পঞ্চম পর্ব – সিয়ান দেখে ইয়াংসি নদীর ক্রুজে

সকাল সকাল উঠে আবার মালপত্র গুছিয়ে হোটেল চেক আউট করলাম। এই হোটেলটা এত ভালো ছিল যে ছেড়ে যেতে মন চায় না। কিন্তু মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই- ব্রেকফাস্ট খেয়ে লবিতে এসে দেখি লিলি এসে গেছে। মালপত্র গাড়িতে তোলা হল। লিলি বলল, আমরা প্রথমে যাব দশ কিলোমিটার দূরে এক জায়গায়- নাম ওয়াইল্ড গুজ প্যাগোডা। সেটা দেখা সাঙ্গ হলে তোমাদের চ্যাংচিং যাওয়ার স্টেশনে তুলে দেব। ওখানে গাড়ী ও গাইড থাকবে- গাইডের নাম ওয়েন্ডি। এই বলে ওয়েন্ডির ফোন নাম্বার ও ওয়েন্ডি স্টেশনের কোথায় দাঁড়াবে, তার একটা ফটো আমাদের দেখাল, আমি সেটার একটা ছবি তুলে নিলাম। যেখানে কেউ কাউকে চিনি না, ভাষা জানি না, সেখানে ফটো বিরাট অবলম্বন।
যাচ্ছি ওয়াইল্ড গুজ প্যাগোডার দিকে, লিলিকে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, এরকম অদ্ভুত নাম “ওয়াইল্ড গুজ” কেন?
লিলি বলল, সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম- অনেককাল আগের কথা, তখন বুদ্ধদেবের অনুগামীদের মধ্যে দু রকম খাদ্যাভাস ছিল- একদল ছিলেন নিরামিষাশী আর অপর দল ঘোর আমিষ। ঘুরতে ঘুরতে ঐ দল যখন এখানে আসেন, প্রচন্ড ক্ষুধার্ত , কোথাও খাবার পাচ্ছেন না, তখন ওনারা বুদ্ধের নাম স্মরণ করে বলেন, হে বুদ্ধদেব, তোমার যদি আমাদের প্রতি দয়া থাকে, একটু খাবার যোগাড় করে দাও। সে মুহূর্তে দেখা যায়, আকাশ থেকে একটি হাঁস নেমে আসছে আর সেই হাঁস পড়ল দলের মাঝে। সবাই বুঝল, এটা ভগবান বুদ্ধর দান, আমরা খাবার চেয়েছিলাম বলে উনি নিজেই হাঁসের রূপ ধরে এসেছেন। কাজেই খাওয়া তো দূরের কথা, ওনারা ভক্তিভরে হাত জোড়া করে দাঁড়ালেন। এরপর থেকে বাকিরাও নিরামিষাশী হয়ে যান। আর ওনার এই মাহাত্মের জন্য পরে যখন এখানে প্যাগোডা হয়, নাম হয় ওয়াইল্ড গুজ প্যাগোডা।
সেটা ৬৩৫ সালের কথা- লিলি বলে চলল, জুয়ান সাং ( Xuan Zang) বলে এক চৈনিক পরিব্রাজক বুদ্ধদেবের অনুগামী ছিলেন, উনি বুদ্ধদেবের ওপর আরো জানতে ও বুদ্ধধর্মর ওপর প্রবল জ্ঞান পিপাসা মেটাতে ভারতে যান। বহু পরিশ্রমে তিন বছর ধরে যাত্রা করে উনি ভারতে আসেন। ওখানে বহু বছর থেকে, সতেরো বছর পর উনি আবার চীনে ফিরে আসেন- সঙ্গে নিয়ে আসেন অনেক উপহার সামগ্রী, অজস্র পুঁথি, বুদ্ধর মূর্তি। তখন চীনের সম্রাট ছিলেন তাং সাম্রাজ্যের গাও জং (Gao Zong)। ওনাকে অনুরোধ করতে, উনি এই জায়গাটা দেন আর এখানে গড়ে ওঠে এই প্যাগোডা। প্রথমে এই প্যাগোডা পাঁচতলা থাকলেও পরে আরো দু তলা বাড়ানো হয়।
আমরা ইতিমধ্যে এসে গিয়েছি। লিলি বলল, প্যাগোডা দেখার আগে উল্টোদিকের তাং ডাইনেস্ট্রির সময়কার বিভিন্ন কবিদের স্ট্যাচু ও খোদাইকরা কবিতা দেখে নাও। একটা দুটো নয়, অজস্র স্ট্যাচু পরপর লাইন দিয়ে সাজানো। এছাড়া অনেক ফোয়ারা, চাইনীজ লণ্ঠন সব মিলে এ যেন এক আলাদা জগৎ।
এদিকটা দেখার পর রাস্তা পার হয়ে এলাম প্যাগোডা দেখব বলে। বিশাল এলাকা- প্রথমেই হচ্ছে মঙ্কদের থাকার জায়গা, তারপর আছে সুউচ্চ প্যাগোডা, বাগান, আছে অজস্র ছোট ছোট মন্দির টাইপ, একটায় হিন্দু দেব শিবের মূর্তি আছে। আছে প্রার্থনা গৃহ। পুরো জায়গা জুড়ে আছে বাগান আর তাতে অনেক অনেক গাছ, ফুলে ভর্তি । বিভিন্ন ফুল আর তাদের বিভিন্ন রঙ মন ভরিয়ে দিল।

