দ্বিতীয় ভাগ (গত সংখ্যার পর থেকে)

পরের দিন- সকালে জলখাবার খেতে না খেতেই হেলেন হাজির। বলল, আজ লম্বা প্রোগাম। প্রথমে যাব টেম্পেল অফ হেভেন। এখানে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে যাব তিয়ানানমেন স্কোয়ার     (Tiananmen square), সেখান থেকে ফরবিডন সিটি দেখে ফেরা। সব মিলে কিন্তু অনেক হাঁটা- পা ঠিক আছে তো? প্রচুর হাঁটা? শিউরে উঠলাম- কালকের ঐ ধকলই এখনও শরীর নিতে পারে নি, আজ কি হবে? দীপা বলল, গাড়িতে যতোটা পারো বসে নাও, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যাবস্থা।

গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি গত দু দিনের গাড়ি তো এটা নয়, এ তো অন্য গাড়ি। হেলেনকে বললাম, তোমার আগের গাড়ি কি দোষ করল যে একে পাল্টালে? হেলেন বলল, আর বলো কেন, সরকারের নিয়ম – বেজিংতে আজ শুধু পিছনে দুই আর ছয় আছে নাম্বারে, এমন গাড়িই রাস্তায় বেরুতে পারবে। আসলে গাড়ি প্রচুর, তুলনায় রাস্তা কম, তাই সরকারের এই নিয়ম। একমাত্র শনি রবিবার যে কোনো গাড়ি রাস্তায় চলতে পারে। সপ্তাহের অন্য দিনে নাম্বার অনুযায়ী গাড়ি চলবে। তবে তাতেও দেখলাম না ট্রাফিক কিছু কম বলে। তাহলে সবকটা একসাথে বেরুলে কি হত!

বেশীক্ষণ গাড়িতে বসা গেল না- মিনিট কুড়ি পরে বিশাল পারকিংতে জুলিয়া থামল। হেলেন বলল, এসে গেছি আমরা- টেম্পল অফ হেভেন।

বিশাল জায়গা- ২৭৩ হেক্টর জায়গার অধিকাংশই পার্ক। তার মধ্যে অনেক গুলি হেলথ পার্কও আছে, যেখানে অনেক লোক ব্যায়াম করছে, কেউ বা দৌড়াচ্ছে। একদল বৃদ্ধ বৃদ্ধা দেখলাম গানের সাথে হালকা নাচ কাম ব্যায়াম করছে। হেলথ পারকে আমরাও একটু শরীরটা নাড়িয়ে নিলাম, উদ্দেশ্য যদি ব্যাথা বেদনার থেকে কিছুটা মুক্তি মেলে। তারপর ধীরে ধীরে এলাম মন্দির চত্তরে।

চিত্র-১০

এখানেও দেখি ট্রাডিশন্যাল ড্রেস পরে অনেকে ঘুরছে।

চিত্র-১১

১৪২০ সালে বানানো মিং আমলের এই মন্দিরের শোভা অতুলনীয় । এই মন্দিরের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভাল ফসলের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানানোর। এই অধিকার বলা হত শুধু রাজবংশর, তাই সম্রাটই এখানে বছরে দু বার এসে প্রার্থনা জানাতেন। সাধারণ মানুষের কাছে এর দোর ছিল বন্ধ।

১৯০০ সাল পর্যন্ত এখানে পুজো হয়েছে, প্রার্থনা হয়েছে, মিং এর পর কিন সাম্রাজ্যও এই প্রার্থনা পুরোদমে চালিয়ে গিয়েছেন।

১৪২০ সালের এই মন্দির অনেক ছোট ছিল, কিন্তু পরবর্তী সম্রাটরা এর কলেবর আস্তে আস্তে অনেক বাড়িয়েছেন। এখন এর বিরাট উঁচু চাতাল, অনেকটা জায়গা জুড়ে, ওঠার জন্য অজস্র সিঁড়ি। মন্দিরের চূড়া বিরাট বড়ো আর দারুন কারুকার্য মন্ডিত। ভিতরেও প্রচুর রঙ বেরঙ্গের কাজ- দেখার মত ভাস্কর্য।

চিত্র-১২, ১৩

মন্দিরের চাতালে উঠে ও খানিক ঘুরে ঘুরে দেখতেই ব্যাথা বেদনা আবার ফিরে এল। হেলেন বলল, চলো, এখানে যা ছবি তোলার তুলে আমরা পরের জায়গায় যাই, কেননা অনেক হাঁটা আছে।

চিত্র-১৪

আবার গাড়িতে চাপলাম, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, সবে পায়ের ওপর পা-টা তুলেছি, আরাম করে বোতল থেকে জল খাচ্ছি- জুলিয়া গাড়ি থামাল আর হেলেন বলল, আর গাড়ি যাবে না, বাকিটা হাঁটতে হবে।

নেমে দেখি অজস্র লোক হাঁটছে- সবারই লক্ষ্য তিয়ানানমেন স্কোয়ার। মনে পড়ে গেল, বহু বছর আগে সি পি এমের ব্রিগেডে মিটিং থাকলে যেমন দলে দলে লোক হেঁটে ব্রিগেড যেত- এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। ফুটপাথ বিরাট বিরাট ব্যারিয়ার করে আটকানো, রাস্তা শেষ হয় না কিন্তু লোকও ক্রমে বেড়ে বেড়ে অনেকটা শ্রীভূমি বা সুরুচি সংঘর দূর্গাপূজার ভিড়ের মত হয়েছে। হেলেনকে বললাম, এখানে এত লোক রোজ আসে? হেলেন জানাল, আজ তো অনেক কম, অন্যদিনে বা ছুটির দিনে এখানে ভিড় উপছে পড়ে, ঢুকতেই ঘন্টা দুই লেগে যায়। তা ছাড়া এখান দিয়েই লোকে ফরবিডন সিটিতে ঢুকে যায়- বলা যায় এক যাত্রায় দুই তীর্থ দর্শন।

প্র্যয় চল্লিশ মিনিট বিভিন্ন ফুটপাথে বিভিন্ন ব্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে এলাম তিয়ানানমেনের গেটে। এখানে আবার পাসপোর্ট স্ক্র্যান করে ঢোকা। বিরাট এক জায়গা- বিরাট চত্তর। এটা হল পৃথি্বীর সবচেয়ে বড়ো স্কোয়ার। ত্রিশ বছর আগে এই স্কোয়ারেই চীনের ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয় এবং প্রায় দশ লাখ লোক এখানে অবস্থান করেছিল। এই বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশের গুলি চললে বহু লোক মারা যান। এককালে এ নিয়ে কতোই না শুনেছি, আজ সেই ঐতিহাসিক স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে গা ছমছম।

চিত্র-১৫

বিরাট এই স্কোয়ার আস্তে আস্তে দেখা শুরু করলাম। মাঝে আছে পিপলস হিরোদের স্মৃতিস্তম্ভ। এছাড়া একদিকে আছে মাও সে তুং এর সমাধি, গ্রেট হল অফ দি পিপল, চীনের জাদুঘর।

চিত্র-১৬,১৭

অন্যদিকে আছে বিরাট এক দেখার মত গেট- যার নাম “গেট অফ হেভেনলি পিস”, যেটা পার হলেই ফরবিডন সিটির শুরু । আর এর পাশে আছে বিরাট এক হল- যেখান থেকে ১৯৪৯ সালে ১লা অক্টোবর মাও সে তুং “পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না”-র ঘোষণা করেন।

অজস্র লোক, সবাই ছবি তুলতে ব্যাস্ত। হেলেন বলল, তিয়ানানমেনে সদাই গাদা গাদা লোকের সমাগম, সারা চীন থেকে লোক এখানে আসে। চল তাহলে ফরবিডন সিটিতে ঢুঁ মারা যাক।

“গেট অফ হেভেনলি পিস” দিয়ে ঢুকলাম। আবার এক বিশাল চত্তর ও তার অপর প্রান্তে আবার একটি দেখনদার গেট।

চিত্র-১৮

পরে দেখেছিলাম, এখানে এরকম একের পর এক গেট পেরিয়ে, বিরাট বিরাট চত্তর পেরিয়ে তবে ফরবিডন সিটির কেন্দ্রস্থলে যাওয়া যায়। সাধে কি আর একে নিষিদ্ধ নগরী বলে! এখানে ঢোকা সে যুগে অসম্ভব ছিল- এতে সম্রাটের নিরাপত্তা বজায় থাকত।

