Itihas_o_Sanskriti

‘ইতিহাসের অনেক তত্ত্ব মাটির উপরিভাগে পড়িয়া আছে। অনায়াসেই খুঁজিয়া লইতে পারা যায়। কিন্তু খুঁজিবার লোক কই? অনেকের আগ্রহ আছে শক্তি নাই, অনেকের শক্তি আছে আগ্রহ নাই; অনেকে ঘরে বসিয়া কাজ করেন, বাইরে ঘুরিতে পারেন না; অনেকে বাইরে ঘুরিতে পারেন কিন্তু তাঁহাদের চোখ পরিস্ফুট হয় নাই।’— এই মন্তব্য মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। মন্তব্যটি তিনি করেছিলেন সপ্তম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন উপলক্ষ্যে ১৩২০ বঙ্গাব্দে সভাপতির ভাষণে। সেই মন্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে নন্দদুলাল আচার্য সম্পাদিত ‘পশ্চিম বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থের ভূমিকায় এবং সম্পাদক মহাশয় মনে হয় প্রতি মুহূর্তে শাস্ত্রী মহাশয়ের মন্তব্য মনে রেখে তাঁর সেই আক্ষেপ দূর করতে প্রয়াসী হয়েছেন এই গ্রন্থে। ফলে পাঠকের হাতে উঠে এসেছে সমগ্র রাঢ়বঙ্গের প্রেক্ষিতে পশ্চিম বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জানার মণিজালে পূর্ণ আস্ত এক খনি।
অখণ্ড বর্ধমান জেলা বিভাজিত হয় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে — পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান নামে। অজয়, দামোদর ও বরাকর এই ত্রি-নদী বেষ্টিত পশ্চিম বর্ধমানের একটা বড়ো অংশ প্রথম থেকেই ছিল অরণ্য-সংকুল ও আদিবাসীদের বাসভূমি। এখানে নগরায়ণ হয়েছে মূলত খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হবার পর। এখানকার যে-অংশ জুড়ে মাটির নীচে কয়লাখনির বিস্তার, মাটির উপরে তাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে খনিজীবন। এখানকার সার্বিক ছবিকে অপূর্ব বিন্যাসে সংকলিত করেছেন নন্দদুলাল আচার্য তাঁর ‘পশ্চিম বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে। আসানসোল-সহ পশ্চিম বর্ধমানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি ৩১টি প্রবন্ধে সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। সেইসঙ্গে রয়েছে মূল্যবান বহু ছবি, যা গ্রন্থটিকে মহার্ঘ্য করে তুলেছে। সেইসঙ্গে গ্রন্থের শুরুতেই ‘একনজরে পশ্চিম বর্ধমান (২০২২)’ পশ্চিম বর্ধমানকে ভৌগলিক-রাজনৈতিক-সামাজিক দিক থেকে সংক্ষেপে জানার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় অংশ।

Nandadulal-Acharya
অনলাইনে সংগ্রহ করতে, ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন


রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম খনিশহর রানিগঞ্জ। রামদুলাল বসুর ‘রানিগঞ্জের ইতিহাস’ প্রবন্ধে সেই খনি শহরের পরিচিতি ও তার বিস্তারের ইতিহাস স্থান পেয়েছে। খনি অঞ্চলের ইতিহাসের কথা, রানিগঞ্জের মহকুমা থেকে পৌর শহরে পরিণত হওয়ার কথা এই সমস্ত দুর্লভ তথ্যে সমৃদ্ধ রামদুলাল বসুর প্রবন্ধটি খনি-জীবনকে চেনার জন্য বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয়। রানিগঞ্জের পাশাপাশি দুর্গাপুর খনি অঞ্চলের সমৃদ্ধশালী এক নগরী। এখন অবশ্য শিল্প-শহর হিসাবেই দুর্গাপুরের বিশেষ পরিচিতি। সেই দুর্গাপুরের সংস্কৃতির লৌকিক ইতিহাস এবং গ্রাম থেকে শহর হয়ে ওঠার কথা সুশীল ভট্টাচার্য তাঁর ‘দুর্গাপুরের ইতিহাস : সভ্যতা ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে অপূর্ব লিখনশৈলীতে তুলে ধরেছেন। হারাধন দত্তের ‘অজয় উপত্যকা, সাবেক চুরুলিয়া ও নজরুল প্রসঙ্গ’ এক মূল্যবান আলোচনা। আসানসোলকেন্দ্রিক কয়লাখনি অঞ্চলের ব্যবসায়িক দিক ও শিল্পায়নের কথা সুবিস্তৃত ভাবে লিখেছেন নন্দদুলাল আচার্য এবং অনুপকৃষ্ণ গুপ্ত। আসানসোলের বিভিন্ন স্থাননামের তথ্যভিত্তিক বর্ণনাটিও নন্দদুলাল আচার্য এনেছেন তাঁর অন্য আর এক প্রবন্ধে।
খনি সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা অগ্রজ, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাম প্রফুল্লকুমার সিংহ। সাহিত্যিক প্রফুল্ল সিংহ জন্মসূত্রে শুধু নয়, মনেপ্রাণে কয়লাখনি সাহিত্যের এক বিশিষ্ট রূপকার। এই গ্রন্থে তাঁর প্রবন্ধ খনি-জীবনের প্রথম পর্বের ঐতিহাসিক দলিলের মতো খনি-সাহিত্যের সম্পদ হয়ে উঠেছে। এখানে কয়লাশিল্পের শ্রমিক আন্দোলনের দিকটি প্রত্যক্ষ ভাবে রূপায়িত হয়েছে। একই ভাবে শ্রমিক আন্দোলনের কথা এসেছে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখাটিতে। মণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ‘রানিগঞ্জ কয়লা অঞ্চলের শিল্প ও শিল্পায়নের ক্রমবিকাশ’। রানিগঞ্জের শিল্প মানেই কয়লাশিল্প। রানিগঞ্জের কয়লাকেন্দ্রিক শিল্পের পরিচয় দিতে গিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলের শিল্পায়নের পরিচয় ও সাম্প্রতিক কালের পরিস্থিতির ছবিটিকে স্পষ্ট করেছেন লেখক। কয়লাশিল্প ছাড়াও আঞ্চলিক মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, পশমশিল্প, ডোকরাশিল্প, রানিগঞ্জের স্বর্ণশিল্প, পাথরখাদান শিল্প, বুনোঘাসের হস্তশিল্প প্রভৃতি বৈচিত্র্যময় খনি অঞ্চলের শিল্পায়নের বর্ণনাও আছে প্রবন্ধটিতে।
পশ্চিম বর্ধমানের কয়লাখনি অঞ্চলটিতে সাংস্কৃতিক আবহের একটি ধারা প্রবহমান রয়েছে বহু আগে থেকেই। অসীমকৃষ্ণ দত্তের লেখায় আসানসোলের পত্র-পত্রিকার তথ্য-সহ বিবরণ পাঠক জানতে পারবেন, খনি-সাহিত্যের গবেষকদের কাছে যার মূল্য অপরিসীম।
লোকসংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে রাঢ়ের পশ্চিমাঞ্চলের পরিচিতি দীর্ঘকালের। খনি অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে টুসু-ভাদু-ঝুমুরের মতো লোকগান, লোক-উৎসব, লোক-মেলার কথা বিস্তৃত ভাবে উঠে এসেছে চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত ও কালীপদ সরকারের প্রবন্ধে।
আলাদা ভাবে প্রতিটি প্রাবন্ধিকের নাম ও লেখার কথা বলা না হলেও এই গ্রন্থের প্রতিটি লেখাই আলাদা ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেইসব প্রাবন্ধিকদের গবেষণাভিত্তিক আলোচনায় সমৃদ্ধ পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিবরণ এবং সেই অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূগোলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কয়লাখনির উৎপত্তি, খনি-শিল্পের সূচনা ও প্রসার, শিল্পভিত্তিক সংগ্রাম, খনিশহরগুলির সাংস্কৃতিক আবহ, খনি অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী লোককথা, লৌকিক দেবতাদের উৎপত্তির ইতিহাস, বর্তমানে শিল্পায়নের রূপরেখা — এই সবকিছুই সম্পাদক একটি মলাটের মধ্যে এনে উপহার দিয়েছেন, যার কাছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের গবেষকদের বারবার ঋণী হতেই হবে।
গ্রন্থের বানান প্রায় নির্ভুল। তথ্য যথাযথ এবং সঠিক। কথন-রীতি ভিন্ন; কিন্তু সুর এক। এরপর আলাদা ভাবে বলতেই হবে বইটির বহিরাঙ্গিক সৌষ্ঠবের কথা — উন্নত মানের কাগজ, মজবুত বাঁধাই, বিষয়-উপযুক্ত প্রচ্ছদ। সব মিলিয়ে গ্রন্থটি অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য এবং প্রয়োজনের তো বটেই।

পশ্চিম বর্ধমানের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
সম্পাদনা নন্দদুলাল আচার্য
পরম্পরা
বিনিময় : ৮০০.০০ টাকা।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]