চিত্র-৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮

ঘন্টা দুই প্যাগোডা দেখার পর লিলি জানাল, এবার তোমাদের যাওয়ার সময় আসন্ন। ট্রেন দুপুর একটার আগেই। প্যাগোডা থেকে ট্রেন স্টেশন সিয়ান বাই বা নর্থ সিয়ান বেশীদূর নয় – আধ ঘন্টায় পৌছে গেলাম। লিলি আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে ট্রেন টিকিট বের করে আনল- এবারে আর বিজনেস ক্লাসের মজা নেই- ফার্স্ট ক্লাশ। দুজন দুজন করে সীট, অনেকটা লেগ স্পেস আর সীটগুলোও চওড়া। একটা কোচে ২৬ টা করে ফার্স্ট ক্লাস সীট, কাজেই আরামে বসা গেল।


চিত্র-৪৯

১২-৫২ তে ট্রেন ছাড়ল, এটাও বুলেট ট্রেন, কাজেই ঝটাঝট তিনশো কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে উঠে গেল ট্রেন । পৌছাবে বিকাল পৌনে ছটায় – এই পাঁচ ঘন্টার পথে খান ছয় স্টেশনে ট্রেন থামবে। প্রায় হাজার কিলোমিটার রাস্তা। দু পাশে অজস্র ক্ষেত, সবুজে সবুজ হয়ে আছে। মাঝে মাঝে এক একটা শহর আসছে। তারপর আবার সবুজে মোড়া ক্ষেত।
কোথায় লাঞ্চ খাবো ভাবছিলাম, কিন্তু দেখলাম ট্রেনের ডাইনীং কার থেকে খাবার নিয়ে ট্রলি আসছে। জনে জনে জিজ্ঞাসা করছে কার কি প্রয়োজন। অনেক কষ্টে ছবি দেখিয়ে বোঝানো গেল যে চিকেন চাই- সে মিলও পেলাম- সিজালিয়ান চিলি চিকেন ও স্টিকি রাইস। খেতে ভালোই- আরাম করে খানিকটা খেয়েছি হঠাৎ মনে হল জিব অসাড় হয়ে যাচ্ছে। ভাতে তো জিব অসাড় হয় না, বুঝলাম চিকেনেই কিছু আছে, যা জিব অসাড় করে দিচ্ছে। পরে জেনেছিলাম চীনে “সিজালিয়ান পেপার কর্ণ” বলে এক মশলা ওরা রান্নায় ব্যাবহার করে স্বাদের জন্য, তাতেই জিব ও ঠোঁট সাময়িক অসাড় হয়ে যায় অভ্যাস না থাকলে। যদিও সেটা মিনিট পনেরোর বেশি থাকে না। ইতিমধ্যে ডোরা ইন্টারনেট থেকে বের করে ফেলেছে কালপ্রিট কে আর চিকেনের সস থেকে বের করে সেটা দেখালো ও- গোল মরিচের ছোট সংস্করণ। এই সামান্য দানা দানা, তার এতো তেজ? পরে চীনে অনেক রান্নাতেই ওগুলো পেয়েছি আর আবিষ্কার করা মাত্র ওগুলো তুলে ফেলে দিয়েছি।
গদীওলা সীটে আরামে বসে আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ট্রেন চলে এলো চোংচিং (Chongqing)
ট্রেন থেকে নেমে পাসপোর্ট স্ক্র্যান করে বেরিয়ে লিলির ফটো অনুযায়ী নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার পথেই দেখলাম এক সুবেশী চৈনিক তরুণী আমার নাম লেখা বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে – এ হলো ওয়েন্ডি। স্টেশনের বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল- একই রকম বিরাট ছ সীটের গাড়ি। ওয়েন্ডি বলল, এখান থেকে আধ ঘন্টা লাগবে ক্রুজ পোর্ট। কিন্তু একটা প্রবলেম হয়েছে, ক্রুজ এখান থেকে, মানে চোং চিং পোর্ট থেকে ছাড়ছে না, ছাড়বে তার ২০০ কিলোমিটার দূরে ফেংডুর থেকে।
-এরকম কেন? আমরা অবাক, ফেংডু তো কাল সকালে ক্রুজ বোটের পৌছানোর কথা- চোংচিং থেকে ছেড়ে।
ওয়েন্ডি বলল, ক্রুজ কোম্পানি জানিয়েছে ইয়াংসি নদীতে জলের লেভেল অত্যন্ত কম, তাই ফেংডুর পর বোট আর ঢ়ুকতে পারছে না। চিন্তা নেই ক্রুজ কোম্পানি তোমাদের পৌছে দেবে ফেংডু- তার জন্য ওরা বাস রেখেছে।
একটু হতাশ লাগল, দুশো কিলোমিটার বোট জার্নি এক ধাক্কায় কমে গেল- কি জানি- ইয়াংসি নদীর কত নাম শুনেছি, তার জল কি এতোই অপ্রতুল?
ক্রুজ পোর্টে এলাম। আমাদের ক্রুজ কোম্পানির নাম ভিক্টোরিয়া আর বোটের নাম ভিক্টোরিয়া সাব্রিনা। ভিক্টোরিয়া কোম্পানির লোকেরা আমাদের সুটকেশগুলো নিয়ে নিলো, বলল, একদম জাহাজে পৌঁছে পাবে। আবার এক প্রস্থ সিকিউরিটি চেকের পর উঠলাম ওদের বাসে। পঞ্চাশ সীটের বাস, খুব ছোট নয়, আরামে বসা গেল। বাসে ওঠা মাত্র একটা করে স্ন্যাক্স এর প্যাকেটও দিল, বলল, আড়াই ঘন্টার রাস্তা, রাত নটা নাগাদ ফেংডু পৌছে যাব।

