চতুর্থ ও শেষ ভাগ

ষষ্ঠ পর্ব –জ্যাঞ্জিয়াজিতে চিমনি পাহাড়ের কোলে


চায়না হাইলাইটস থেকে আগেই জানানো হয়েছিল ইচিংতে আমাদের জন্য লোকাল টুর গাইড স্যালি অপেক্ষা করবে। একটু এগুতেই দেখি হাতে নাম লেখা বোর্ড নিয়ে স্যালি। স্যালি বলল, আমি তোমাদের লাঞ্চ খাইয়ে গাড়িতে তুলে দেব। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল জ্যাঞ্জিয়াজি গাড়িতে যেতে হবে। আগে ট্রেন যেত, এখন আর তা চলছে না। ফলে এই চারশো কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে যেতে হবে।
ইতিমধ্যে আমাদের মালপত্র এসে গেছে টুরিষ্ট সেন্টারে। রিসিট দেখিয়ে লাগেজ নেওয়া হল। মাল তোলা হলো গাড়িতে। এটাও সেভেন সীটার গাড়ি- একই রকম সুন্দর ও আরামদায়ক। মাল তুলে সবাই মিলে এলাম এক রেস্টুরেন্টে। এখানেও জমিয়ে খাওয়া হল বটে- বেগুন, চিকেন কুংফাই, বীনস। খাওয়ার পর স্যালি বলল, আমার এখানেই ইতি, ড্রাইভার তোমাদের হোটেলে পৌছে দেবে। আমি ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি, ও মাঝে একটা ব্রেক-ও দেবে।
স্যালি চলে গেল- আমরা গাড়িতে বসলাম। ড্রাইভার কিছুই ইংরাজি জানে না, কাজেই স্যালি ওকে যা বলেছে তার ওপর ভরসা করেই যাওয়া। গাড়ি ও রাস্তা- দু-ই দারুন, মাঝে মাঝে এক একটা পাহাড় আসছে, গাড়ি গড়ে একশো কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। ঘন্টা দুই পর ব্রেক ও তারপর পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ির ওঠা শুরু। তবে রাস্তার জন্য মালুমই হয় না যে ওপরে উঠছি। বিকাল পাঁচটায় এসে গেলাম চারিদিকে বিরাট উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঘেরা জ্যাঞ্জিয়াজিতে। এখানে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা পুলম্যান হোটেলে। দারুন হোটেলখানি। বস্তুত চীনের সব হোটেলই আমার দারুন লাগল। এখানে আমরা চার রাত থাকব। আবহাওয়া চীনের অন্য অংশর তুলনায় ঠান্ডা। একটু শীত শীত ভাব, গায়ে তাই হালকা জ্যাকেট চাপানো হল। হোটেলে চা খেয়ে চললাম শহর দেখতে।
হোটেলের পাশেই বিরাট থিয়েটার হল আর বহু প্রাচীন নিদর্শন, গেট, টোটেম দিয়ে সাজানো বিরাট চত্তর। এখানে থিয়েটার মানে কিন্তু শুধু স্টেজে অভিনয় নয়, রীতিমতো বিরাট এলাকা জুড়ে স্টেজ। সেখানে সত্যিকারের পাহাড় পর্বত লেক আছে। অধিকাংশরই গল্প হচ্ছে প্রাচীন চীনে রাজার যুদ্ধ অভিযানের ওপর। এতে ঘোড়ায় চেপে সৈন্যরা আসছে, তরোয়ালের লড়াই, পাহাড় থেকে মেরে লেকে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি এমন ভাবে দেখানো হয়, যেন এ এক সত্যিকারের যুদ্ধ। চীনে এই শো খুব জনপ্রিয় ও দেখার মতো।
এদিক ওদিক ঘুরে আর বিভিন্ন দোকান দেখে জায়গাটার স্বাদ নিচ্ছি – দেখছি অন্তত শ খানেক বিরাট বিরাট টুরিষ্ট বাস আসছে ও দাঁড় করাচ্ছে। দলে দলে লোক নামছে, কেউ বা হোটেলে চলে যাচ্ছে, কেউ থিয়েটার দেখতে আসছে। বুঝলাম জ্যাঞ্জিয়াজি চীনের অন্যতম টুরিষ্ট স্পট, পুরো চীন থেকে এখানে লোক আসে। পরে জেনেছি প্রতিদিন প্রায় আশি নব্বই হাজার টুরিষ্ট আসে এখানে। আসার প্রধান কারণ অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
জ্যাঞ্জিয়াজি নামটা একটু খটমট, কিন্তু শহরটা নয়। এর ওপর দু চার কথা লেখা যাক। চীনের উত্তর পশ্চিমে হুনান প্রভিন্সে এই শহরটি বলা যায় পুরোটাই ন্যাশনাল পার্ক, কেননা এই শহর জুড়ে আছে পাহাড় আর পাহাড়। আর সে পাহাড় যে সে পাহাড় নয়- স্যান্ডস্টোনের সিলিন্ডার টাইপ অজস্র পাহাড়। অনেকেই নিশ্চয় মনে করতে পারেন বেশ কয়েক বছর আগে মুক্তি পাওয়া অবতার সিনেমাটির কথা। অনেকেরই নজর কেড়েছিল স্তম্ভের মতো লম্বা লম্বা পাহাড়, এগুলো কিন্তু কোনোটাই ভিন গ্রহের নয়। এই আশ্চর্য পাহাড়ের পর পাহাড়- যাদের ব্যাস দশ মিটারও নয়, কিন্তু খাড়াই উঠে গেছে দুশো মিটার বা তার চেয়েও বেশী। এই আশ্চর্য চিমনী পাহাড়ের সমাবেশ হয়েছে জ্যাঞ্জিয়াজিতে।
জ্যাঞ্জিয়াজিতে ইউনান সিনিক এলাকা জুড়ে এরকম তিন হাজার বা ততোধিক খাড়াই স্তম্ভ পাহাড় আছে যাদের ওপরভাগ ঘন সবুজ পাতাওলা গাছে মোড়া। আর কোটি কোটি বছর ধরে এই পাহাড়গুলি কোয়ার্টেজ স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি হয়েছে।
এছাড়া জ্যাঞ্জিয়াজির এই বিচিত্র পর্বত মন্ডলীর আরো কাহিনী আছে,‌ যেটা পরে লিখছি।


