মাধবী কাল সকালে বাড়ি ফিরবে।
হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ঢুকবে ভোর রাতে। তারপর লোকাল ট্রেন চড়ে চুঁচড়োয় আসতে সময় লাগবে ঘন্টাখানেক। সব কিছু ঠিকঠাক সময় মতো হলে, সকাল সাতটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে। আশা করা যায়।
দশদিন হল মাধবী বাড়িতে নেই। বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ছেলে সুবীর বা বউমা অতসীকে তো একথা বলা যায় না। আমার কথার পিঠে দুজনের কেউ-ই কিছু বলবে না। হয়ত ‘হ্যাঁ’, ‘না’-টুকুও উচ্চারণ করবে না। কিন্তু আমি জানি, আড়ালে হাসাহাসি করবে।
রান্নার মেয়ে মিনু বলে, মাসি না থাকলে বাড়িটা ঠিক জমে না। ‘জমে না’ শব্দদুটো আমার কানে লাগে। ভেতরে ভেতরে রেগেও যাই। তারপরেও গলা নামিয়ে মিনুকে বলি, বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তাই তো ?
তা তো লাগেই। মিনু বলে, তুমি চুপচাপ মানুষ। আপন মনে থাক। দাদা বৌদি দুজনেই অফিস যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেদের ঘরেই থাকে। এক ফাঁকে টুক করে চান করে, নাকে মুখে গুঁজে বেরিয়ে যায়। মাসী যদি না থাকত এ বাড়ির কাজ কবেই ছেড়ে দিতাম। বোবা হয়ে থাকা আমার ধাতে সয় না।
আমি হেসে বলি, তুই আর তোর মাসি দু আড়াই ঘন্টায় যত কথা বলিস, তারপর সারাদিন বোবা হয়ে থাকলেও কিছু যাবে আসবে না।
ওই দ্যাখ, তুমি আবার কথাটাকে উল্টো করে ধরছ। আমরা তো লোকের নিন্দেমন্দ করি না। টিভি, সিনেমা নিয়েও কথা বলি না। মাসি বেড়াতে যাওয়ার গল্প করে। মন দিয়ে শুনো। দেশ বিদেশের কত রকমের গল্প। আর এমন সুন্দর করে বলে, মনে হয় আমিও যেন মাসির পাশে পাশে ঘুরছি। সত্যি সত্যি তো আর যেতে পারব না কোনদিন। মনে হয় কানে শুনেই আদ্দেক ঘোরা হয়ে গেল। বরফের পাহাড়ের পেছন থেকে সূয্যি ঠাকুর কেমন চোখের পলক ফেলার আগেই টুক করে লাফ দিয়ে ওঠে, সমুদ্রের চড়ায় দাঁড়ালে ঢেউ এসে শাড়ি ভিজিয়ে দেয়, সমুদ্রের জলে ডুব দিলে কান মাথা সব বালিতে ভরে যায়, বড় বড় মন্দিরে ঢোকার আগে মোবাইল ফোন, ঘড়ি, চামড়ার ব্যাগ সব জমা রেখে যেতে হয়! একটু থেমে লম্বা করে শ্বাস ফেলে বলে, কেউ আমায় জিজ্ঞেস করলে সব গড়গড় করে বলে দিতে পারব। ধরতেই পারবে না, আমি নিজে ঘুরে এসে বলছি না অন্যের মুখ থেকে শুনে বলছি। জান মেসো, এক এক দিন রাতে ঘুম আসে না যখন, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি, কখনও কখনও, সত্যি বলছি, মনে হয় চৌকিটা একটু একটু দুলছে। ঠিক যেন ট্রেনের সিটে শুয়ে আছি। কাল মাসি আসবে। খুব আনন্দ হচ্ছে। আবার নতুন গল্প শুনব।