ততক্ষণে সন্ধ্যা নামছে। বাস শীঘ্র মোটরওয়ে ধরল। একশো কিলোমিটার স্পীডে বাস ঝড়ের গতিতে চলেছে। দু পাশে নিকষ অন্ধকার, কাজেই বাইরে দেখার কিছু উপায় নেই। চোখ দুটো একটু লেগে গিয়েছিল- বাস থামতে বুঝলাম এসে গেছি ফেংডু।
বাস থেকে আমরা নামলাম। পথপ্রদর্শক এক তরুণী- ভিক্টোরিয়া কোম্পানির, হাতে লাল পতাকা, বলল, আমার পিছন পিছন এস। চেয়ে দেখি প্রায় তিন চারশো ফুট দূরে ইয়াংসি নদী, বিরাট চওড়া কিন্তু জলের লেভেল অনেক নীচে – চিকমিক করছে জলের রূপালী রেখা আর মাঝনদীতে অপেক্ষা করছে বোট। নদীর পাড় থেকে সিঁড়ি। দীর্ঘ সিঁড়ি- নামছি তো নামছিই আর এগুচ্ছি মাঝ নদীর দিকে। প্রায় শ খানেক সিঁড়ি নামার পর অনেকটা জলের ওপর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে এলাম বোটের প্রবেশ পথে। কিন্তু এটা আমাদের বোট নয়। এই বোট দিয়ে ঢুকে বেরুলাম অন্য আর একটা বোটে। মানে পরপর খান চারেক বোট লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের বোট ছিল তিন নাম্বারে। পথ প্রদর্শক বললেন, আমরা আমাদের বোটে এসে গিয়েছি, এটা লোয়ার ডেক। তোমরা এখানে চেক ইন করো তারপর মালটা দেখিয়ে দাও – মাল ওখানে রাখা আছে, কেবিন বয় পৌছে দেবে।