জ্যাঞ্জিয়াজিতে আমাদের প্রথম টুর


আজ আমরা যাব ন্যাশনাল পার্ক – অবতার সিনেমায় দেখানো ঐ পর্বত মন্ডলী দেখতে। সকালে ব্রেকফার্স্ট খেতে গিয়ে দেখি এলাহী খাবারের আয়োজন। কি ছেড়ে কি নেব –ভাবতে পারা শক্ত । হোটেলটি বিরাট বড়ো- দুটি বাড়ি, দুটোই ষোলো সতেরো তলা, ফলে পাঁচ ছশোটা ঘর আছে বলে মনে হয়। বিরাট ডাইনীং রুমে প্রায় শ চারেক সীট। কিন্তু তা প্রায় ভর্তি। খেতে খেতেই দেখা হল চায়না হাইলাইটসের গাইড লিনডার সাথে। এই যে এখানে এত লোক, এতো হোটেলের কর্মচারী , রিসেপসনিষ্ট- কিন্তু কেউ ইংরাজি জানে না। পরে রিসেপশনে ওষুধ কোথায় কিনতে পাব জিজ্ঞাসা করতে দেখলাম ওরা সেই লিনডাকেই ডেকে আনলো। মানে লিনডা ওদের ইংরাজির দোভাষীর কাজও করে, তাই ওর খাতিরও বেশী। লিনডা দেখলাম ডাইনীং হলে গুছিয়ে খেলো। মনে হয় লিনডা এখানে রোজই আসে, এত টুরিষ্ট- কারুর না কারুর গাইড হয়ে। জ্যাঞ্জিয়াজিতে আগেই লিখেছি রোজ অজস্র টুরিষ্ট আসে ফলে হোটেল সদাই ভর্তি আর গাইডের কাজেরও অভাব নেই।
যাই হোক, সকাল নটা বাজে। লিনডা গাড়ি এনেছে- একই রকম ছ জনের বসার গাড়ি। ন্যাশনাল পার্কের গেট, হোটেল থেকে গাড়িতে কয়েক মিনিট মাত্র। ভিতরে ঢুকে দেখি বিরাট জায়গা। লোকও প্রচুর, টিকিট চেকের বিরাট লাইন- চীনে আগেও দেখেছি বিরাট লাইন বলে ভয় পেলে চলবে না। নিমেষের মধ্যে লাইন ক্লিয়ার হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তা আবার হলো বটে। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে ফ্রি শাটল বাস। বাস উঠছে পাহাড় ঘুরে ঘুরে। জ্যাঞ্জিয়াজি এমনিতেই পাঁচ হাজার ফুট ওপরে – তা এই বাস আরো হাজার খানেক ফুট ওপরে তুলে দিলো। পথে পড়লো এক সবুজ জলের দর্শনীয় লেক। মিনিট কুড়ি পর বাস নামিয়ে দিলো কেবিল কার ষ্টেশন, কিন্তু তার জন্য আবার বিশাল লাইন। লিনডা বলল এখানে দুশো খানা সিঁড়ি উঠতে হবে- কেবিল কার স্টেশন পাহাড়ের মাথায়।
শুনে তো বজ্রাঘাত! দুশো খানা সিঁড়ি উঠতে হবে- হা ভগবান, কেবিল কার স্টেশন একটু নীচের লেভেলে করা যেত না? কিন্তু দুঃখ করে লাভ নেই- পা টেনে টেনে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতেই হবে- এক পা এক পা করে উঠছি- প্রথম একশো স্টেপ ভালো ভাবেই ওঠা গেলো, খালি ছিলো, কিন্তু তারপর দাঁড়িয়ে যেতে হলো কেননা লাইন। আর সে লাইন এগোয়ই না, দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। লিনডা বলল, এই কেবিল কারের নাম বাইলং এলিভেটর(Baillong Elevator) –হাজার ফুট ওপরে তুলে দেবে এই কেবিল কার মাত্র ৮৮ সেকেন্ডে। এটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী পাহাড়ী লিফট। কিন্তু লাইন তো এগোয় না,সময় চলে যাচ্ছে। লিনডা বলল, এই লাইনে লিফট ধরতে দেড় দু ঘন্টা লাগবে, তোমরা কি এতক্ষণ অপেক্ষা করবে? না চাইলে অন্য রাস্তা আছে, তবে ব্যায়সাপেক্ষ।
তা হোক, কি খরচা লাগবে? লিনডাকে প্রশ্ন করলাম।
একশো আর এম বি করে প্রতিজনার জন্য ভি আই পি পাশ লাগবে, তাতে এই লাইন স্কিপ করা যাবে।