হেলেন বলল, এখানে প্রচুর হাঁটা, তাই থেমে থেমে যাওয়া যাক। এক জায়গায় বসলাম। হেলেন বলল, ১৩০৮ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত এই ছশো বছর ধরে চীনের জনা চব্বিশ জন সম্রাট ও তাঁদের পরিবারের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল ছিল এই নগরী। এখানে সম্রাটের অনুমতি বিনা ছিল প্রবেশ নিষেধ। এ এক বিরাট জায়গা- ৯০ টার বেশি প্রাসাদ, ৯৮০ খানা চত্তর ও ৯৯৯৯ ১/২ খানা ঘর আছে়। ৯৯৯৯ ১/২ খানা ঘর কেন? কেন আধখানা ঘর আর কেনই বা এতো ঘর? হেলেনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল, এরা মনে করতো, স্বর্গের দেবতারা যে প্রাসাদে থাকেন, সেখানে ১০০০০ ঘর আছে, কাজেই সম্রাটের তার থেকে কম থাকা উচিত, না হলে দেবতারা রুষ্ট হবেন। ইনি সম্রাট বলে কথা- দেবতার পরেই এনার স্থান, তাই ৯৯৯৯ ১/২ খানা ঘর।

 সামগ্রিক ভাবে এর দুটো ভাগ- দক্ষিণ ভাগে সাধারনত অফিসিয়াল কাজ আর বিচার টিচার হত। উত্তরভাগটা সম্রাট ও তাঁর পরিবারের।

This image has an empty alt attribute; its file name is China-19.jpg

চিত্র-১৯

ফরবিডন সিটি হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো প্রাসাদ চত্তর। এখানে বিরাট বিরাট কাঠের কাজ আর স্ট্রাকচার আছে দেখার মত। চোদ্দো বছর লেগেছিল এটা বানাতে- যেটা বেশ শক্ত।

বাইরের চত্তর বা কোর্টগুলোয় ইচ্ছা করে কোনো গাছ রাখা হয় নি নিরাপত্তার কথা ভেবে। বিভিন্ন স্তাপত্যর চূড়াগুলো এমনভাবে ডিজাইন, যাতে পাখি না বসতে পারে, ফলে মাথাগুলো ঝকঝক করছে।

চিত্র-২০

যাই হোক, এগিয়ে যাচ্ছি চত্তরের পর চত্তর, বাড়ির পর বাড়ি- একটা একটা করে চত্তর পেরুচ্ছি, প্রথমে গেলো কাজের বাড়িগুলো বা ওয়ারকিং বিল্ডিং, তারপর সম্রাটের কাজের বাড়ি, তারপর বেশ কিছু প্রাসাদ, তারপর রাণীর প্রাসাদ ও তাঁর ওয়ারকিং বিল্ডিং, রাজার সেবিকা বা কনকুইনদের বাড়ি, সম্রাটের প্রাসাদ ও সবশেষে হচ্ছে বাগান।

চিত্র-২১,২২

ভিতরে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হাঁটা হল। এ যেন এক আলিবাবার গুহা- একের পর এক দরজা খুলে যচ্ছে আর নতুন এক রূপ যেন উন্মোচিত হচ্ছে। বেলা বারোটায় শুরু করেছিলাম, আড়াইটেয় যখন বাগানে ঢুকলাম, তখন ক্লান্ত, অবসন্ন। কিন্তু পুরোটা দেখা হয়েছে, এতেই সুখ। হেলেন বলল, এখানে একটু বসে নিয়ে আমরা বেরুব- আমরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জীবনে অনেক প্রাসাদ দেখেছি, কিন্তু এরকম প্রাসাদের পর প্রাসাদ, কোনোদিন দেখিনি। আর প্রতিটি বাড়ি, গেট, তোরণ তাদের কি অপূর্ব কারুকার্য! দেখে মন ভরে যায়। এরা রেখেছেও ভালো- সব ঝকঝক করছে- যেন নিত্য এটা ব্যাবহার হয়।

হেলেন একটা কথা বলল। বলল, ১৯১১ সালে যখন রাজার আমল শেষ হয়ে কমিউনিষ্টরা দেশের দখল নিল, তখন মাও সে তুং তৎকালীন শেষ সম্রাটকে বলেন- রাজা, এবার যে তোমায় কাজ করতে হবে। দেশের সব মানুষই কাজ করবে, সেখানে তুমি বসে থাকবে রাজপ্রাসাদে সেটা কি ভাল লাগবে? তার চেয়ে তুমি বল, তুমি কি করতে পারবে। রাজা বলেন- আমি তো অন্য কিছু করি নি, জানিও না, কিন্তু প্রাসাদের বাগান আমার খুব ভালো লাগে, এখানকার গাছপালা আমার সন্তানের মতো, এদের যদি আমি যত্ন করি, দেখভাল করি? মাও বলেন, তাহলে তুমি এই দায়িত্বটা নাও- বাগানের রক্ষনাবেক্ষণ তোমার ওপর ভার দিলাম। রাজার শেষ জীবন ঐ কাজেই কাটে- এক সাধারণ মালীর জীবন। এই নিয়ে উনি একটা বইও লিখেছেন- “From empior to Citizen”—পারলে বইটা পড়ে নিও। পরে ফিরে এসে এখানকার লাইব্রেরীতে বইটা পেয়েছি, এখন পড়া শুরু করেছি। কি ভাবে সম্রাট তাঁর ঐ রাজার জীবন থেকে সাধারণ মানুষের জীবনে নিজেক মানিয়ে নিলেন- বিশদ জানার আগ্রহ আছে।

বেলা তিনটেয় বেরুলাম। দীপা ডাম্পলিং খেতে চাইছিল বলে হেলেন নিয়ে এল বেজিং এর এক বিখ্যাত রেস্তোঁরায়, যার ইংরাজি নাম “ডাম্পলিং কুইন”। এখানে খান তিনেক বিভিন্ন রকমের ডাম্পলিং, সাথে ফ্রায়েড রাইস খাওয়া হল। ক্ষিদেও পেয়েছিল- আজ প্রায় দশ কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে, পা আর চলছে না। হেলেন ও জুলিয়া হোটেলে যখন নিয়ে এল, বিকাল সাড়ে চারটে। চান করে বিছানায় শুয়ে আরাম মিলল। ঠান্ডা হাওয়া হলে আরো আরাম পেতাম। কিন্তু চীনে সব হোটেলেই দেখছি বাইরের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রী না হলে এরা এ সি চালায় না- শুধু ফ্যানটা চলে। ফলে বিকালের দিকে গরম লাগে, আবার রাতের দিকে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়। সব হোটেলই মালটিস্টোরেজ ফলে জানালাও খোলা যায় না। খানিক শুয়ে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হল শরীর।

হেলেন জানিয়ে গেছে কাল সকাল সাড়ে আটটায় আসবে- বলল, চেক আউট করে মাল নিয়ে তৈরি থাকতে- কাল এখানকার বাকি দ্রষ্টব্য দেখে চলে যাব ১১০০ কিলোমিটার দূরের সিয়ান শহরে।

চতুর্থ পর্ব – বাকি বেজিং (সামার প্যালেস)  দেখে  রাজার হালে সিয়ানের পথে

পরের দিন। শরীর ফ্রেশ, মন-ও। এখানে তিনদিন এসেছি কিন্তু কাল প্রথম ভাল ঘুম হয়েছে। বলা যায় সাত ঘন্টা জেট ল্যাগের অবসান হল। আজ আমাদের অনেক কাজ। প্রথমত নিজেদের তৈরি করা বেরুবার জন্য, দ্বিতীয়ত সুটকেস গোছানো- তিনদিন এখানে আছি, ফলে জিনিষ ছত্রখান হয়ে আছে। তাদের আবার ঠেলেঠুলে ঢোকানো হল। অনেকগুলো এডপটার এদিক ওদিক লাগানো ছিল, সেগুলো পুরলাম। ওগুলো প্রাণ মোবাইল, ক্যামেরার, আর এ সব ছাড়া এ যুগে অচল। চীনে একটা সুবিধা- এখানে দু রকম ইলেকট্রিক প্লাগ চলে- একটা ইউরোপিয়ান টাইপ আর আর একটা অস্ট্রেলিয়ান টাইপ- দুটোই পর্যাপ্ত পরিমাণে এনেছি ফলে অসুবিধা হয় নি। চীনের হোটেলে আর একটা জিনিষ দেখে ভালো লেগেছিল- সেটা হল  ঘরে বাইরে অজস্র প্লাগ পয়েন্ট ।