পারিস তো কাল সকালে মাসি বাড়ি ঢোকার আগেই চলে আসিস। আমি বললাম, গরম এক কাপ চা, তারপর স্নানের গরমজল, টুকটাক কাচাকুচি ……..।
মিনু বলল, সে তোমায় ভাবতে হবে না। পারলে চুলের ফিতে চিরুনি পরিস্কার করে, সাবান শ্যামপু দিয়ে মাথাটা পরিস্কার করে দোব। রোদে বসে চুলটা শুকিয়ে নিতে পারবে।
মিনুর কথায় আমি খুব নিশ্চিন্ত বোধ করলাম।
সুবীর বড়জোর তার মা’কে ‘কেমন আছ ?’, ‘কোন অসুবিধা হয়নি তো ?’-এর বেশী আর কিছুই জিজ্ঞেস করবে না।
অতসী পারলে অন্যদিনের চেয়ে আরও একটু বেশী দেরী করে নিজের ঘর থেকে বেরোবে। আর প্রতিবারের মতো চেনা চিত্রনাট্যের ছকে, মাধবীকে টুক করে প্রণাম করে বলবে, আজ অফিসে জরুরী কাজ আছে। এখনি বেরোতে হবে। পরে ধীরেসুস্থে সব শুনব, কেমন বেড়ালেন।
আমি মাধবী দুজনেই জানি, অতসী ঠিক বলছে না। ‘পরে’ মানে সেটা কোনদিনই নয়।
তারপরেও মাধবী হেসে বলবে, ঠিক আছে। তাই হবে।
আমি বলব, সাবধানে যাবে। ট্রেনে বাসে তাড়াহুড়ো করবে না।
মিনুকে বললাম, কাল সকালে বাজার থেকে টাটকা ছোট চারা মাছ নিয়ে আসব। সাদামাটা রান্না করবি। ডাল, একটা সব্জি। আর মাছের ঝোল। খুব কম তেল মশলা দিবি। দশ দিন এলোমোলো খেয়েছে। অসময়ে খেয়েছে। ঘোরার আনন্দে টের পায়নি। জানবি, পেটের মধ্যে গড়বড় হয়ে আছে। এখন দিন পাঁচ ছয় সাদামাটা খাওয়া দাওয়া করলে, যেটুকু এদিক ওদিক হয়ে আছে, সেটা ঠিক হয়ে যাবে। অম্বল বমি পেট খারাপ এ সবের ভয় থাকবে না।
মিনু বলল, মাসির জন্যে তুমি কত ভাবো। তাই না? আমার কত্তা তো খোঁজই রাখে না, খেলাম কি খেলাম না।
এটা ঠিক বলছিস না। আমি বললাম, মুখে হয়ত কিছু বলে না। কিন্তু নজর রাখে। একদিন না খেয়ে থাকিস, দেখবি পরদিন ঠিক জানতে চাইবে। তোর মাসিও বিয়ের প্রথম প্রথম এই ধরণের কথা বলত। আমি রেগে যেতাম। ভুল ভাঙ্গানোর চেষ্টা করতাম। পরে বুঝেছি এসব বাজিয়ে দেখার ছল। একটা ঘটনা বলি শোন। যে মানুষটা আমার দিকে আঙ্গুল তুলত আমি তার খোঁজখবর রাখি না, সেই আবার, বেশী নয়, দশ দিন আমি বাড়ির বাইরে গেছিলাম, দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় পাগল পাগল হয়ে গেছিল। তখন তো মোবাইল ফোনের চল ছিল না। আমাদের এত বড় পাড়াটায় একটা বাড়িতে ল্যান্ড ফোনও ছিল না। তোর মাসি আমার খবর জানার জন্য কী কী কাণ্ডকারখানা করেছিল, বাড়ি ফেরার পর ওর মুখ থেকে সেসব শুনে আমি তো হেসে খুন।
দাঁড়াও। দাঁড়াও। মিনু বলল, তুমি দশ দিন বাড়ি ছেড়ে বাইরে ছিলে? কেন?