চিত্র-৫০

চেক ইন হয়ে গেল ফটাফট। পাসপোর্ট দেখানো, যত-সামান্য সার্ভিস চার্জ দেওয়া (কেননা বাকিটা দেওয়া আছে), সাথে সাথে ঘরের খান তিনেক কি কার্ড পাওয়া গেল। সুটকেশগুলো চিহ্নিত করে দিলাম আর ঘরেও পেয়ে গেলাম সাথে সাথে।
বোটটি ভালোই- খান ছয়েক ফ্লোর – আমরা আছি পঞ্চম ডেকে, তার ওপরে হচ্ছে বার কাম রেস্টুরেন্ট আর সবার ওপরে ওপন ডেক। কেবিনটি যথেষ্ট বড়ো –তিনখানা সাদা ধপধপে বিছানা পাতা- সাথে আছে বিরাট এক প্রাইভেট ব্যালকনি। ঘরে বসে মালপত্র সুটকেশ থেকে খুলে বের করছি- দরজায় নক, কেবিন বয় বলল, সেফটি ব্রীফ চলছে- ওপরে যেতে হবে।
ওপরে গিয়ে দেখি চীনা ভাষায় সেফটি ব্রীফ চলছে। আমরা কজন বোকার মত মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি কি করবো ভেবে পাচ্ছি না, বাঁচালো জাহাজের টুর ম্যানেজার টম। টম বলল, ইংলিশ স্পোকেন জনা আটেক আছেন, তাদের আমি আলাদা ব্রিফিং দিচ্ছি। তোমরা এখানে বসো, আমি বাকিদের খুঁজে বের করছি।
সোফায় বসলাম- এক এক করে আরো তিনটে পরিবার এল। ফ্রান্স থেকে আসা এক দম্পতি, নর্থ ইংল্যান্ড থেকে আরো দু জন আর বাকিরা ইউরোপেরই অন্য কোনো দেশের।
সেফটি ব্রিফিং এর পর খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। আজ রাতে বোট এখানেই থাকবে, কাল ফেংডুতে কনডাকটেড ট্রিপের পর বোটের চলা শুরু হবে। ফেংডু ছেড়ে বোট যাবে ইচিং (Yichang), রাস্তা প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার।
পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল, দেখি ইয়াংসি নদীর বুকে যেন শুয়ে আছি। কাল রাতে যখন এসেছিলাম, আমাদেরবোটের পর আরো একটা বোট ছিলো, তাই সব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এখন তা উন্মুক্ত। টলটলে শান্ত নদীর জল- রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। এককালে এই নদী ছিল অত্যন্ত খরস্রোতা- বিশেষ করে বৃষ্টি হলে নদীর জল উপছে পড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রতি বছর বন্যায় প্রচুর লোকসান হতো। তাই এই নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়- বিশাল বাঁধ- নাম থ্রি গর্জেস ড্যাম। এখন এই নদীর জল চীনের চাষ বাসের প্রধান ভরসা। এখান থেকে বেজিং প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার- কিন্তু এই বিরাট দৈর্ঘ্য জুড়ে খাল কাটা আছে যাতে এই জল ব্যাবহার করা যায় বিভিন্ন কাজে। আর, এই বাঁধের পর নদী আজ রুগ্ন। নদীর গভীরতার এক তৃতীয়াংশ মাত্র জল।
আজ আমাদের ট্রিপে নিয়ে যাবে ক্রুজ থেকে- শুরু হবে সকাল সাড়ে আটটা। যাবো মাউন্ট সুয়ানগুই (Mount Shuanggui) , কাজেই সকাল থেকে সাজো সাজো রব। বোটের অধিকাংশ যাত্রীই চাইনিজ, আছেন বেশ কিছু প্রবাসী চাইনিজ আর আছেন মুষ্টিমেয় কিছু বিদেশী। চান টান করার সময় নেই, সোজা তৈরি হয়ে ব্রেকফার্স্ট এর টেবিলে। আমাদের টেবিল আটজনের- সেই কালকের সেফটি ব্রিফিং এর ইংরাজী বলা লোকজন। দুজন অতি শান্ত ও সুন্দরী চৈনিক মেয়ে আমাদের টেবিলের ওয়েট্রেস। খাওয়া বাফে স্টাইল, কিন্তু জল, চা, কফি যা লাগবে, ঐ দুই মেয়ে তার দায়িত্বে। এ ছাড়া প্লেট তোলা, টেবিল সাফ রাখা- এ সব এদের নিষ্ঠা ভরে করতে দেখেছি। এরা অল্পসল্প কিছু ইংরাজি জানে, আর তাই দিয়েই কাজ চালিয়ে দিচ্ছে। জলখাবারে বিভিন্ন অপশন থাকলেও আমরা কঙ্গি(ভাতের পরিজ), ডিম, ব্রেড আর ফল এতেই সীমাবদ্ধ রাখলাম। সাড়ে আটটায় খাওয়া সাঙ্গ হতে চলে গেলাম লোয়ার ডেকে- দেখি টম অপেক্ষা করছে হাতে বোর্ড নিয়ে। আমাদের ইংরাজি গ্রুপে আমরা আটজন তো আছিই , এছাড়া আমারিকা, সিঙ্গাপুর প্রবাসী চাইনিজ পরিবার সহ সব মিলে জনা কুড়ি। টম আমাদেরকে লোকাল গাইড লিনডার হাতে সমর্পণ করল। লিনডার হাতে উঁচু করে ধরা পতাকা- বলল, আমার পিছন পিছন এস।
বোট থেকে বেরিয়ে নদীর ওপর কাঠের প্ল্যাটফর্ম – মাঝ নদী থেকে পাড় প্রায় পাঁচশো ফুট হাঁটা। তারপর নদীর জলের লেভেল থেকে মাটির লেভেল ওঠা- সেটা প্রায় চল্লিশ ফুট। ভাবি, এই নদী যখন আগে জলে ভরা থাকতো তখন তাকে কেমন লাগত! সুন্দর অথছ ভয়ংকর?
ওপরে এসে লিনডার পিছন পিছন উঠলাম অপেক্ষমান এক ইলেকট্রিক ট্রলি বাসে। ঠং ঠং করে ঘন্টা বাজিয়ে বিজয়গর্বে বাস চলল। চলা মানে ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের মাথায় ওঠা। প্রায় পাঁচশো ফুট ওপরে উঠে বাস থামল- এটাই হচ্ছে মাউন্ট সুয়ানগুই (Mount Shuanggui)।
প্রথমে ঢুকলাম মাউন্ট সুয়ানগুই পার্কে। এখানে ইয়াংসি নদী বাঁধ দেওয়ার ফলে যে সব কালচারাল রেলিকগুলি জলের তলায় যেতে পারে- সেগুলি তুলে এখানে সযত্নে সাজানো আছে। ভিতরে থাকার জায়গা, প্রাচীন বাড়ি, মন্দির, দারুন সুন্দর কারুকার্য করা গেট – সব মিলে বেশ আকর্ষণীয়। এককালে এই পাহাড়ে প্রচুর আর্টিস্টরা আসতেন- কেউ ছবি আঁকতেন, কেউ গল্প বা কবিতা লিখতেন। সব মিলে জায়গাটা খুব ভালো লাগল। সিঙ্গাপুর প্রবাসীদের সাথে আলাপ হল- ১৯৪০ সালে চীনে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ওনার বাবা চলে আসেন সিঙ্গাপুর তারপর থেকে ওনারা সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা। আমেরিকা প্রবাসী জানালেন,উনি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে আমেরিকায় পড়তে এসেছিলেন, তারপর থেকে ওখানেই রয়ে গেছেন। চল্লিশ বছরে ওনারা চীনে এলেও এই ইয়াংসি নদীর ক্রুজ এই প্রথম বার।