যাই হোক, সব গুছিয়ে জলখাবার খেয়ে চেক আউট করলাম। হেলেনরা এসে গেছে। আবার ধরাধরি করে সুটকেশগুলো গাড়িতে তোলা হল। হেলেন জানাল আজকের দিনলিপি- বলল, প্রথমে গাড়ি করে যাব ১২ কিলোমিটার দূরের সামার প্যালেস, তারপর তোমাদের তুলে দেব সিয়ানের ট্রেনে। সিয়ানে ট্রেন থেকে নেমে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে ওখানকার গাইড। সিয়ানে ওরা তোমাদের দায়িত্ব নেবে।  এই বলে হেলেন একটা কাগজ দিল- যাতে লেখা আছে আমাদের বাকি ট্রিপের সব গাইডদের নাম ও ফোন নাম্বার। দেখলাম সিয়ানে আমাদের গাইডের নাম লিলি। এখানে হোয়াটস এ্যাপ ব্যান্ড, তার বদলে এদের নিজস্ব app “WeChat”, সেটা চলে।  ফলে হোয়াটস এ্যাপ -এর সাহায্য পাব না। এছাড়া  গুগুল ও এখানে ব্যান্ড, তার বদলে নিজেদের search engine  চলে, আর ভিপিএন অনেক সময়ই কাজ করে না,ফলে গুগল পাওয়া ভাগ্যর ওপর। আর হ্যাঁ, ভাষা  এখানে একটাই, চাইনিজ, তাই সব কিছু হেলেন ইংরাজি আর চাইনিজে লিখে দিয়েছে- যাতে লিলিকে না পেলে অন্য কাউকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারি।

হেলেন বলল, ট্রেনে একটা জিনিষ পাল্টেছে- সেটা ভালো আবার কিছুটা মন্দ।

-কিরকম? আমরা জিজ্ঞাসা করলাম।

ভালো খবর হচ্ছে ট্রেনে তোমাদের ফার্স্ট ক্লাস থেকে বিজনেস ক্লাসে উন্নত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তোমরা তিনজনে আলাদা আলাদা কেবিনে শুয়ে বসে যেতে পারবে। আর সাথে পাবে ফ্রি ডিনার।

-আর মন্দটা কি? ডোরার প্রশ্ন।

মন্দটা হল – একটা সীট অন্য কোচে- মানে একজনকে অন্য কোচে বসতে হবে, যদিও কোচগুলো পাশাপাশি। তবে চিন্তা করো না- আমি এ্যাটেনন্ডেন্টকে বলব, যদি অন্য কারুর সাথে পালটানো যায়।

একটু খারাপ খবর বটে- কেননা আমি অন্য কোচে, কিন্তু পরে দেখেছিলাম কোনো অসুবিধাই হয় নি। কেননা ট্রেনের স্ক্রীনে ইংরাজিতে লেখা আসছিল, ফলে কোন স্টেশন আসছে আর পরের স্টেশন কি সেটা বুঝে যাচ্ছিলাম। সে কথায় পরে আসছি, আপাতত সামার প্যালেস নিয়ে লেখা যাক। সাতশ’ একরেরও বেশি জায়গা জুড়ে একটি সুন্দর পার্কল্যান্ডের মধ্যে অবস্থিত। এটি চীনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। প্রাসাদটি ১১৫৩ সালে নির্মিত হয়েছিল। এরপর ইউয়ান, মিং ও ছিন রাজবংশের সময় গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্থাপনা। পরে এখানে এক বিরাট কৃত্রিম  হ্রদও বানানো হয় যেটা প্রাসাদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।

এর বিশাল হ্রদটি ১৪ শতকের ইম্পেরিয়াল গার্ডেনগুলোকে আরও সুন্দর এবং আকর্ষণীয় করার জন্য বানানো হয়েছিল। গ্রেট থিয়েটার এবং তিনতলা কাঠামো বিশিষ্ট হল ১৮৯১ সালে ইম্পেরিয়াল পরিবারের অপেরার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক থিয়েটার এখনও ঐতিহ্যবাহী চীনা নাটক এবং বাদ্যযন্ত্রের অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

হেলেন জানালো, এই যে বিরাট প্রাসাদ এলাকা, এটা আসলে ১৭৫০ সালে বানানো। সম্রাট কিউএনলং এর আমলে। কিন্তু এর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায় ও পুড়ে যায় ১৮৬০ সালের যুদ্ধে। তারপর বেশ কিছুদিন ওভাবেই পড়ে ছিল। আর এখানেই এসে যায় দোয়াগার সিক্সি (Dowagor Cixi) র কথা।

সিক্সি ছিলেন তৎকালীন চীনের সম্রাট সিয়ানফেং(Xianfeng) এর প্রিয় উপপত্নী বা কনকুবাইন। সম্রাটের কোনো ছেলেপুলে হয় নি। বহু প্রচেষ্টা স্বত্তেও সম্রাট বাবা হতে পারেন নি, কিন্তু সিক্সি রাজার সাধ পূর্ণ করেনা ১৮৫৬ সালে সিক্সির ঔরসে সম্রাট পিতা হলেন আর তারপর থেকে সিক্সির ক্ষমতা প্রভুত বেড়ে যায়। ১৮৬২ সালে সম্রাট মারা গেলে সিক্সি তাঁর ছ বছরের ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে বকলমে নিজে রানী হয়ে দেশ চালাতে থাকেন।  কিন্তু সম্রাটের ভাই এটা মেনে নিয়ে পারেন নি। দেশ জুড়ে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। পরে রাণী রাজার ভাইকে দলবল শুদ্ধু মেরে বিদ্রোহ দমন করে সম্রাজ্ঞী হয়ে বসেন। রাণীর তখন প্রভুত ক্ষমতা।  ওনার ইচ্ছা হয় এই সামার প্যালেসকে নিজের মতো করে আবার বানাতে। কিন্তু এর জন্য প্রচুর টাকার দরকার- উনি  অন্যান্য খরচা কমিয়ে রাজস্বর বিরাট অংশ এই প্রাসাদ বানানোতে খরচা করেন। এর ফলে প্রাসাদ সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে গড়ে ওঠে বটে, কিন্তু টাকার অভাবে সিনো-জাপানি যুদ্ধে (১৮৯৪-৯৫) ওনার পরাজয় ঘটে। তবে উনি চীনের প্রথম নারী, যিনি বুঝিয়ে ছিলেন মেয়েরাও কম নয়- প্রয়োজনে ওরা পুরুষের থেকেও অনেক বড়ো হয়ে পারে। আর তার প্রকাশ এই সামার প্যালেসে।

এই অমর সৃষ্টি ১৯১২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সম্রাটদের হাতেই ছিল, কিন্তু ১৯১২ সালে কমিউনিষ্ট অভ্যুথানে কিন সাম্রজ্যের পতন ঘটে ও এটা সরকারের হাতে চলে যায়। দু বছর পর সরকার এটা জনগনের কাছে উন্মুক্ত করেন আর তারপর থেকে এটা খোলা সবার জন্য।

বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই প্রাসাদ এলাকা- প্রায়  ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই পার্কে রয়েছে লেক, দ্বীপ, পাহাড় ও অনেকগুলো প্রাসাদ। ‘লংজিভিটি হিল’, ‘কুনমিং লেক’,  গ্রীষ্ম প্রাসাদ, হল অফ ক্লাউডস, লং করিডর সহ রয়েছে অনেকগুলো স্থাপনা। ভিতরে ঢুকে প্রথমেই এক বিরাট উঁচু টাওয়ার- নাম টাওয়ার অফ বুদ্ধিস্ট ইন্সেনস(Tower of Buddhist Incense)। আসলে সিক্সি ছিলেন ভগবান বুদ্ধের খুব বড়ো ভক্ত। তাই বছরে দুবার এখানে আসতেন প্রার্থনা জানাতে। এরপর একে একে দেখলাম  গেট অফ ডিস্পেলিং ক্লাউড, হল অফ ডিস্পেলিং ক্লাউড (Hall of Dispelling cloud)। এই গেট বা হলের কাজ অভূতপূর্ব ।