বেড়াতে গেছিলাম। স্কুলে আমরা যারা পড়াতাম, মানে মাস্টারমশাই, তারা পাঁচজন মিলে একটা দল তৈরী করেছিলাম। হঠাৎ করে ঠিক হল। আর হুট করে বেরিয়ে পড়লাম।
তুমি বেড়াতে গেছ? মিনুর গলায় বিস্ময়ের সুর, কবে? কোথায়? আমি তো শুনিনি।
তুই শুনবি কেমন করে! সেসব আজকের কথা ! তুই তখন জন্মাসনি।
মিনু বলল, আমি তোমাদের বাড়িতে কাজে ঢুকেছি সাত বছর পার করে আটে পা দিলাম। এর মধ্যে মাসিকে বার চারেক বেড়াতে যেতে দেখলাম। তুমি বাড়ি আগলে রইলে।
বললাম তো সে অনেক বছর আগের কথা। যা দেখার প্রাণ ভরে দেখে নিয়েছি। সারা জীবন আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। একটু থেমে বললাম, শিমূলতলার নাম শুনেছিস?
মিনু ঘাড় নাড়ল, না।
শিমূলতলা বেড়াতে গেছিলাম। আহা! চোখ বুজলে এখনও সব স্পষ্ট দেখতে পাই। সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। লাট্টু পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় মন্দির। সেখানে পুজো হচ্ছে। কাঁসর ঘন্টা বাজছে। সার দিয়ে প্রদীপ জ্বলছে। অত দূরের আলো, ঘন্টার শব্দ নীচ থেকে সব দেখা যায়। শুনতে পাওয়া যায়। তার ওপর ভরা পূর্ণিমা।আকাশে বড় থালার মতো চাঁদ। চারপাশ জুড়ে থই থই করছে চাঁদের আলো।সেই আলোয় আশপাশের গ্রামগুলোকে ছবির মতো দেখতে লাগে। টিনের ছাউনি দেওয়া বাড়ি। বাড়ির সামনে বাঁশের বেড়া ঘেরা বাগান। সেখানে কতরকমের সব্জি ফলে আছে। আর পুরনো বড় বড় বাড়ি, সেখানে সিনেমার শুটিং হয়। চাঁদের আলোয় সেই বাড়িগুলোকে কেমন ভুতুরে দেখায়। গা ছমছম করে।
জানিস মিনু, ওখানকার গরীব আদিবাসী মানুষগুলো যেমন সরল, তেমনি সৎ। তাদের সঙ্গে কথা বলে কি আরাম। তারওপর জল হাওয়া ! বাতাসে ছিটেফোঁটা ধুলো ময়লা নেই। বুক ভরে শ্বাস নে। ভেতরের রোগ ব্যাধি সব সাফ হয়ে যাবে। আঁজলা ভরে ইদারার জল খা। রাক্ষুসে খিদে পাবে। বেশী নয়, সপ্তাখানেক থাকলে, তোর চেহারার জেল্লা ফিরে যাবে। তার সঙ্গে শরীর মনের বলও বাড়বে।
আহা ! আমার শিমূলতলা ! বুঝলি মিনু, হিল্লীদিল্লী কোথাও যেতে হবে না। একবার শিমূলতলা ঘুরে এলে, দেখবি বাঁচার ইচ্ছেটা বেড়ে যাবে। মানুষ হয়ে জন্মেছি, সেটা সার্থক মনে হবে।
মিনু হাতের কাজ বন্ধ করে অপলক চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। অশ্বস্তি বোধ করলাম। বললাম, কী হল? অমন করে আমার মুখের দিকে চেয়ে কী দেখছিস?