চিত্র-৫১, ৫২, ৫৩

ঘোরা ভালোই হল, গল্পগুজবও খানিক হল। ঘন্টা দুই পর ফেরা – আবার সেই ইলেকট্রিক বাস ও তারপর অজস্র সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা। বোট ছাড়ার সময় একটা বোর্ডিং পাশ দিয়েছিল,সেটা দেখিয়ে বোটে ঢোকা গেল।
চান টান করে আবার বুফে খাওয়া। খেয়ে ঘরে আসছি, ক্যাপ্তেনের ঘোষণা – বোট এবার ছাড়বে। তাড়াতাড়ি টপ ডেকে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। বেলা দুটোয় বোট ছাড়লো- ইয়াংসি নদীর বুক চিরে বোট এগিয়ে চলেছে সিটাং এর দিকে, গতি মাঝারী, এখন বোট চলবে, কালকের আগে থামা নেই।
বাইরে মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া। একটা করে ড্রিংক্স নিয়ে নির্ভেজাল ছুটি কাটানো। দু পাশে অনেক ক্ষেত খামার চলেছে- ঝকঝকে চীন চোখের সামনে যেই সাজানো এক ছবি।

বিকাল ছটায় ক্যাপ্টেনের সাথে ওয়েলকাম ড্রিংকস । ড্রিংকস পর্বের সাথে ক্রু মেম্বারদের নাচ। দেখলাম বটে – অপূর্ব সব ড্রেস পরে দারুন সুন্দর সব নাচ দেখে মন ভরে গেল- যেন প্রফেশন্যাল আর্টিস্ট- কে বলবে এরা সব এখনে কাজ করে, কেউ রিসেপশনে, কেউ খাবার বানায়, কেউ ওয়েট্রেস, কেউ বা টুর গাইড।
পরদিন মানে ইয়াংসি ক্রুজের তৃতীয় দিন। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এককাপ চা নিয়ে বসে দেখি, চারপাশের দৃশ্যাবলী পাল্টে গেছে। সবুজ সমতল ক্ষেতের জায়গা নিয়েছে পাহাড়, গাছপালা, আর আছে পাহাড়ের ঢালে ক্ষেত।


চিত্র-৫৪, ৫৫

কিন্তু চা শেষ হতে না হতেই বোট দাঁড়িয়ে গেল। এখানে দু খানা ট্রিপ আছে- একটা হচ্ছে হোয়াইট এম্পারার সিটি ট্রিপ , যেটা হচ্ছে ১৮০০ বছর আগে যিনি এখানকার রাজা ছিলেন, তাঁর রাজধানী। অজস্র সে যুগের নিদর্শন , মন্দির, তোরণ ছড়িয়ে আছে এই সিটিতে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই ট্রিপে যাওয়া গেল না, পাহাড়ের মাথায় এই সিটিতে যেতে গেলে অনেক অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে, যা আমি পারব না। দ্বিতীয় ট্রিপটি হলো ভিউ অফ দি থ্রি গর্জেস – এটা হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় ওঠা, যেখান থেকে পুরো কোটাং(Qutang) গর্জ আর ইয়াংসি নদীর মিলনস্থল দেখা যায়। পরে কোটাং গর্জ দিয়েই বোট যাবে, তাই এই ট্রিপেও আমাদের উৎসাহ নেই। আমরা তাই এই দুটো ট্রিপের কোনোটাতেই যাচ্ছি না, আর এগুলো আমাদের ক্রুজের দামের মধ্যে ধরাও নেই।
ব্রেকফার্স্ট খেয়ে টপ ডেকে বসলাম। বারোটা নাগাদ এক অপূর্ব গর্জ আসবে, যার নাম কোটাং গর্জ। অধীর আগ্রহে তার প্রতীক্ষা করছি কিন্তু ঘোষণা হল যে বোট খানিক দেরীতে ছাড়ার জন্য কোটাং গর্জ কিছুটা সময় পরে আসবে- বেলা একটা নাগাদ। অতএব ছোট, ছোট-এই ফাঁকে খেয়ে আসা যাক। কেননা কোটাং এর পর আবার এক গর্জ আছে আর তাতে আছে নৌকা বিহার। কাজেই এই ফাঁকে না খেলে আর খাওয়া হবে না। অতএব ঝটাঝট খেয়ে এসে ওপরে উঠে দেখি কোটাং গর্জ ইতিমধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছেন। দু পাশে খাড়াই পাহাড়, মাঝখান দিয়ে ইয়াংসি গজেন্দ্রগমনে চলে গেছেন। আপার ডেকে খান তিনেক রো চিয়ার দিয়েছিলেন কতৃপক্ষ, যাতে শ খানেক লোক বসতে পারে। আমরা দেরী করার জন্য এই সব চিয়ারগুলো তো ভর্তি আর তার পিছনেও লোক উপছে পড়ছে। অজস্র চৈনিক যাত্রীর ভিড় টপ ডেকে কেননা প্রায় সবাই তো চীনা, আর সবাই বিরাট বিরাট জুম বা সেলফি বের করে ছবি তুলছে। তারই ফাঁক দিয়ে দেখব বলে দাঁড়ালাম, উপায় তো নেই- সবুজে মোড়া পাহাড়, নীল জল, ভারি চমৎকার দৃশ্যে। ছবি তোলা বেশ শক্ত কেননা সব চীনা যাত্রীর মাথায় বিরাট বিরাট টুপি, সেই টুপির আড়াল বাঁচিয়ে ছবি তোলা বেশ শক্ত। তবে বেশিক্ষণ লড়াই করতে হল না, কোটাং গর্জ যতোই সুন্দর হোক না কেন, দৈর্ঘ্য তার মাত্র কয়েক কিলোমিটার, ফলে মাত্র আধ ঘন্টায় সব শেষ।