চিত্র-২৩,২৪,২৫

কিন্তু যা মন কেড়ে নিল, তা হল লং করিডর। কৃত্রিম হৃদ কুন মিং (Kunming) এর ধারে ৭২৮ মিটার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা করিডর চলে গেছে বাগান ও লেক ঘেঁষে। কাঠের অপূর্ব কারুকার্য করা করিডরে আছে অজস্র ভাস্কর্য ও পেন্টিং। প্রায় ১৫০০ পেন্টিং আছে এই করিডরে, ভাবা যায়! মাঝে মাঝে রয়েছে বসার ব্যবস্থাও। বিভিন্ন রঙ বেরঙ্গের পেন্টিং দেখা- সামনে কুনমিং লেকের নীল জল- সে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।

চিত্র-২৬, ২৭

লং করিডর দেখে বেরুবার আগে লেকের ওপর এক আগাগোড়া মারবেলে তৈরী সাদা ধপধপে বাড়ী দেখলাম – গড়ন বোটের। মনে হচ্ছে যেন এক নৌকা।

চিত্র-২৮, ২৯

এই সব দেখে কখন যে এগারোটা বেজেছে জানি না, হেলেন বলল, এবার কিন্তু যেতে হবে, কেননা লাঞ্চ করতে হবে আর তারপর তোমাদের ট্রেনে তোলার পালা। ট্রেন দুপুর দুটোয়, তাই চলো এগুনো যাক।

সাড়ে এগারোটায় এলাম চমৎপ্রদ এক রেস্তোঁরায়। ইন্ডোর রেস্তোঁরা, কিন্তু ভিতরে যেন দারুণ সাজানো এক বাগান। অজস্র গাছ, ফুল, বিভিন্ন দিক থেকে পাখী ডাকছে আর তারই মাঝে গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসার চিয়ার টেবিল। অল্প আলো, যেন মনে হচ্ছে গোধূলিতে বাগানে বসে আছি। অজস্র পাখীর কলকাকলি শুনতে শুনতে যেন এক অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে হেলেন কখন যে অর্ডার করল জানি না, চটক ভাঙল যখন খাবার টেবিলে রাখল। কুনফু চিকেন, চিলি চিকেন, খান দুই ভেজ, স্যালাড, ফ্রায়েড রাইস আর চালগুঁড়ো দিয়ে আমাদের  পিঠের  স্টাইলে বানানো মিষ্টি। সবমিলে দারুন খাওয়া- বেজিং ছেড়ে যেতে যেন মন চায় না।

সব কিছুরই শেষ আছে- সে ভালোই হোক বা মন্দ। বেজিং ছাড়ার পালা এসে গেল। গাড়িতে মিনিট চল্লিশ পরে বেলা একটা নাগাদ এসে গেলাম বেজিং নর্থ স্টেশন। জুলিয়াকে ওখানে বিদায় জানালাম, হেলেন রইল আমাদের সাথে, ও আমাদের ট্রেনে তুলে দেবে। বেজিং থেকে সিয়ান বুলেট ট্রেন। ২-০৫ দুপুরে ছেড়ে ৬-৩০ তে ১১৭৫ কিমি দূরে সিয়াং Xian পৌঁছাবে।

আমাদের টিকিট বিজনেস ক্লাস। ফলে আলাদা কেবিন, আলাদা সবার থেকে, নিজস্ব কেবিন পরিচালিকা। এটি আমার জীবনের সেরা ট্রেন জার্নি।

মালপত্র নিয়ে স্টেশনের ভিতরে ঢুকে হতবাক। এ যেন এয়ারপোর্টের বাড়া। বিশাল জায়গা- ঝকঝক করছে। সামনে এক্স রে মেশিন। ওখানে প্রথমে এক্স রে করে লাগেজ চেক। পরে দেখেছি চীনে সব স্টেশনে ও এয়ারপোর্টে ভিতরে ঢুকতে গেলে প্রথমেই লাগেজ এক্স রে হয়- প্রধানত ড্রাগের জন্য।

মাল চেক হবার পর হেলেন আমাদের বসতে বলল। বলল, পাসপোর্টগুলো দাও- টিকিট বের করে আনি মেশিন থেকে। তিনটে পাসপোর্ট নিয়ে হেলেন চলে গেল, মিনিট দশ পর তিনটে ক্রেডিট কার্ড সাইজের টিকিট নিয়ে এল। তাতে কোচ নাম্বার, সীট নাম্বার ও পাসপোর্ট নাম্বার লেখা আছে। আর আছে কোন স্টেশন থেকে কোন স্টেশনে যাব। দেখলাম লেখা আছে বেজিং নর্থ থেকে সিয়ান বান।

টিকিট সহ হেলেন আমাদের নিয়ে এল বিজনেস লাউঞ্জতে। বিভিন্ন এয়ারপোর্টে যে রকম বিজনেস লাউঞ্জ দেখেছি, এটা অবিকল সেরকম, তবে অনেক বড়ো এরিয়া। অজস্র সোফা, আরাম চেয়ার, শোওয়ার জন্য বেড টাইপ চেয়ার এ সব প্রচুর আছে। হেলেন বলল, চলো কিছু খাবার তুলে নিই, বলে এক জায়গাতে নিয়ে এল, যেখানে অজস্র খাবার রাখা। বিভিন্ন স্ন্যাকস, টিনের কৌটোয় বেশ কিছু খাবার, পরিজ, কেক থরে থরে সাজানো। বেশ কিছু স্ন্যাকস ব্যাগে ভরলাম- ট্রেনে যেতে যেতে খাওয়া যাবে।

বসে আছি- হেলেনের সাথে চীনের গল্প চলছে, এমন সময় এক সুন্দরী এ্যাটেনডেন্ট বলল, টাইম হয়ে গেছে, বোর্ডিং করতে পারো। আমরা উঠলাম- প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে নীচে। আর নামার মুখে গেট- সেখানে মহিলা চেকার বসে। এট শুধু মাত্র বিজনেস ক্লাসের জন্য, ফলে খালি। পাসপোর্ট দিয়ে গেট খুলল। হেলেন ওর গাইড কার্ড দেখিয়ে আমাদের সাথে এল। এসকেলেটার করে নীচে নেমে দেখি ঝকঝকে লাল- সাদা রঙের বুলেট ট্রেন দাঁড়িয়ে। মুখটা ছুঁচালো- বুলেটের মত আর মোট কোচ হবে খান দশেক। দীপা ও ডোরা আট নাম্বার কোচে, আর আমার পরের টা- ন নম্বর। প্রথমে হেলেন আট নাম্বারে তুলল। এই কোচের একটা দিক ফার্স্ট ক্লাশ – প্রায় গোটা পঁচিশ সীট দুটো দুটো করে। মাঝে টয়লেট একদিকে ও অপরদিকে এ্যাটেন্ডেন্টদের বসার ও খাবার রাখার জায়গা। এর পর হচ্ছে বিজনেস ক্লাস। খান আটেক সীট। প্রত্যেকের আলাদা কেবিন – যেমন  প্লেনে ফার্স্ট ক্লাসে থাকে, তবে কলেবর আরো বড়ো। বসার সীটে সুইচ আছে, টিপলে সেটা বেড হয়ে যায়। পাশে নিজস্ব বিরাট জানালা। অন্য পাশে টেবিল, মাল রাখার জায়গা, তারপর কেবিনের দরজা। দরজাটি সুইচ টিপে বন্ধ বা খোলা যায়। হেলেন ওখানে প্রচেষ্টা চালাল, যদি আমাকে ঐ কোচে দেওয়া যায়। যখন দেখলাম হচ্ছে না, বললাম, হেলেন প্রয়োজন নেই- পাশেই তো থাকব। হেলেন বলল, চলো, তাহলে তোমাকে তোমার কোচে বসিয়ে দিই।

চিত্র-৩০

এলাম পরের কোচে- একই রকম কেবিন। আরাম বলে আরাম! হেলেনকে বিদায় জানালাম, অনেক করল মেয়েটি । হেলেন ট্রেন থেকে নামার আগে কোচ এ্যাটেনডেন্টকে বলে গেল আমার খাবারে কি কি থাকবে- মানে বীফ নয়, শুধু চিকেন ও ভেজ।