দিলাম তিনশো টাকা, এভাবে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। লিনডা আবার নীচে গিয়ে টিকিট নিয়ে এল। হাতে পাশ আর বুকে লাগানো ভি আই পি স্টিকার নিয়ে ভি আই পি র চ্যানেলে ঢুকলাম। কেউ নেই, শুধু আমরা। কাজেই নিমেষের মধ্যে সব বাইপাশ করে চলে এলাম লিফটের সামনে। খান চারেক লিফট, কিন্তু চলছে মাত্র দুটো। তাই লাইনের এই দুরাবস্থা। পরের লিফট এলে আগে আমরা উঠলাম, মানে ভি আই পি রা, তারপর সাধারণ লাইনের জনতা। সব মিলে গোটা কুড়ির জনতা। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে চলে এলাম হাজার ফুট ওপরে। লিফট থেকে নেমে সামনেই ভিউ পয়েন্ট। কিন্তু দেখার উপায় নেই, অজস্র লোক ভিড় করে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন গোটা চীনের লোক এখানে ভিড় জমিয়েছে। লিনডা বলল, এখানে এক ঝলক দেখে নাও, তারপর আমি তোমাদের নিয়ে যাব সিক্রেট পথে, যেটা আমজনতা জানে না। ফলে ভালোভাবে নিজের মত করে দেখতে পারবে। ভিড় ঠেলে জায়গা বানিয়ে এক ঝলক দেখে নিলাম- অজস্র পিলার পর্বত মালা। প্রতিটির মাথা সবুজে সবুজ। কয়েকটা যেভাবে আছে, মনে হল, এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ল আর কি! দেখা সাঙ্গ হলে লিনডার সাথে উঠলাম আর এক শাটল বাসে, যেটা এখান থেকে ছাড়ে। নামলাম তার প্রথম স্টপে। এখানে দেখি পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে রাস্তা – আর মাঝে মাঝেই প্ল্যাটফর্ম বানানো। ঐ রাস্তা ধরে এগুচ্ছি – সামনে অনেক অনেক পিলার পাহাড়। মাঝে মাঝে যেখানেই প্ল্যাটফর্ম আসছে সেখানেই বেঞ্চে বসে বিশ্রাম। প্রাণভরে ছবি তোলা, চোখ মেলে দেখা আবার এগুনো রাস্তা ধরে। লিনডা ঠিকই বলেছিল, আমজনতা এই পথ জানে না, ফলে এই রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। যেন মনে হচ্ছে এই চিমনি পাহাড় একান্তভাবে শুধু আমাদেরই। অসুবিধা একটাই, আর সেটা শুধু আমারই- তা হল রাস্তা তো আর সমতল নয়- পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছে- ফলে অনেক সিঁড়ির খেলা- কোথাও বা পনেরো স্টেপ উঠলাম আবার একটু এগিয়ে বিশ স্টেপ নামলাম। ফলে একদিকে পা যেমন বিদ্রোহ করছে, অন্য দিকে হাঁফিয়েও যাচ্ছি। কিন্তু এই সৌন্দর্য – এর রূপ আস্বাদন করতে করতে যেন অন্য এক জগতে চলে যাচ্ছি। কষ্টকে কষ্ট বলে আর মনে হচ্ছে না। প্রতিটি পাহাড় অপরের থেকে আলাদা। কেউ প্রচন্ড সরু কিন্তু খাড়া, কেউ বা বেঁটে কিন্তু গাছপালায় ভর্তি , কেউ বা টেরা বাঁকা – যেন অন্য গ্রহের। মোদ্দা কথা এ যেন এক অজানা পৃথিবী – এরকম যে হতে পারে, সেটা ধারণার অতীত। হেঁটে হেঁটে আমরা চলে এলাম যেখানে অবতার সিনেমার শুটিং হয়েছে। ঘন্টাখানেক হেঁটে ও ওঠানামায় শরীর ক্লান্ত। পাহাড়ের রূপ অনেকটা প্রত্যক্ষ করে মন খুশীতে ভরপুর। লিনডা বলল এখানে দেখা শেষ হলে চল পরবর্তী গন্তব্য স্থলে যাই। যেটা হল মাউন্ট তিয়াঞ্জিসান (Mount Tainzizishan)