চিত্র-৫৬, ৫৭, ৫৮

কোটাং শেষ হতে অধিকাংশ চৈনিক যাত্রী নীচে চলে গেলেন, বিশেষ করে চীনা মেয়েরা, যাঁরা দেখেছি রোদকে খুব ভয় পান। রোদে পারতপক্ষে আসতে চান না বা এলেও ছাতা বা বিরাট সাইজের টুপি পরে থাকেন। আমরা দেখলাম, আরে সব চিয়ার দেখতে দেখতে খালি, কাজেই তিন জনে সামনের রোতে জম্পেস করে বসলাম। এখন খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কেননা পরের গর্জ যার নাম “উ”, তার আসতে এখনো ঘন্টাখানেক।
বসে আছি, ইয়াংসি নদীর ঠান্ডা ও বিশুদ্ধ হাওয়াতে মন প্রাণ আনন্দে ভরপুর। দু পাশে পাহাড়, সবুজে মোড়া সব উপত্যকা- দেখেও সুখ।
বেশ খালি খালি ছিল, দেখছি আর একটা গর্জ এগিয়ে আসছে। এটাই উ গর্জ । এমন সময় টুর ম্যানেজার টম ফস করে ঘোষণা করে বসল উ গর্জ আসার কথা। ব্যাস,খালি খালি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আর হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিল পিল করে চীনা জনতা হাজির। সবার মাথায় সেই বিরাট বিরাট টুপি, কারুর মাথায় আবার ছাতা লাগানো টুপি। আমরা সবার সামনে- কাজেই নির্বিঘ্নে ছবি তুলছি আর মুগ্ধ হয়ে দেখছি সরু একফালি এই গর্জ –বোট চলেছে মাঝখান দিয়ে- দু পাশে পঞ্চাশ ফুটও জায়গা নেই কোনো কোনো জায়গায়। দুপাশের পাহাড় ক্রমে উঁচু হচ্ছে- এই পাহাড়ের এক আভিজাত্য আছে, এর নাম গডেস মাউন্টেন। পাহাড়ের মাথাটা ভগবান বুদ্ধর মতো দেখতে বলে এই নাম। পাহাড়ের একদম মাথায় একটা বুদ্ধ মন্দিরও আছে। সেখানে উঠতে গেলে চার হাজার সিঁড়ি ভাঙ্গতে হবে। অজস্র লোক ঐ সিঁড়ি দিয়ে ওঠে। ওপরে ওঠা এদের কাছে এক পুণ্য যাত্রা- যেন এক মহাতীর্থ যাত্রা। মাঝে এক জায়গায় ঐ চার হাজার সিঁড়ির কিছুটা চোখে পড়ল- দেখলাম চারজনের এক চীনা পরিবার উঠছে। স্বামী, স্ত্রী, পিঠে এক বাচ্চা ও সাথে এক বছর দশেকের ছেলে। প্রায় অর্ধেক উঠেও গেছে। ওরা আমাদের হাত নাড়লো, আমরাও হাত নাড়লাম- মনে মনে আশীর্বাদ করলাম- নির্বিঘ্নে তোমাদের যাত্রা সম্পূর্ণ হোক বাছারা।
অপূর্ব সুন্দর এই গডেস মাউন্টেন। পাহাড়ের যে এতোরকম রঙ হতে পারে, এ ছিল ধারণার অতীত। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে পাহাড়ের চূড়া, তার ওপর সূর্যর আলো পড়ে সত্যিই মনে হচ্ছে বুদ্ধদেব শুয়ে আছেন।
দেখতে দেখতে ঘন্টাখানেক চলে গেল- আমরা এসে গেলাম উ গর্জের শুরুর প্রান্তে। টম ঘোষণা করলেন- আমরা এসে গিয়েছি উ গর্জের প্রারম্ভে। এখানে তোমাদের নামতে হবে, কেননা এই গর্জে তোমাদের নৌকাবিহার আছে। সুতরাং তোমরা নীচে নেমে যাও- যে যার টুর গাইডের সাথে বোটে ওঠো।
ঘোষণার সাথে সাথে চৈনিক জনতা খালি। আমরা ধীরে সুস্থে নীচে নেমে দেখি আমাদের গাইড অপেক্ষা করছে হাতে বোর্ড নিয়ে। আবার সেই ইংরাজি জানা গ্রুপ- জনা কুড়ির পরিচিত জনতা। বোট থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে নামলাম। লাইন করে পাড় ধরে খানিক যাওয়া। উল্টোদিকে গডেস মাউন্টেন। খানিক এগুতে এক ছোট জেটি। সেখানে দেখি দারুণ সুন্দর এক রংচঙ্গে বোট অপেক্ষা করছে। উঠে পড়লাম- জানালার ধারে ক্যামেরা সেট করে বসলাম।
আমাদের গাইড মেয়েটির নাম ইয়োইয়ো- খুব মজার মেয়ে । ও এখানকারই মেয়ে। বলল, এখানে যে অল্প কজন লোক থাকে, তাদের অনেকেরই বয়স একশোর ওপর- কি করে জানো?
-কি করে? আমরা প্রশ্ন করলাম।