হেলেন চলে গেলে দেখলাম- কি রকম আরামে বসেছি। একবার সুইচ টিপে সীটটা বেড করে দেখলাম, না, দিব্যি শোওয়া যায়, ভালো ধপধপে কভার লাগানো কম্বল ও পিলো রাখা। বাব্বা, এ তো রাজার হালে যাওয়া। এই ট্রেন যেন আমার নিজের। এর মধ্যে এ্যাটেনডেন্ট এসে অরেঞ্জ জুস ও কাঁচকলার চিপস দিয়ে গেছে। মাথার ওপর ইলেক্ট্রনিক বোর্ড ট্রেন কোথায় যাচ্ছে, পরের স্টেশন কি ও কটায় আসছে, ট্রেনের গতি কত, সব ওই বোর্ডে ফুটে উঠছে- চাইনীজ ও ইংরাজিতে লেখা আসছে, ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস। হেলেন আমায় একটা লিষ্ট দিয়ে গেছে- কোন স্টেশন কটায় আসবে ও কতক্ষণের স্টপ ফলে মিলিয়ে নিয়ে বোঝা যাচ্ছে যে ঠিক পথেই চলেছি। এই সাড় চার ঘন্টার পথে ট্রেন থামবে পাঁচ বার, আর কোনো স্টপ পাঁচ মিনিটের বেশি নয়। আমাদের গন্তব্য আগেই বলেছি – শেষ স্টপ- সিয়ান- ১১৭৫ কিলোমিটার রাস্তা যাবে সাড়ে চার ঘন্টায় তাও আবার পাঁচটা স্টপ দিয়ে-বাপস- চীন কতোটা এগিয়ে আছে গতিতে!

দুটো পাঁচে ট্রেন  ছাড়লো। বুলেট ট্রেন – ফলে বেজিং ছাড়তে না ছাড়তেই স্পীড তুলল,ওপরে বোর্ডে দেখছি গতি ক্রমেই বাড়ছে। পঞ্চাশ- একশো- দুশো-তিনশোয় এসে একটু স্থির হল। দেখলাম সর্বোচ্চ স্পীড তুলল তিনশো ষাট কিমি প্রতি ঘন্টায় আর গড়ে ৩০০ স্পীডে চলছে। যখন কোনো টানেলে ঢুকছে হাওয়ার চাপে কানে তালা লেগে যাচ্ছে সাময়িক, আবার টানেল পেরুলে ঠিকঠাক। বোঝার উপায় নেই, এই যে আমরা বিরাট গতিতে চলেছি, একটু কাঁপুনি নেই, ঘটাংঘট শব্দ নেই, নেই ঝিকঝিক শব্দ- তার বদলে এক টানা এক মৃদু আওয়াজ। ধুলো ধোঁয়ারও বড় আকাল দেখছি, মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন প্লেনে বসে।

এই ১১৭৫ কিমি পথে দেখলাম সবুজে সবুজ, উন্নত শ্রেণীর চাষ, সুন্দর খাল কাটা জলের জন্য, প্রতি একশ মিটার দূরে দূরে কংক্রিটের রাস্তা, যাতে চাষের জল সেচ সহজে করা যায় গাড়ির সাহায্যে। 

এরকম ক্ষেত যেন স্বপ্ন, যেন ছবি। চীনে যত দেখছি অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। সব দিক দিয়ে চীন সবাইকে ফেলে কোথায় চলে গেছে। ইউরোপ, আমেরিকাতেও এরকম দেখিনি।

পাশের কেবিনের লোকটি মানিব্যাগ টেবিলে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। এখানে চুরি পকেটমারী দেখিনি। ভিখারি নেই। কেমন যেন লাগে!!

প্রতিটি স্টেশন যেন ছবি। শুয়ে পড়া যায় এমন ঝকঝকে। আর এই ১১৭৫ কিমিতে বা গোটা বেজিং তে ধুলো, নোংরা দেখিনি, সব যেন ঝকঝকে।

 মাঝপথে কেবিনের দরজায় ঠকঠক। সুইচ টিপে দরজা খুলে দেখি খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরী এ্যাটেনডেন্ট।

ডিনারে ভাত, চিকেন, সুইট পটেটো আর বিনস খেয়ে ঝড়ের বেগে ৩৫০ কিমি গড় স্পিডে ৪ ১/২ ঘণ্টার চলে এলাম সেন্ট্রাল চায়নার কালচারাল সিটি Xian,বা সিয়ান। মনটা খারাপ লাগছিল, এরকম বিজনেস ক্লাশের সুখ, দেখার মজা- এ সব কি আর পাব! নামার আগে একবার টয়লেট গিয়ে হতবাক। বিশাল টয়লেট- ঝকঝকে, তকতকে। বস্তুত সারা চীনের সেরা টয়লেট ছিল এই বিজনেস ক্লাসের টয়লেটটি।

ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় বুলেট ট্রেন চলে এল অন্তিম স্টপ সিয়ান। মালপত্র নিয়ে নামলাম, দেখি দীপা ও ডোরাও পাশের কামরা থেকে নামছে। তিনজনে খানিক বিজনেস ক্লাসের সুখকর অনুভূতি রোমন্থন করতে করতে এসকেলেটর দিয়ে ওপরে এলাম। পাসপোর্ট স্ক্র্যান করে গেট দিয়ে বেরুলাম। এখানেই আমাদের গাইড লিলির আসার কথা। মিনিট পাঁচ দাঁড়িয়ে  ফোন করলাম লিলিকে- হেলেন আগেই ওর নাম্বার দিয়েছিল। লিলি জানাল খনিকটা এগিয়ে আর একটা গেট আছে, ওখানে ওরা দাঁড়িয়ে- ওরা বলতে ও আর ড্রাইভার। সিয়ানও বিরাট স্টেশন- তবে ওর কথা মতো মিনিট সাত সোজা স্টেশনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে পেয়ে গেলাম আমার নাম লেখা বোর্ড হাতে ছোটখাট চেহারার লিলিকে।  সিয়ানে স্বাগত – লিলি সাদর আমন্ত্রণ জানাল, কোনো অসুবিধা হই নি তো? না,না, সব ঠিক আছে , অপূর্ব জার্নি ছিল- আমি বললাম।

-চলো, ওপরে পারকিংতে আমাদের গাড়ি আছে।

উঠলাম লিলির গাড়িতে। এটাও বেজিং এর মতো বড়ো গাড়ি। লিলি যাত্রা পথে শোনাল সিয়ানের ইতিহাস, যেটা পরে লিখছি। বলল, ঘন্টা খানেকের রাস্তা স্টেশন থেকে তোমাদের হোটেল – নাম ইস্টারন বুটিক, সিয়ান।

রাস্তা মসৃণ, গাড়ি গড়ে নব্বই কিলোমিটার ঘন্টায় চলল যতক্ষণ মোটরওয়েতে ছিল, তারপর যখন সিয়ান শহরে ঢুকল, গতি গেলো কমে কেননা গাড়ির সংখ্যা তখন প্রচুর আর সিগন্যালও অনেক।

গাড়ি এল এক জমজমাট জায়গায়। লিলি বলল এই জায়গাটা বলা যায় শহরের প্রাণকেন্দ্র। এর একদিকে বেল টাওয়ার, অপরদিকে ড্রাম টাওয়ার। দেখলাম বেল টাওয়ারেরে সামনে অজস্র মহিলা ট্রাডিশন্যাল ড্রেস পরে হাতে দারুণ দারুণ কাজ করা হাত পাখা  নিয়ে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তুলছে। লিলি বলল, এখানে প্রচুর ফটোস্যুট হয় আর অনেক প্রতিযোগিতাও হয় ফটোর। মেয়ের সংখ্যা প্রচুর – একদম সদ্য কিশোরীও যেমন আছে আবার ষাটোর্ধ প্রৌঢ়াও আছেন। দলে দলে মেয়েরা আসছে, ছবি তুলছে। লিলি বলল, এই জায়গাটা তোমাদের হোটেল থেকে দশ মিনিট হাঁটা রাস্তা, চেক ইন করে এখানে আসতে পারো।

গাড়ি দুবার বাঁক নিতেই এসে গেল আমাদের দু রাতের আস্তানা- ইসটারন বুটিক হোটেল। লিলিই পাসপোর্ট নিয়ে চেক ইন করিয়ে দিল, বলল, কাল সকাল আটটায় বেরুব টেরাকোটা আর্মি দেখতে।