চিত্র-৬২, ৬৩, ৬৪

চলো যাওয়া যাক- আবার শাটল বাস ধরলাম। এই বাসে অনেকক্ষণের পথ, প্রায় মিনিট চল্লিশ বিভিন্ন পাহাড়ী পথ ধরে গিয়ে বাস থামল এক জায়গায়- এখানে মাউন্ট তিয়াঞ্জিসানের ভিউ পয়েন্ট আছে। আছে বেশ কিছু দোকানপত্র, মায় এক ম্যাকডোনাল্ড-ও। আমরা ভিউ পয়েন্টে এলাম। এখানের পাহাড় আগের মতই পিলার পাহাড় কিন্তু এর ওপর সদাই কুয়াশায় ভরা একটা মেঘ থাকে আর সব মিলে এক মায়াবী রূপ। লিনডা বলল, শীতকালে এর চূড়াগুলো বরফে সাদা হয়ে থাকে। এখানেও পাহাড়ের গা বেয়ে চলেহে সিনিক ভিউ উপভোগ করার রাস্তা। পথে আছে অন্তত আশিখানা প্ল্যাটফর্ম যাতে তুমি দু দন্ড বসে পাহাড়ের শোভা উপভোগ করতে পারো। আমাদের আর হাঁটার ক্ষমতা নেই, কাজেই ওখানেই অজস্র ছবি তুলে ও বিশ্রাম নিয়ে যা পারলাম সৌন্দর্য আস্বাদ করলাম। এখানে এক প্যাগোডা দেখলাম- লিনডা বলল পুরানো দিনের গল্প –নাকি মেয়েদের বিয়ের পরে এখান থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত বাবা মার থেকে আসন্ন বিদায়ের জন্য।

চিত্র- ৬৫, ৬৬, ৬৭


তখন বাজে প্রায় তিনটে। অনেক দেখা হল আজ। এবার ফেরার পালা। ফিরব অন্য রুটে –কেবিল কারে। আবার আমরা উঠলাম শাটল বাসে, মিনিট পঁচিশ বাসে যাওয়ার পর এলাম বিশ্বের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি তিয়াঞ্জিসান কেবিল কারে। মিনিট কুড়ির পথ এই কেবিল কারে, কিন্তু বিশাল বিশাল পিলার ঐ মাউন্টেনের গা বাঁচিয়ে উঠেছে কেবিল কারের জন্য। পথের সৌন্দর্য ভোলার নয়- চিমনি পাহাড়গুলোর মাঝখান দিয়ে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে চলেছে কেবিল কারের পথ- হাত বাড়ালে যেন চিমনি পাহাড় ছোঁয়া যায়।
কেবিল কার থেকে নেমে দেখি অন্তত শ দেড়েক সিঁড়ি ভাঙতে হবে রাস্তার লেভেলে যাওয়ার জন্য। খোঁড়াতে খোঁড়াতে যখন নামলাম, মনে হচ্ছিল, অনেক হলো, এবার বিছানাটা এনে দাও, শুয়ে যাই।


চিত্র-৬৮


বিছানা পেলাম না, গাড়িতে উঠে সিটগুলো হেলিয়ে আধ শোওয়া হয়ে বসে খানিক শক্তি পাওয়া গেলো। দুপুরে খাওয়া হয় নি- লিনডা ম্যাকডোনাল্ডে খাওয়ার কথা বলছিল কিন্তু আমরা রাজি হই নি- চীনে এসে কে ম্যাকডোনাল্ড খায়! তাই শহরে এসে নদীর ধারের এক রেস্তোরাঁয় জমিয়ে খাওয়া হল, হোটেলে ফিরলাম বিকাল সাড়ে চারটে। খানিক শুয়ে ও রেষ্ট নিয়ে হারানো এনার্জি খানিকটা উদ্ধার করা গেল।
পরদিন সকালে উঠে হাত পা যেন নাড়াতেই পারি না- এমন গায়ে গতরে ব্যাথা। এত ওঠা নামার অভ্যাস তো নেই! এই সব ভেবেই আজকের দিনে কোনো টুর রাখিনি- স্রেফ নিজেদের মত ঘোরা এবং বিশ্রাম নেওয়া। সারাদিন টুকটাক ঘোরা ও বিশ্রাম নিয়েই কাটল। এখানকার নদীর পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে হাঁটা, অজস্র রঙ বেরং এর চেরি ব্লসম দেখা আর অপেরা চত্তরে অলসভাবে সন্ধ্যা অতিক্রান্ত করা।