শুধু তামাক খেয়ে, যতো তামাক খাবে, ততদিন বাঁচবে।
শুনে ঠিক বুঝতে পারলাম না- এ কি মজা করে বলছে না সত্যি? এ যে উল্টো কথা – এতদিন ধূমপানের বিরুদ্ধে শুনেছি, পক্ষে প্রচার এই প্রথম।
বোট ছাড়লো- এত সুন্দর গর্জ জীবনে খুব কম দেখেছি। ঘন নীল জল,চারপাশে পাহাড়ের সুউচ্চ সবুজ কার্পেটে মোড়া হাজার দেড় হাজার ফুট উঁচু সব অজস্র চূড়া, সব মিলে দারুন এক সিনারি। এই পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট বাড়ী চোখে পড়ল। ইয়োইয়ো জানাল, এটা একটা গ্রাম। এই গ্রামে একটাই বাড়ি আর লোক থাকে চারজন- দাদু, দিদা, ছেলে আর ছেলের বৌ। দাদুর বয়স নাকি একশোর ওপর। এখানেও ইয়োইয়ো ধূমপানের সপক্ষে প্রচার চালানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু আমেরিকা প্রবাসী চীনাবন্ধু তাকে আটকালো। পাশ দিয়ে অন্য কোনো বোট গেলে তার গাইড এক কলি চীনা গান শোনাচ্ছে, প্রত্যুত্তরে আমাদের ইয়োইয়োও একলাইন গান শোনাচ্ছে। এটাই নাকি এখানকার দস্তুর। ফলে আমরাও প্রচুর সুর করা চীনা গান এক দু লাইন করে শুনলাম। দীপা বলল, ফ্রিতে যা পাওয়া যায় আর কি!
ইয়োইয়ো জানালো যে চাইনীজ ভাষায় মানে যাকে বলে ম্যান্ডারিন, তাতে কিছু কিছু শব্দ চার রকম সুর করে বলা যায়। এই এক একটা সুরের মানে কিন্তু আলাদা। মানে সেই শব্দটা সুর করে বললেই তার মানে পালটে যায়। উদাহরণ দিল- গাগা চে গাগা। মানে দাদু মাংস খায়। প্রথম গাগাটা স্বাভাবিক উচ্চারণ আর দ্বিতীয় গাগা সুরে- গা-আ আ গা। প্রথম গাগার মানে দাদু আর দ্বিতীয় গাগার মানে মাংস। এবারে মাথায় ঢুকল কেন চাইনীজদের সুর করে কথা বলতে শুনেছি। সুর করে বললে যে মানে পালটে যায়- জানতাম না।


চিত্র-৫৯, ৬০, ৬১

এই ক্রুজ ছিলো মিনিট চল্লিশের। প্রাণভরে এর সৌন্দর্য আহরণ করা গেল। সন্ধ্যা নামছে পৃথিবীর বুকে – বোট ফিরে এল। আমারাও আমাদের মেন বোটে উঠলাম।
বোটে এসে শুরু করলাম সুটকেশ গোছানো- কাল বোট ছেড়ে দিতে হবে, আর তার জন্য আজ রাতেই সুটকেশ নীচে দিয়ে আসতে হবে। ওরাই সুটকেশ কাল বাসে তুলে দেবে। আমরা নিজেরা সুটকেশ নিয়ে যেতে পারব না- কেননা বোট ডক করবে মাঝনদীতে জল কম বলে। আর ঐ সরু প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে মাল নিয়ে যাওয়া আমাদের সাধ্য নয়। সুটকেশ গুছিয়ে রাখতে না রাখতেই খাওয়ার ডাক। নীচে ডাইনীং রুম গিয়ে দেখি আমাদের সব ওয়েটার-ওয়েট্রেসরা লাল রঙের ড্রেস পরে এসেছে। ভারী চমৎকার লাগছিল আমাদের দুই ওয়েট্রেস লিনডা ও বেলাকে। খাওয়ার পর ওপরে ডেক ফাইভে গেলাম। এখানে আজ বিদায় পার্টি –তাতে ক্রু মেম্বাররা নাচ গান করবে। ভেবেছিলাম কি এমন প্রোগাম আর এরা করবে! দেখি একটু, দু চারটে দেখে চলে যাব। এই ভেবে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। ঠিক রাত আটটায় শুরু হল, কিন্তু কি লিখব! এত চমৎকার সব অনুষ্ঠান- অসাধারণ নাচ, গান, ম্যাজিক, জিমন্যাস্টিক এরা দেখালো- ভাবতে পারি না, যেন সব প্রফেশন্যাল আর্টিস্টরা করছে।
এ-কদিন ধরে যে সব নিরীহ শান্তশিষ্ট ওয়েটার ওয়েট্রেসদের ডাইনীং রুমে দেখেছি, তারা যে এত গুনের অধিকারী জানতাম না। প্রত্যেকের চেহারার ফ্লেক্সিবিলিটি দেখার মত। আর রঙ্গীন রঙ্গীন ড্রেসে কখনও রঙ্গীন ছাতা নিয়ে, কখনও রঙ্গীন কাগজ নিয়ে বা রঙ বেরং এর রিং নিয়ে নাচ গুলি ছিলো দেখার মত। এই প্রোগাম দেখে শুতে শুতে রাত এগারোটা।
পরদিন সকাল- আজ বোট ছেড়ে দিতে হবে। তিনটে দিন যেন উড়ে গেল। ইয়াংসিকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। কিন্তু উপায় নেই। ব্রেকফার্স্ট পর্ব সারার পর নীচে গেলাম। আমরা এখান থেকে যাব একটা বাস টুরে- বোট কোম্পানীর তত্ত্বাবধানে । আমাদের মালপত্র ইতিমধ্যে বাসে উঠে গেছে। টম জানালেন আমাদের বাস নাম্বার ৬৩, তাতে ইংলিশ স্পোকেন গাইড আছে। আমরা যাচ্ছি থ্রি গর্জেস ড্যাম দেখতে আর ফিরবো ইচিং টুরিষ্ট সেন্টারে। ওখানে মাল রাখা থাকবে।
চীনে এককালে প্রচুর বন্যা হত। অতি বৃষ্টি হলেই ইয়াংসি নদীর জল কূল ছপিয়ে সব ভাসিয়ে দিত। প্রায় প্রতি বছর এর ফলে ভয়াবহ বন্যা হত। ১৯১৯ সালে চীনা নেতা সান ইয়াত সেন প্রথম প্রস্তাব করেন এই বাঁধের কথা। যাতে বন্যা তো রোধ করা যাবেই, তা ছাড়া সারা বছর চাষের জন্য জল-ও পাওয়া যাবে। আর বাড়তি পাওয়া যাবে জল বিদ্যুৎ। কিন্তু সে কাজ শুরু হতে অনেক বছর কেটে যায়। ১৯৩৯ সালে জাপানীরা চীন দখল করলে জাপানীরা এই কাজ প্রথম শুরু করে, কিন্তু খুব শীঘ্র সে কাজ বন্ধ হয়ে যায় টাকার অভাবে ও যুদ্ধর ফলে। ১৯৫৪ সালে যখন আবার ভয়াবহ বন্যা হয় তখন আবার এই প্রজেক্ট মাথা চাড়া দেয়। কিন্তু টাকার অভাবে ও অন্যান্য কারণে কাজ শুরু হয় ১৯৯৪ সাল। ২০০৯ সালে এই বাঁধ সম্পূর্ণ হয়। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হয় ২০০৯ সালে।