পাঁচতলার ওপর বিরাট ঘর আমাদের। খান তিন বেড সহ বেডরুম, ড্রইং রুম, ছোট এক কিচেন, টয়লেট নিয়ে বিশাল জায়গা। চীন ভ্রমণে বলা যায় এই হোটেলটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। মালপত্র রেখে বেরুলাম। বেল টাওয়ারের দিকে।

দশ মিনিটের রাস্তা- অজস্র ট্রাডিশন্যাল ড্রেস পরিহিত নারীরা আসছেন, যাচ্ছেন। কি সুন্দর লাগছিল-যেন ইতিহাসের পাতা থেকে নেমে এসেছে সব। আলোয় আলোকিত বেল টাওয়ার- তাকে পিছনে রেখে ফটোস্যুট চলেছে। অজস্র ক্যামেরাম্যান, আর ট্রাডিশন্যাল ড্রেস পরিহিত মহিলারা – সব মিলে এলাকা জমে উঠেছে। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে সময় কাটিয়ে ঘুরে ফিরে এলাম হোটেলে।

চিত্র-৩১,৩২

পঞ্চম পর্ব –  টেরাকোটা ওয়ারিওর, সিয়ান

পরদিন জমিয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে অপেক্ষমান লিলির গাড়িতে করে চললাম চল্লিশ কিলোমিটার দূরের টেরাকোটা আর্মি দেখতে। অনেকক্ষণ ধরে বলছি “টেরাকোটা আর্মি” কিন্তু এই জিনিষটা কি, বুঝে নেওয়া যাক প্রথমে। এক্ষেত্রে আমি লিলির থেকে পাওয়া কালকের সদ্য লব্ধ জ্ঞান উজার করে দিই।

 প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মানে ২৪৭ বিসি নাগাদ এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন কিন শি হুয়াং। ওনার মাথায় এক উদ্ভট ভাবনা আসে যে উনি মারা গেলে ওনার সমাধি কে পাহারা দেবে? ওনার এই চিন্তা ভাবনার থেকে মাথায় আসে  যে, আমি যদি টেরাকোটা দিয়ে অজস্র সৈন্যবাহিনী বানাই আর সাথে দিয়ে দিই যুদ্ধর সব উপকরণ- অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া এমন কি যুদ্ধের রথ  আর এদেরকে যদি আমার সমাধির ওপরে ও চারপাশে রেখে দিই তাহলে আমার সমাধি ওরা পাহারা দেবে আর অটুট থাকবে। এই ভাবনা থেকে টেরাকোটা আর্মির সৃষ্টি।  বেশ কিছু বছর ধরে ঐ ২২০ বিসিতে সাতশো হাজার মজুর ও কয়েদীদের কাজে লাগিয়ে এই মূর্তিগুলি বানানো হয়- এক আধটা নয়- হাজার হাজার। আজ পর্যন্ত প্রায় ৭০০০ এর অধিক এই মূর্তি মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে আর আশ্চর্যর কথা প্রতিটি মূর্তি ইউনিক- কারুর সাথে কারুর মিল নেই। দৈর্ঘে প্রস্থে এগুলির সাইজ সাধারণ মানুষের মতো বা আর একটু বড়ো। হয়ত ওটাই তখন প্রমান সাইজ ছিল। এই মূর্তি ছাড়াও পাওয়া গেছে অজস্র রথ, ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল তরোয়াল, খান চারেক ঘোড়া সমেত রথ সাথে সেনাপতি- এ যেন এক সত্যিকারের সেনা বাহিনী। পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি এই সৈন্যবাহিনীতে সামরিক পদমর্যাদার স্বরূপ বিভিন্ন আকারের মূর্তি রয়েছে। এছাড়াও ঘোড়াসহ মূর্তিও রয়েছে। এক কথায় বলা যায়, প্রাচীন সামরিক বাহিনী যেভাবে সুসজ্জিত থাকতো,  মূর্তিগুলোতে সেই রূপ দেওয়া হয়েছে।

এই সমস্ত বানাতে যে অজস্র মজুর ও কয়েদীদের কাজে লাগানো হয়, তাদের অধিকাংশকেই জীবন্ত সমাধিস্থ করা হয় যাতে রাজার পাহারা অটুট থাকে।

তাই চীনের সাংহাই প্রদেশের সিয়ান শহরে অবস্থিত সম্রাট কিন শি হুয়াং এর সমাধি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত “টেরাকোটা আর্মি” চীনের দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম।

কালের নিয়মে এ সমস্তকিছু একসময় মাটি চাপা পড়ে, লোকে ক্রমে ভুলে যায় ও ধীরে ধীরে মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। এভাব কেটে যায় আড়াই হাজার বছর। প্রায় ২৫০০ বছর ভূগর্ভস্থ ছিল টেরাকোটা আর্মি। ১৯৭৪ সালের দিকে স্থানীয় দুই কৃষক খননের সময় প্রথম এই স্থাপত্যের সন্ধান পায়। সেটার কথা লিখিঃ

১৯৭৪ সাল। চীনে কমিউনিষ্ট শাষণ। চাষিরা ক্ষেতে কাজ করছে। এরকমই একদিন দুই চাষি শস্য ভালো হবে বলে তাদের জমির কিয়দংশে মাটি খুঁড়ছিল। তলার থেকে ভালো মাটি ওপরে দেবে এই ছিল পরিকল্পনা। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে আচমকা দেখে- কে একজন মাটির ভিতর থেকে রক্তচক্ষু মেলে তাকিয়ে। দেখে তো দুই চাষির প্রায় ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। কোনোরকমে সামলে দুজন দে ছুট উল্টোদিকে। এ নির্ঘাত কোনো জিন, ভয়ে দু জনের বুক শুকিয়ে গেছে। ওনারা বিরক্ত হয়েছেন মাটি খোঁড়ার ফলে- চাষিরা আর বাঁচবে কি? ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে। চাষিদের বউরা অবাক- এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে?

-জিন আছে মাঠে- আমরা আর যাচ্ছি না ওদিকে। ওনাদের বিরক্ত করা হয়েছে তাই ওনারা জেগে উঠেছেন।

এভাবে বেশ কদিন গেল। কিন্তু মাঠে না গেলে খাবে কি? পেটের টান বড়ো টান। কদিন পর বৌরাও বলল, একবার মাঠে গিয়ে দেখই না – ওনারা এখনও আছেন কিনা।

খানিকটা পেটের টানে আর খানিকটা বৌ-এর ভয়ে চাষিদ্বয় আবার ওদের ক্ষেতে গেল, দূর থেকে উঁকি মেরে দেখল, জিন ওভাবেই আছে, নড়নচড়ন নেই। তখন ওদের সন্দেহ হল, জিন কি একই ভাবে দিনের পর দিন থাকবে? একটু যেন সাহস এল, এক পা এক পা করে এগিয়ে ভালো করে দেখে ওদের মনে হল, আরে, এটা একটা মূর্তি বলে মনে হচ্ছে না? জিন তো নয়- কি মিঁয়া, তোমার কি মনে হচ্ছে, এগুলো মূর্তি না? মিঁয়া, মানে ওপর চাষির সাহস আরো বেড়েছে। এবারে গর্তে নেমে আর একটু আশপাশটা দেখতে মনে হল, আরো কিছু মূর্তির মতো ওখানে পোঁতা আছে। কাছ থেকে দেখে বলল, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে এখানে অনেক কিছু পোঁতা আছে, চল, আমরা আর না ঘাঁটিয়ে সরকারকে খবর দিই। কমিউনিষ্ট জমানায় এইসব খবর না দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটা দুজনেই জানে। অতএব দুজনে মিলে চলল খবর দিতে, আর তারপর তো ইতিহাস। সরকার সব দেখেশুনে আরকিওলজিকাল সোসাইটির সাহায্যে চালান একের পর এক খোদাই কর্ম । খোঁড়া হয় চারটে পিট। তাদের মাথার ওপর তোলা হয় এক  ছাত, যাতে মূর্তিগুলোর কোনো ক্ষতি না হয় কেননা অরিজিন্যাল কাঠের স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