জ্যাঞ্জিয়াজিতে আমাদের দ্বিতীয় টুর

আজ আমাদের নতুন গাইড-নাম জেন। আবার বেরুনো চায়না হাইলাইটস এর গাড়িতে। লিনডা ভালো ইংরাজি জানতো, কিন্তু জেনের অসুবিধা হলো ও বাঁধাধরা কয়েকটি ইংরাজি ছাড়া আর বেশি জানেনা, ফলে কথোপকথন বেশ দুষ্কর। তবে জেনের কথায় যা বোঝা গেলো, আজকের পথ-ও সহজ নয়, আজও আছে অনেক ওঠানামা ও হাঁটা। যতোটা পারব, দেখব- এই মনোভাব নিয়ে গাড়িতে উঠলাম, জ্যাঞ্জিয়াজি গ্রান্ড ক্যানিয়ান দেখব বলে।
মিনিট চল্লিশের রাস্তা- আজ আবার আকাশের মুখ ভার। পিটির পিটির বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশ। আজ পর্যন্ত যে কদিন চীনে আছি, আবহাওয়া রোজই ভালো ছিল। আজই প্রথম খারাপ আবহাওয়া, যাতে ঘুরে বেড়ানোও শক্ত আর ছবি তোলা তো বটেই। কিন্তু প্রকৃতির ওপর কারুর হাত নেই- অতএব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই।
গাড়ি থেকে নেমে আবার দীর্ঘ লাইন। তারপর পাসপোর্ট স্ক্যান করে ঢোকা। যাবো কেবিল কারে। ছোট ছোট কেবিন –চার পাঁচ জনের উপযুক্ত। আমরা একটা কেবিল কারে উঠলাম। এই কেবিল কারের প্রযুক্তিও দেখার মতো। প্রায় দু কিলোমিটার লম্বা এই কেবিল কারের পথ হচ্ছে পাহাড় পর্বতের মাঝ দিয়ে, জঙ্গলের ওপর দিয়ে। অপূর্ব দৃশ্যাবলী – মিনিট কুড়ির পথ- কিন্তু দেখার মত। ওপরে উঠে আবার কিছু স্টেপ। চীনে দেখছি কেবিল কারই হোক বা এলিভেটারই হোক, যেতে আসতে সিঁড়ি মাড়াতেই হবে- পালানোর জো নেই।
স্টেপ পেরিয়ে ওপরে উঠে দেখি বিরাট গর্জ। তার ওপরে দারুন সুন্দর এক ঝকঝকে কাঁচে্র ব্রীজ। সাড়ে সাতশো মিটার লম্বা এই ব্রিজ গর্জের তিনশো মিটার ওপর দিয়ে চলেছে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কাঁচের সেতু। কাঁচে যাতে দাগ না পড়ে, তাই এখানে জুতোর ওপর ওদের দেওয়া নরম জুতো পড়তে হবে। ওই জুতোগুলো আবার গরম হাওয়া দিয়ে জীবানুমুক্ত ও শুকনো করে অন্য বাক্সে রাখা হচ্ছে পরে ফেরার জন্য। ব্যাবস্থাপনা বেশ ভালোই। আমরা নিজেদের সাইজের জুতো পরে আর জেনের দেওয়া পলিথিনের রেনকোট পরে ব্রিজে উঠলাম। বৃষ্টির জন্য নীচের কাঁচ অস্বচ্ছ, তাও যেটুকু নীচে নজর পড়ল, মাথা ঘুরে যাওয়ার মত দৃশ্য। হাজার ফুট নীচে গর্জ চলেছে, মনে হচ্ছে যেন গর্জের ওপর শূন্যে দাঁড়িয়ে আছি। ধীরে ধীরে ওই পিটির পিটির বৃষ্টির মধ্যে যতোটা পারলাম, ছবি তুললাম।

চিত্র-৬৯, ৭০, ৭১


ওপরে গিয়ে ওদের জুতো খুলে বসলাম। জেন বলল,এখান থেকে ঘন্টা দুই হাঁটা ও বিভিন্ন ভিউ দেখার রাস্তা আছে।
তা আছে, কিন্তু সে রাস্তায় ওঠানামা আছে?
ওঠানামা আছে, তবে সবটাই সিঁড়ি করা, ওঠা ও নামা দুইই।
তবে আমি নেই, বরঞ্চ আমি এই গর্জের পাশে বসে প্রকৃতির শোভা দেখি।
দীপা ও ডোরা বলল, আমরা জেনের সাথে যতোটা পারি ঘুরে আসি। এখানেই থেকো কিন্তু।
আমি ওখানে বসে থাকলাম। গর্জটি সত্যিই সুন্দর। কাঁচের ব্রিজে চীনা ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সেলফি তোলা দেখে ও গর্জ দেখে ঘন্টা দেড়েক কাটল। হঠাৎ দেখি ওরা আসছে। বলল, কালকের মতোই পাহাড়ের ধার দিয়ে রাস্তা, কালকের মতোই ভিউ, তবে অন্য দিক থেকে আর বৃষ্টিতে দেখাও মুশকিল।
এখানেই একটি ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল, সেখানে লাঞ্চ খাওয়া গেল। এই প্রথম এখানকার খাবার খাওয়া গেল না, অতি জঘন্য বানানো, শুধু আলুভাজার অংশটুকু খেয়ে বাকিটা ফেলে দিতে হল।
আবার গ্লাস ব্রিজ পেরিয়ে কেবিল কার ধরে নীচে এলাম। গাড়িতে করে এবার চললাম বাওফেং (Baofeng) লেক। এটা হচ্ছে পাহাড়ী এলাকার সবচেয়ে নীচু জায়গা যেখানে জল জমে এক বিরাট লেকের সৃষ্টি হয়েছে। বাওফেং লেক এলাকায় ঢুকে ওদের শাটল বাসে করে এলাম লেকের নৌকাবিহার স্টেশন। ত্রিশ জনের বোট। লেকটি চলেছে বিভিন্ন পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে অনে কটা নরওয়ের ফিওরডের মতো। গর্জের ঘন নীল জল, দুপাশে সুউচ্চ পাহাড়, মাঝ দিয়ে তরতর করে চলেছে আমাদের নৌকা। তবে বেশীক্ষণ নয়, মিনিট চল্লিশের নৌকাবিহার শেষে আমরা আবার শাটল বাস ও গাড়ি করে এলাম হোটেল।

