৷
নির্দেশক পৃথ্বীশ রানার সঙ্গেই বলতে হয় নাট্যকার সুদীপ সিংহের কথাও৷ সরাসরি রাজনীতির কথা আজকাল আমরা এড়িয়ে যাই সাধারণত! কিন্তু অনেকদিন পরে আমাদের তথাকথিত বামপন্থী মানস চেতনায় অস্বস্তিকর এক কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকা মরিচঝাঁপি প্রসঙ্গটি শিল্পের শর্ত মেনেই কাহিনি কাঠামোয় তুলে এনেছেন সুদীপ৷ কাহিনির রস কিছুমাত্র খন্ডিত হয় নি এতে৷ দময়ন্তী দত্তর ‘পদে পদে রান্না’ বইতেও যে মরিচঝাঁপির সৌন্দর্যময় আপ্যায়ন বর্ণনা পেয়েছিলাম আমরা, তাতে সেই স্বপ্নদ্বীপটির সমবায়ের মাধুর্যময় রূপটা ফুটে উঠেছিল হঠাৎ ঝলকে৷ কিন্তু কেন্দ্র আর প্রান্তের চিরন্তন দ্বন্দ্ব পরিণাম এক্ষেত্রেও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল মরিচঝাঁপিকে৷ ভাসিয়ে দিয়েছিল মৃত মানুষের শব৷ বাদাবনের বাঘ পেয়েছিল রক্তের স্বাদ৷ আপনাকে সেলাম সুদীপ৷ এই ভাবে ভাবতে পেরেছেন আপনি, ভাবাতে পেরেছেন আমাদের৷


নবীন পরিচালক, নবীন এক শিল্পীদল, ঘামে ঘুঙুরে বাজিয়ে তুলে আমাদের অবাক করে দিয়েছেন এই পালায়৷ শুধু একটা কথা, কাহিনিটি চূড়া স্পর্শ করার পর ডিনাওমেন্ট অংশের নাচ গান কি একটু বেশি সময় নিচ্ছে? ভেবে দেখতে পারেন নির্দেশক৷ তবে আমরা বার বার দেখতে যাব এই প্রযোজনা৷ দর্শকজনকেও এই গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনা দেখতে অনুরোধ করি৷

অনলাইনে সংগ্রহ করতে, ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন
0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Sourav Howlader
Sourav Howlader
7 months ago

আজ বাদাবন দেখলাম। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরেছি। প্রতিটি কুশীলবের কী অসম্ভব পরিশ্রম আর নিষ্ঠার ফসল, এমন একটি উপস্থাপনা হয়, না দেখলে উপলব্ধি করা যায় না। নাট্যকলার সব কটি বিভাগে দক্ষতার প্রয়োগ, বিস্মিত করে রাখে। নাটকের বিষয়বস্তু ও তার প্রেক্ষিত ভাবনাকে উসকে দেয়। অনেকদিন পর্যন্ত এর রেশ থেকে যাবে।

প্রযোজনার সাথে যুক্ত সব সদস্যকে আমার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।

গৌতম দাশ
গৌতম দাশ
7 months ago

আলোচনা খুব ভালো হয়েছে।