এখন এখানে মোট চারটে পিট আছে। পিট নম্বর এক সবচেয়ে বড়- এখানে প্রায় ৪০০০  মূর্তি আছে, আছে রথ,ঘোড়া ও অন্যান্য অনেক কিছু। পিট দুই  তে দুটো অংশ। এক অংশে দুটি রো তে তীরন্দাজ তীর ধনুক ও বর্শা নিয়ে। অপর অংশে রথ ও সৈন্য। পিট তিন অপেক্ষাকৃত ছোট এখানে ২২ জন সৈন্য। এখন এখানে খনন করে পাওয়া ভাঙ্গা মূর্তিগুলো জোড়া লাগানো হয়। পিট চারতে ১০৮ জন সৈন্য, এখানে এখন খননের কাজ চলছে তাই বন্ধ। এই অঞ্চলে বিরাট খনন  কার্যকারণ চলছে- আরো কত কিছু যে মাটির তলায় লুকানো আছে তা ক্রমে প্রকাশ হবে কোনো একদিন।

আগেই বলেছি, রাস্তা চল্লিশ কিলোমিটার সিয়ান থেকে- লাগার কথা দেড় ঘন্টা কিন্তু লাগল দু ঘন্টা প্রায়। আজ আসলে চীনের জাতীয় ছুটীর দিন, ফলে রাস্তায় ভিড় বেশী। অজস্র গাড়ী ঠেলে আমরা যখন এলাম, তখন সকাল সাড়ে নটা।

লিলির সাথে ঢুকলাম এক নাম্বার পিটে, এটা অনেকটা ইনডোর স্টেডিয়ামের মতো- চারপাশে গ্যালারি আর ফুট দশ নীচে স্টেডিয়ামের মতো জায়গা। ভিতরে প্রচন্ড ভিড়, বল যায় পাঁচ ছটা রো করে মানুষ দাঁড়িয়ে টেরাকোটা দেখছে। ভিড় দেখে অনেকটা কোলকাতার দূর্গাপুজোর অষ্টমীর ভিড় মনে হল। লিলি বলল, দাঁড়াও একটু- লোকে বেরুবে আর আমরা আস্তে আস্তে ঢুকবো।

লোকেরা দেখলাম খুব শৃঙ্খলা মেনে চলছে। প্রথম রোতে যারা দাঁড়িয়ে, তারা তিন চার মিনিট পরেই পাশে চলে গেল, তখন পরের রো এর লোকেরা সেখানে ঢুকল। আমরা এক ধাপ সামনে এগুলাম। মিনিট দশ পর আমরা প্রথম রো তে এলাম। দেখি আমাদের সামনে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। কোথাও মূর্তিগুলি খালি হাতে- কোমরে তরোয়াল। কোথাও বা ঘোড়ার গাড়ীতে সেনাপতি সহ। মূর্তির সাইজ প্রমান মানুষের চেয়ে একটু বড়োই হবে- আর এমনভাবে বানানো, যেন মনে হচ্ছে সত্যিই একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে- যারা যুদ্ধের জন্য তৈরি। আর প্রতিটি মূর্তি এমন জীবন্ত, যেন আমাদের দিকে চেয়ে আছে। মন ভরে খানিক দেখলাম। লিলি বলল, এবার আস্তে আস্তে পাশে সরে যাও- এভাবে আমরা পুরো গ্যালারীটা দেখব। আমরাও আস্তে আস্তে পাশে সরলাম- দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি গ্যালারীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। আর নতুন যারা আসছে তারা আমাদের শুন্যস্থান পূর্ণ করছে। প্রচন্ড ভিড়-ভিতরে কয়েক হাজার লোক, কিন্তু কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই, ঠেলাঠেলি নেই এমনই নিয়মকানুনে শিক্ষিত জনতা। এত যে ভিড়- পকেটে পাসপোর্ট, টাকা, হাতে ক্যামেরা,তাই অভ্যাসবশত মাঝে মাঝে পকেটে হাত ঠেকিয়ে দেখছি সব ঠিক আছে কিনা, কিন্তু খানিক পরে বুঝলাম আমার ধারণা অমুলক। এখানে চুরি বা পকেটমারি হয় না- মানে ভাবাই যায় না।

প্রথম পিটে অজস্র মূর্তি – ফলে ভালো করে দেখা, ছবি তোলা এই সবে ঘন্টা খানেক কাটলো। ক্রমে আমাদের গ্যালারি এক চক্কর ঘোরা হয়ে গেল। লিলি বলল, চলো, এবার পরের পিটে যাই।

চিত্র-৩৩, ৩৪, ৩৫

পরের পিট মানে তিন নাম্বার। এখানে এখনো খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এক জায়গায় দেখলাম- যেখানে মাটি খুঁড়ে ভাঙ্গাচোরা মূর্তিগুলো পাওয়া গেছে- তাদের অপারেশন সেন্টার। মানে ঐ  এক একটি মূর্তির ভাঙ্গা অংশগুলি খুঁজে বের করে তাদের জোড়া লাগানো। এভাবে এক একটা মূর্তি- তার সব অংশ জোড়া লাগাতে দু তিন বছর লেগে যায়। সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এরকম বেশ কিছু মূর্তি দাঁড় করানো আছে। বেশ কিছু  আরকিওলজিস্ট দিবারাত্র খেটে চলেছেন- মাটি খুঁড়ে পাওয়া মূর্তিগুলো জোড়া লাগানোর কাজে। লিলি বলল,এভাবে প্রায় সাত হাজার মূর্তি এখনও পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে- যার একটা বড়ো অংশ তোমরা পিট ওয়ানতে দেখেছ। নিরলস পরিশ্রমের ফসল এগুলি।

চিত্র-৩৬

তিন নাম্বার পিট দেখা মিনিট কুড়িতে শেষ। লিলি বলল, এবার যাব শেষ পিট দু নাম্বারে কেননা চার নাম্বারে কাজ চলছে বলে বন্ধ।

দু নাম্বার পিটেও বেধড়ক ভিড়- এক নাম্বারের মত। তার প্রধান কারণ দু নাম্বারে বেশ কিছু টেরাকোটা মূর্তি কাঁচের শো কেসে রেখে দেওয়া আছে- কাছ থেকে দেখার জন্য। আমরা যে মূর্তিগুলো এক নাম্বার বা তিন নাম্বারে দেখেছি, সেগুলোর অরিজিন্যাল যে রঙ ছিল, তা বহু বছর মাটি চাপা থাকার ফলে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু এই শো কেসের মূর্তিগুলো আবার নতুন করে রঙ করা হয়েছে, ফলে দেখতে লাগছে অপূর্ব। এই মূর্তিগুলোর সাথে চীনা মেয়েরা সেলফি তুলতে  ব্যাস্ত, ফলে ভিড় বাড়ছে। চীনাদের সাথে ছবি তোলায় আমরা টক্কর দিতে অক্ষম, তাই দেখা শেষ হতে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম।

চিত্র-৩৭, ৩৮

বাজে প্রায় একটা। লিলির সাথে বেরুলাম। বেরুবার রাস্তা আলাদা। ঐ কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এলাম এক জায়গায়- যার দু ধারে অজস্র দোকান- কেউ খাবার বানাচ্ছে, কেউ মিষ্টি বিক্রি করছে, কেউ ফলের রস, আইসক্রিম আর কেউ বা শুভেনির, সব মিলে বলা যায় জমজমাট বাজার এলাকা। কিছু কুচো গজা টাইপ মিষ্টি দেখে লোভ সামলানো গেলো না। কুচো গজা খেতে খেতে এসে গেলাম গাড়ির কাছে। উঠে বসা হল সবাই মিলে।

আমাদের পরবর্তী আকর্ষণ টেরাকোটা ফ্যাকট্রি- মানে এমন এক জায়গা যেখানে এখন টেরাকোটা মূর্তি বানানো হয়। পনেরো মিনিটের রাস্তা- এসে গেলাম এক বিশাল জায়গাতে – অনেকটা কারখানার মত শেড দেওয়া। আশে পাশে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি – কেউ দাঁড়িয়ে, কারুর রঙ করা চলছে। অনেকটা যেন আমাদের কুমারটুলির সাথে মিল আছে তবে অনেক সাজানো গোছানো, পরিষ্কার আর অনেক বড়ো জায়গা।