চিত্র-৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬

জ্যাঞ্জিয়াজিতে আমাদের তৃতীয় টুর
পরদিন- অর্থাৎ আজ আমাদের এখানে শেষ দিন। রোজ রোজ চিমনি পাহাড় দেখার এখানেই যবনিকা পড়বে। মন তাই ভারাক্রান্ত। এই হোটেলটিও ছিল চমৎকার, সব মিলে মন বিষণ্ণ।
আবার মালপত্র প্যাক, সুটকেশ গোছানো ও চেক আউট করে এলাম অপেক্ষমান জেনের গাড়িতে। জেন বলল, আজ আমরা যাব তিয়ান মেন (Tianmen) পাহাড়। তিয়ানমেন হচ্ছে জ্যাঞ্জিয়াজি্র সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এখানকার কেবিল কার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা কেবিল কার। আর এখানকার কাঁচের অবজারভেশন প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু অবজাভেশন প্ল্যাটফরম- প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট ওপরে এই প্ল্যাটফর্ম দেখার মতো।
জেন তো খুবই উৎসাহভরে তথ্য দিলো, কিন্তু আমি ভাবছি আবার না ওঠানামা থাকে- ওঠানামা মানেই তো আমি অকেজো। যাক, দেখা যাবে, আগে তো আসুক।
বেশী দূরের পথ নয়, হোটেল থেকে মিনিট কুড়ি গাড়িতে চলে এলাম তিয়েনমেন পার্ক। এখানে গাড়ি রেখে চিরচরিত প্রথায় পাসপোর্ট স্ক্যান করে কেবিল কারের লাইনে দাঁড়ানো। অজস্র কেবিল কার- প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একটা করে আসছে ফলে দাঁড়াতে প্রায় হল-ই না। এগুলো ছ জনের- ফলে আমরা চারজন ও আর একটি চীনা পরিবার উঠলেন।
আধঘন্টা পর এই পথ শেষ হল, দেখলাম উঠে এসেছি পাহাড়ের মাথায়। ওপরের ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে দেখে অবাক- নীচে থেকে রাস্তা বানানো হয়েছে পাহাড়ের ওপরে ওঠার- সেই রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিরানব্বই খানা বাঁক নিয়ে উঠেছে। চীনে নয় নাম্বারটি শুভ- তাই এখানে অধিকাংশ জিনিষেই নয় এর খেলা। ওপর থেকে বাঁকগুলো দেখা যাচ্ছে- মনে হচ্ছে যেন কোনো অতিকায় সরীসৃপ পাহাড় পেঁচিয়ে আছে।


চিত্র-৭৭


ভিউ পয়েন্ট থেকে সৌন্দর্য আহরণের পর চললাম দেড় কিলোমিটার ক্লিফ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে প্রদক্ষিণ করতে। দারুণ কর্মকুশলী বলতে হবে- পাহাড়ের গায়ে কত যে রাস্তা, আর কত যে প্ল্যাটফর্ম তার ইয়ত্তা নেই। তবে এই পথে কোনো ওঠানামার খেলা নেই, যেটা আমার পক্ষে ভালো। ফলে আরামেই যাওয়া যাচ্ছে। আজ আবহাওয়াটিও মনোরম, সুন্দর রোদ আছে। ফলে ফটো তোলার বাধা নেই।
দেড় কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে আমরা এলাম একটা স্টেশন টাইপ জায়গাতে। জেন বলল, এটা হচ্ছে তিয়েনমেন গুহা যাওয়ার এসকালেটর স্টেশন। অনেকগুলো এসকালেটর, একের পর এক- মোট সাতখানা। তোমরা একটা থেকে নামবে, আর পরেরটা ধরবে, যতোক্ষণ না এই সাতটা শেষ হয়।
খুব সুন্দর ব্যাবস্থাপনা। প্রতি এসকালেটর অন্তত একশো মিটার নেমেছে। ওপরে ও নীচে হেডফোন ও স্পিকার লাগিয়ে এমারজেন্সী স্টপের কাছে কোম্পানীর মেয়েরা দাঁড়িয়ে, একটু এদিক ওদিক হলেই সতর্ক করে দিচ্ছে। চীনে সেলফি তোলা এতো জনপ্রিয় তাই ভয়টা বেশী। একজনও মুহূর্তের অসাবধানতায় পড়ে গেলে বিরাট দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে, তাই এই ব্যাবস্থা।
একের পর এক এসকালেটর নামছ আর ভাবছি কি অসম্ভব পরিকল্পনা থাকলে পাহাড়ের মাঝে এরকম এসকালেটর বানানো সম্ভব হয়। কখনও এসকালেটর আবার পাহাড়ের গুহার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সাতখানা এরকম এসকালেটরে প্রায় সাতশো মিটার নেমে এলাম দুই পাহাড়ের খাঁজে এক বিরাট চত্তরে। এই দুই পাহাড় যেখানে মিলেছে সেখানে কালের নিয়মে, হাওয়ার তেজে এক বিরাট গহ্বর বা গুহার সৃষ্টি হয়েছে। তারই নাম তিয়েনমেন কেভ, যাকে ডাকা হয় “হেভেনস ডোর” বলে, কেননা এটা মনে করা হত স্বর্গে যাওয়ার দরজা। এই চত্তর থেকে ৯৯৯ খানা ধাপ বিশিষ্ট এক সংকীর্ণ সিঁড়ি গেছে গুহার মুখ পর্যন্ত। এখন তার প্রবেশ পথ বন্ধ, বিশেষ অনুষ্ঠানে তা খোলা হয়। কেভের মুখের সাইজ হল ৬০ মিটার গভীর, ১৩২ মিটার লম্বা ও ২৭ মিটার চওড়া। এই চত্তরে বেশ কিছু ফটোগ্রাফ সহ পোষ্টার আছে। ১৯৯৯ সালে এই গুহার ফুটো দিয়ে এক দুঃসাহসী রাশিয়ান পাইলট প্লেন নিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া প্রচুর অভিযান হয়েছে এই চূড়োয় ওঠার। একটা ছোট জলপ্রপাতও আছে এই কেভে যাওয়ার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গাতে। এই সিঁড়ি দেখেই আমাদের মাথা ঘুরছে- লোক উঠতো কি করে কে জানে।