আবেগ ধরা গলায় মিনু বলল, মেসো, তোমার পকেটে এত গল্প আছে? আর কি সুন্দর করে বললে! মাসির মত করে বললে। ছবির মতো সব চোখে ভাসছে। যেন চোখ বন্ধ করলেই আমিও এখনি শিমূলতলা পৌঁছে যাব।


(দুই)
গত রাতে মাধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। রাতের খাওয়া সেরে ও তখন শুয়ে পড়েছে। ট্রেনের ঝমঝম শব্দে বারবার ফোন কেটে যাচ্ছিল। তার মধ্যেই যেটুকু কথাবার্তা হল, জানলাম শরীর ঠিক আছে। বেড়ানোও ভালোই হয়েছে। আর কয়েক ঘন্টা পরেই হাওড়া পৌঁছে যাবে। তখনও রাতের অন্ধকার থাকবে। ভোরের আলো ফোটার জন্য হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করতে হবে। লোকাল ট্রেনে মাধবীর সঙ্গী দুই বান্ধবী ফিরবে। চিন্তার কোন কারণ নেই।
ঘড়িতে নটা বাজল। মাধবী এখনও বাড়ি পৌঁছাল না। ওর মোবাইলে বার কয়েক ফোন করেছি। প্রতিবার বলছে সুইচ অফ। মনের মধ্যে ভয় উঁকি দিচ্ছে। পথেঘাটে কতরকমের বিপদ ওৎ পেতে আছে। কখন কী ঘটে যায়, কে জানে! জানি এসব অমূলক ভাবনা। ট্রেন লেট করতে পারে। লোকাল ট্রেন ক্যানসেল হতে পারে। আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। যার জন্য দেরী হচ্ছে। আর এত দূরের পথ পেরিয়ে আসছে, সেখানে এক দু ঘন্টা এদিক ওদিক হতেই পারে।
তারপরেও দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা মনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির কাউকে কিছু বলতে পারছি না। আমি নিশ্চিত আমার চোখেমুখে ভয় উৎকন্ঠার ছায়া পড়েছে।
মিনু বলল, মেসো, জলখাবার দিই।
একটু পরে। আমি বললাম, তোর মাসি বাড়ি পৌঁছলে, তারপর ….. ।
কথা শেষ হয়নি। সদরের বন্ধ দরজার ওপারে টোটোর হর্ণ বেজে উঠল। আমি দরজা খুলতে যাচ্ছিলাম। । মিনু আমায় টেনে ধরল, তুমি বসো। আমি যাচ্ছি।
ট্রেনের পোশাকেই মাধবী চা খেল। আমার সঙ্গে বসে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, আঃ! কি তৃপ্তি!
আমার দিকে চেয়ে বলল, কাল রাতে তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর থেকেই মনটা ‘বাড়ি-বাড়ি’ করছে। মনে হচ্ছে চেনা মুখগুলো যেন কত যুগ দেখিনি।
মাধবীর কথা আমার মনটাকে ভিজিয়ে দিল। অকপটে বলেই ফেললাম, মিনুকে জিজ্ঞাসা করে দেখ, এই দশদিন তোমাকে নিয়েই কথা বলেছি। যে বিষয়েই কথা শুরু হোক না কেন, ঘুরেফিরে তুমি এসে হাজির হয়েছ।
মাসি শোন না! বলতে বলতে মিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল, মেসো বাড়িতে ছিল ঠিক কথা কিন্তু মনটা বাঁধা ছিল তোমার আঁচলে। কাঁড়ি কাঁড়ি ভাবনা তোমার জন্যে। পাখি পড়ানোর মতো করে আমাকে বুঝিয়েছে, তুমি বাড়ি ফেরা মাত্র আমাকে কী কী করতে হবে। এখন হপ্তাখানেক ধরে তোমার জন্য কেমন রান্না করতে হবে। বেড়ানোর ধকলে তোমার শরীরের যা যা গরমিল হয়েছে, খাওয়া দাওয়া সেবা যত্ন দিয়ে শরীরটাকে আবার আগের মতো জুতে নিয়ে আসতে হবে।
মাধবী বড় বড় চোখ করে মিনুর মুখের দিকে চেয়ে তার কথাগুলি গিলছিল। হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? টুলটা নিয়ে এসে বসো না।
আমি বললাম, বাজার যেতে হবে।
সে হবেখন। জলখাবার খেয়েছ?
মিনু বলল, আমি বলেছিলাম। রাজি হয়নি। বলল তোর মাসি বাড়ি ফিরুক, তারপর। আর বলতে বলতেই টোটোর হর্ণ বাজল।
তাই বুঝি ! এমনটা হয়েছে !