আমরা যেতেই একটি চীনা মেয়ে এগিয়ে এল, নাম হানা। লিলি বলল, হানা তোমাদের শেখাবে কিভাবে টেরাকোটা মূর্তি বানানো হয়। আর তারপর তোমরাও বানাবে।

পাশে একটি ছোট ঘর ছিলো। মাঝে বিরাট এক টেবিল- চারপাশে চেয়ার। আমরা বসলাম। হানা নিয়ে এল খান চারেক মোল্ড বা ছাঁচ-এগুলি চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা আর নিয়ে এল খানিক মাখা কাদামাটি। হানা জানালো, এই মাটি পাহাড়ের ধার থেকে তুলে আনা হয়। এই মাটিই ব্যাবহার করা হয়েছিল টেরাকোটা মূর্তি বানাতে।  মাটিগুলো মাখাই ছিল, কিন্তু হানার কথা মতো মাটিগুলো আরো ভালো করে মেখে ও দলে দিলাম। হানাও আমাদের সাথে সাথে মাটি মেখে যাচ্ছে। তারপর স্রেফ হানাকে দেখে ও ওর কথামতো মাটি ছাঁচে ঢালা, ছাঁচের ওপরের অংশ বসানো, চাপ দেওয়া সমান ভাবে তারপর আস্তে করে ছাঁচ থেকে বের করা। দেখলাম সুন্দর এক ইঞ্চি চারেক লম্বা টেরাকোটা ওয়ারিওর বানিয়েছি চারজনে। চারটে আলাদা টাইপ – কারুর ড্রেস সেনাপতির, কারুর গোঁফ আছে, কারুর পা-তে সুন্দর জুতো। এবার হাতে করে সেই সুক্ষ কারুকার্যগুলো যেখানে আছে, সেগুলো আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে ঠিক করা। আধ ঘন্টায় আমাদের বানানো শেষ। হানার মতো নিখুঁত হল না বটে, কিন্তু জানলাম কিভাবে এগুলো তৈরি হয়। হানা আমদের বানানো মূর্তিগুলো তো দিলোই , উপরন্তু ওর ষ্টক থেকে আরো তিনটে আগুনে পোড়ানো মূর্তি উপহার দিল – বলল, এগুলো তোমাদের বাড়ি সাজানোর জন্য, যা তোমাদের টেরাকোটা ওয়ারিওরদের মনে করাবে।

চিত্র-৩৯

এখান থেকে উঠে আমরা গাড়িতে বসলাম- যাবো লাঞ্চ খেতে। যাওয়ার পথে লিলিকে প্রশ্ন করলাম, এত বড়ো টেরাকোটা মূর্তি বানানোর কোম্পানি, কিন্তু কেনে কারা?

-তুমি জানো না, এ সব কেনার প্রচুর খদ্দের আছে, অনেক সময় অর্ডার দিয়ে পাঁচ ছ মাস অপেক্ষাও করতে হয়। শুধু চীনে নয়, চীনের বাইরে থেকেও প্রচুর অর্ডার আসে। এশিয়া, ইউরোপের অনেক হোটেলেই এরকম টেরকোটা প্রমান সাইজের মূর্তি এরা পাঠিয়েছে। ঘর বা হোটেল সাজানোর জন্য উপযুক্ত বটে।

জোর খাওয়া হল বটে রেস্তোরাঁয় – সুইট সাওয়ার চিকেন, টফু, নুডলস, ফ্রায়েড রাইস, চালের পিঠে।

খাওয়ার পর আবার ঐ চল্লিশ কিলোমিটার পথ ঠেঙ্গিয়ে শহরে ফেরা। নামলাম বেল টাওয়ারের কাছে। এখান থেকে লিফটে করে উঠলাম চল্লিশ ফুট উঁচু সিটি ওয়ালের মাথায়।

এককালে এই সিটি ওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল শহর, প্রায় চোদ্দো কিলোমিটার লম্বা এই সিটি ওয়ালের বেষ্টনীতে আছে খান চারেক বিশাল বিশাল গেট যার মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ গেটই প্রধান। যখন জু উয়ান চ্যাং (Zhu Yuanzhang) মিং সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন, তখন উনি পুরানো তাং সাম্রাজ্যের যে দেওয়াল ছিল, সেটাকে আবার নতুন করে বানান।

বিরাট চওড়া এই দেওয়ালের ওপর অংশ প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ফুট চওড়া। সুন্দর রোদ উঠেছে, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া- দেওয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল। অনেকে সাইকেলে ঘুরছে, অজস্র ছেলেমেয়ে এখানে নিভৃতে আলাপে ব্যাস্ত –দূরে একদিকে বেল টাওয়ার, অন্য দিকে ড্রাম টাওয়ার- মাঝে আরো টাওয়ার আছে। পুরোটা হাঁটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়- আমরা প্রায় এক দেড় কিলোমিটার হেঁটে একটি সিঁড়ি পেলাম, নীচে গেট- লিলির কথা মতো ওটা দিয়ে নেমে গেলাম- বেরুলাম ড্রাম টাওয়ারের সামনে মুসলিম কোয়ার্টার নামে খ্যাত এক জায়গাতে।

চিত্র-৪০, ৪১

মুসলিম কোয়ার্টার  নামের কারণ হল সেই প্রাচীন কাল থেকে মুসলিমরা এখানে আছে। কালে সংখ্যা কমে গেলেও এখনও বেশ কিছু মুসলিম এখানে আছে। আছে খান দশেক মসজিদ। মুসলিম রোড বলে রাস্তা টানা চলে গেছে। এই জায়গা কিন্তু বিখ্যাত অন্য কারণে। এখানে রাস্তার দু পাশে আছে অজস্র স্ট্রীট ফুডের দোকন। কত রকমের যে খাবার- তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পর্ক ও বীফের তৈরি অজস্র স্ট্রীট ফুড তো আছেই- বেশ কিছু দোকানে ফ্রগও দেখেছি। কিন্তু ঐ পর্যন্তই – ওর বাইরে আর কোনো প্রাণীর মাংস বা পোকার ফ্রাই দেখিনি। আমরা এখানে রোল্ড ইয়োগহারট আইসক্রীম খেলাম। অপূর্ব তার স্বাদ – এরকম যে বানানো সম্ভব – এই প্রথম দেখলাম। দেখলাম রোবটের ব্যাবহার বেশ কিছু দোকানে। চীনে রোবট সর্বত্র। রেস্টুরন্টগুলোতে, দোকানে, রেল স্টেশনে অজস্র রোবট। কেউ খাবার দিচ্ছে, কেউ নমস্কার করছে, কেউ ক্লিন করছে। এখানে একটা  দোকান থেকে বেরোচ্ছি  আর ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো তিনটে মেয়ে- মাথা ঝুঁকিয়ে চাইনীজে কি সব বলে সম্মান জানালো- ভালো করে চেয়ে দেখি তিনটেই রোবোট আর সব এক সাথে মাথা ঝাঁকাচ্ছে- সে এক দারুণ দৃশ্য।

সবমিলে কখন যে সন্ধ্যা নামল বুঝিনি। কেনাকাটাও প্রচুর হল- অজস্র চাইনীজ পুতুল,হাতপাখা, বুক মার্ক, সব মিলে বেশ খুশি হলাম সবাই। লিলি আমাদের হোটেল পৌছিয়ে দিল, বলল, কাল চেক আউট করে রিসেপশনে থাকতে-  সকাল নটায় বেরুব।

চিত্র-৪২,৪৩,৪৪

(চলবে- আগামী সংখ্যায় বাকি সিয়ান আর এক অবিস্মরণীয় ক্রুজ জার্নি ইয়াংসি নদীর বুকে, পড়বেন কিন্তু)


[প্রথম পর্ব]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
মলয়
মলয়
2 months ago

দীপ্ত,
অসাধারণ লেখা !!! তথ্য সমৃদ্ধ পুঙ্খানুপুঙ্খ সচিত্র বর্ণনা একটানে পড়তে পড়তে মনে হল যেন চিনে নিজেই ঘুরছি। 👌👌👏👏 অপূর্ব!!

Sujit Kumar Modak
Sujit Kumar Modak
1 month ago

ছবির মত চোখে ভেসে উঠল, চীন ভ্রমণ।পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল যেন আমিই বেড়াচ্ছি। পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য অধীর অপেক্ষায় রইলাম।