চিত্র-৭৮, ৭৯


হেভেনস ডোর দেখার পর আবার নামা, আবার এসকালেটর – আরো পাঁচখানা, ভাবা যায়- দুই পাহাড়ের মাঝে বারোখানা এসকালেটর লাগিয়ে বসে আছে চীনারা!
এসকালেটরে নামার পর ধরলাম পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা কেবিল কার। এক একটা কেবিনে ২৬ জন ধরে। কেবিল কারের পথ বিশাল লম্বা – প্রায় সাত কিলোমিটার- সাধে কি আর বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা কেবিল কারের শিরোনাম পেয়েছে! আবার সেই পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে বানানো কেবিল কারের পথ- অসাধারণ প্রযুক্তির আর এক উদাহরণ। আর দৃশ্যাবলী তো নতুন করে বলার নয়, একই রকম সুন্দর। শেষ দেড় কিলোমিটার কেবিল কার চলল ৩৭ ডিগ্রী কোনে – ভাবা যায়! যেন হেলে যাচ্ছি ।
বেলা আড়াইটে নাগাদ আমরা বেরিয়ে এলাম তিয়েনমেন মাউন্টেন পার্ক এলাকা ছেড়ে। শহরে এসে কিছু খাওয়া হল প্রথমে। তারপর গাড়িতে এলাম জ্যাঞ্জিয়াজি এয়ারপোর্ট।
আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল সাংহাই- যা এখান থেকে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার- তাই প্লেনে যাওয়া। গাড়িতে এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে জেন দুঃসংবাদ শোনালো- আমাদের ফ্লাইট রাত ৯-১৫ র জায়গায় ছাড়বে রাত ১০-৪৫। সর্বনাশ, তাহলে তো মাঝরাতে সাংহাই আসবে। থাকবে তো আমাদের টুর গাইড আর গাড়ি? জেন ভরসা দিলো- বলল ওখানে মেসেজ করা হয়েছে, ফ্লাইট যতোই দেরী হোক না কেন, এয়ারপোর্টে লোক থাকবে।
ভেবেছিলাম জ্যাঞ্জিয়াজি ছোট এয়ারপোর্ট – কিন্তু ভিতরে দেখে অবাক। বিরাট এয়ারপোর্ট । চীনের অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও অজস্র সিকিউরিটির চেকিং। কিন্তু যথারীতি খুব তাড়াতাড়ি সব সাঙ্গ হল। চেক ইন করে ভিতরে যখন এলাম, তখন সাতটা বাজে। এবারে অনন্ত প্রতীক্ষা। ভয় ছিল ফ্লাইট ক্যানসেল না হয়, কিন্তু সে ভয় অমূলক। ঘন্টা তিনেক ম্যাসাজ চিয়ারে বসে আরাম করা গেলো। অবশেষে রাত দশটায় বোর্ডিং এর ডাক পাওয়া গেলো। সব আসনই ভর্তি। দেড়ঘন্টার পথ, অনেকটা ঘুমিয়েই গেল। রাত বারোটায় প্লেন এল সাংহাই এয়ারপোর্ট। এটা আরো বড়ো, প্লেন থেকে নেমে হাঁটছি তো হাঁটছিই –লাগেজ পেতে মিনিট পনেরো হাঁটতে হল। বাইরে বোর্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিল সাংহাই এর গাইড উইলিয়াম বা উইলি। আমরা রাত একটায় এলাম হোটেল- নাম সানরাইজ অন দি বেন্ড। কোনোরকমে মালপত্র রেখে শোওয়া, কাল বেরুতে হবে সকাল দশটায়- উইলি বলেছে ও লবিতে অপেক্ষা করবে।
পরদিন- ব্রেকফার্স্ট খেয়ে উইলির সাথে গাড়িতে চাপলাম। সাংহাই বিরাট শহর- চারদিকে বিশাল উঁচু উঁচু টাওয়ার- কোনো বাড়িই পঞ্চাশ তলার কম নয়। রাস্তায় ট্রাফিক প্রচুর, বড়ো শহরে যা হয় আর কি। প্রথমে আমরা এলাম আধঘন্টার রাস্তা য়ুয়ুয়ান গার্ডেন( Yuyuan garden) – ১৫৫৯ সালে মিং সাম্রাজ্যের সময় তৈরি এই প্রাইভেট বাগান। বেশ কিছু রক গার্ডেন, পুল, করিডর আছে – আহামরি কিছু নয় – কিন্তু ঐ টিপিকাল চাইনীজ আর্কিটেকচার আর স্টাইল মেশানো পুরানো স্তাপত্য দেখতে ভালোই লাগে।
য়ুয়ুয়ান গার্ডেনের পাশেই বিরাট বাজার-য়ুয়ুয়ান বাজার। প্রাচীন কাল থেকে এই বাজার আছে। বিভিন্ন শিল্পকলা, খেলনা, পুতুল, খাবারদাবার সব মিলে এই বাজার জমজমাট। ক্যালকুলেটরে দর কষাকষির খেলা দেখি সব জায়গাতেই চলছে। এখানে আসলে বিদেশী আসে অনেক বেশী- কাজকর্মের জন্য সাংহাই বিখ্যাত, তাই বিদেশীদের উপস্থিতি অনেক বেশী।
মার্কেট দেখার পর গাড়ি করে এলাম বান্ধ এলাকায়। বান্ধ হচ্ছে ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকা- Huangpu (হুয়ানপু) নদীর ওপর গড়ে উঠেছে শহর- প্রায় একশো দেড়শো বছর ধরে- এখানে আছে অজস্র স্কাইস্ক্যাপার । পশ্চিমপ্রান্তে অজস্র ঐতিহাসিক বাড়ি আছে- যার মধ্যে ৫২ খানা বাড়ি বিখ্যাত। আর অপরপ্রান্তে সুউচ্চ সব অট্টালিকা- যার মধ্যে আছে ১১৪ তলার পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম বাড়ি। বান্ধে বিরাট চওড়া ফুটপাত- বহু লোক অলস ভঙ্গীতে হাঁটছে। টুরিস্টরা ছবি তুলছে যথেচ্ছ, কোথাও বা গান বাজনা হচ্ছে। সব মিলে বলা যায় এটা শহরের প্রাণকেন্দ্র।