বিশাল বড়ো এই বাঁধ সাড়ে সাত হাজার ফুট লম্বা ও ৬০৭ ফুট উঁচু। আমরা ঘন্টাখানেক বাসে চেপে এখানে পৌছালাম। প্রবল ভিড়। একসাথে গোটা দশেক ক্রুজের লোক এসেছে, এছাড়া অন্য লোকেরাও আছে। এখানে সিকিউরিটি খুব কড়া। সে সব সাঙ্গ করে ড্যাম এরিয়ার ভিতর ঢুকে প্রথমে দেখলাম বিভিন্ন লঞ্চ। বাঁধ দেওয়া জায়গা ও বাকি নদীর মধ্যে অনেকটা লেভেলের তফাত। তাই বিভিন্ন লক আছে। দেখলাম কয়েকটি মালবাহী বোট লক পার হচ্ছে। এরপর দেখলাম সি লিফট। এক্ষেত্রে পুরো বোটটাকে একটা জল ভর্তি চেম্বারে প্রথম ঢোকানো হয়। তারপর সেই জলভরতি চেম্বার, বোট সহ লিফটে করে নীচে নামানো হয় ইয়াংসি নদীতে। বাঁধের জলের লেভেল ও নদীর জলের লেভেলের মধ্যে বিস্তর ফারাক, তাই এই লিফট। শুনলাম এই সি-লিফট পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সি-লিফট। তবে এর পাশে এর চেয়েও বড়ো আরো একটা সি লিফট হচ্ছে দেখলাম।
আজ চমৎকার আবহাওয়া। নীল আকাশ, ঝকঝকে রোদ্দুর ভরা দিন। গরমও আছে। হেঁটে হেঁটে বাঁধের পাশে এলাম। বাঁধের রূপ দেখে মনে হচ্ছে এ যেন এক বিশাল লেক। ইয়াংসির মত বিশাল ও ভয়ংকর নদীও বাঁধা পড়েছে মানুষের হাতে।
আরও খানিকক্ষণ ওখানকার ভিজিটিং সেন্টার দেখে ও ড্যাম সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য জেনে বাসে উঠলাম সাড়ে এগারোটায়। বাস ছুটে চলল পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে। যাব ইচিং – এক ঘন্টার রাস্তা। পথে পড়ল আরো একটি সুন্দর গর্জ – ভয়ানক সরু কিন্তু অতীব সুন্দর। বেলা সাড়ে এগারোটায় এসে গেলাম ইচিং টুরিষ্ট সেন্টার।


(চলবে- আগামী সংখ্যায় জ্যাঞ্জিয়াজিতে চিমনি পাহাড়ের কোলে অবিস্মরণীয় দৃশ্যাবলীর মাঝে আর সাংহাই ভ্রমণ, পড়বেন কিন্তু)

[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

4.5 2 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
11 days ago

চমৎকার লিখেছেন। মানসভ্রমণ করছি।