চিত্র-৮০

বান্ধ দেখার পর খেতে যাওয়া হল সাংহাই এর এক নামকরা রেস্তোরাঁয়। খাবারের মান অন্যবদ্য, কিন্তু যেটা নতুন দেখলাম তা হল রেস্তোরাঁয় রয়েছে বিরাট বিরাট বিছানা- সাদা ধপধপে চাদর আর বালিশ পাতা। খেয়ে দেয়ে এখানে তুমি শুয়ে নিতে পারো। কয়েকজন দেখলাম শুয়েও আছে। জনা দুই তো গভীর নিদ্রামগ্ন।
খাওয়ার পর গাড়িতে এলাম ফ্রেঞ্চ কলোনী। যখন চীনে বহু বছর আগে ফরাশীরা ছিলো, তারা এখানে থাকতো। এখন সব চলে গেলেও ঐতিহাসিক বাড়ি গুলি আজও অটুট। অধিকাংশ বাড়িই ১০০ বছরের বেশি পুরানো। অনেক নামকরা দোকান, বাজার ও রেস্তোরাঁ আছে এই অঞ্চলে। দেখলাম চাইনীজ লীডার সান ইয়াত সিন এর বাড়িও এই অঞ্চলে।

চিত্র- ৮১


ফ্রেঞ্চ কলোনীর পর গাড়ি নিয়ে বান্ধ এলাকা পেরিয়ে এলাম সাংহাই টাওয়ারে চড়বো বলে। ৬৩২ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি পৃথিবীর দ্বিতীয় উঁচু বাড়ি। ১২৮ তলা বাড়ির ১২৩ তলা মাটির ওপরে ও পাঁচতলা মাটির তলায়। এখানে ওঠার যে লিফট সেটা পৃথিবীর দ্রুততম। নিমেষের মধ্যে ওপরে উঠে গেলো। ৬৭ ফুট প্রতি সেকেন্ডে ওঠে এই লিফট ফলে এক মিনিটের কম সময়ে উঠে গেলাম।
আজ আবহাওয়া অতোটা পরিষ্কার ছিলো না আর সাংহাই টাওয়ায়ের দু হাজার ফুট ওপরে উঠে তো মেঘ ছাড়া কিছুই দেখতে পেলাম না। চাপ চাপ মেঘ পুরো বাড়িটার মাথায়। উইলিয়াম জানালো পুরোটা ক্লিয়ার পাওয়া ভাগ্যর কথা।


চিত্র-৮২, ৮৩

সাংহাই টাওয়ারের সাথে সাথে আমাদের চীন ঘোরা সম্পূর্ণ হল। এবার ফেরার পালা। পরদিন ছিলো লন্ডন ফেরার ফ্লাইট। সাংহাই অনেক পূর্বে, ফলে জীবনের অন্যতম দীর্ঘ ফ্লাইট- ১৪ ঘন্টা প্লেনে বসে আবার সেই লন্ডন, আবার পুরানো জীবন। হৃদয়ে গাঁথা রইল চীনের স্মৃতি মধুর দিন গুলি।

(সমাপ্ত)

[তৃতীয় ভাগ]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, নভেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]