মাধবীর চোখমুখে খুশি উপচে পড়ছে। গলা নামিয়ে বলল, মিনু, থাম বাপু, ঘরে ছেলে বউ আছে। আমার লজ্জা করছে। এই বয়সে এমন পাগলামি! লোকে শুনলে কী ভাববে বল তো !
আপাতভাবে মনে হচ্ছে মিনুর কথায় মাধবী বিড়ম্বিত বোধ করছে। আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। মাধবীর ভাল লাগছে। হয়ত আরও দুচার কথা শুনতে চাইছে। ওর বলার ধরণ, চোখমুখের অভিব্যক্তি সব আমার চেনা। সময়ের ঝাপটায় তারা ফিকে হয়েছে। হারিয়ে যায়নি।
নাও ওঠো। আমি বললাম, স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নাও। দুপুরে তোমার একটা টানা ঘুমের দরকার। লম্বা ট্যুর করে ফিরলে শরীরের ওপর একটা ধকল যায়। আমি তো জানি।
তাই তো। মাধবী উঠে দাঁড়াল। ঘাড় কাত করে হেসে বলল, যেমনটা তোমার হয়েছিল। শিমূলতলা ঘুরে এসে।
মাসি, তুমি তো আমায় কোনদিন বলোনি। মিনু তেড়েফুঁড়ে বলে উঠল, মেসোও বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গেছিল। টানা আট দশদিন। মেসোর মুখে বেড়ানোর গল্প শুনে আমি বাক্যিহারা হয়ে গেছিলাম। আর কি সুন্দর করে বলছিল ! তোমার মুখে শুনে যেমনটা হয়, আমার অবস্থা ঠিক তেমনি। কানে শুনছি। আর সিনেমার মতো ছবি দেখছি। যেন আমিও শিমূলতলা ঘুরছি।
মাধবী বলল, বাজার যাবে বলছিলে, বেরিয়ে পড়ো। বেলা বাড়ছে, রোদও বাড়ছে।


(তিন)
রাতে বিছানায় পা মুড়িয়ে বসে মাধবী। আমি ওর মুখোমুখি, চেয়ারে। অন্যবার বেড়িয়ে ফিরে মাধবী কলবল করে কথা বলে। এবার কেমন চুপচাপ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন বেড়ালে?
মাধবী, ঘাড় কাত করল। যার মানে ‘ভাল’ বা ‘ঐ একরকম’, এমনটাই বোঝায়।
যেখানে যা যা দেখার, সব ঠিকঠিক দেখা হয়েছে তো?
মাধবী কোন জবাব দিল না।
অল্পক্ষণ পরে আমায় ডাকল, দেখ ! গলাটা কেমন ধরা ধরা। আর স্পষ্ট দেখলাম, ওর দুটি চোখে জল টলটল করছে।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, কী হল? মন খারাপ করার মতো কোন ঘটনা? বলা যায় না এমন কিছু?
মাধবী বলল, কষ্ট হচ্ছে।
কেন ? কে কষ্ট দিল ?
কেউ না। নিজে নিজেই কষ্ট পাচ্ছি। একটু থেমে বলল, আমি এত বেড়ালাম। বাধা দেওয়া দূরে থাক। তুমি কেমন সহজে সেটা মেনে নিলে।
তাতে কি হয়েছে ! আমি হেসে বললাম, বেড়ানো তোমার কপালে লেখা আছে। আমার যেমন একবারই। একমাত্র যায়গা ……..।
মাধবী আমায় কথা শেষ করতে দিল না। ওর হাতের তালুতে আমার মুখ চেপে ধরল, নিজে মুখে আর বলবে না।
আমি মাধবীর হাত সরিয়ে দিলাম, কেন?
আমি বলছি। তোমার বেড়ানো নিয়ে অনেক ঠাট্টা করেছি। এবার সত্যি সত্যি বলছি, আমরা দুজন একসঙ্গে বেড়াতে যাব।
একসঙ্গে ? দুজনে ? কোথায় ? কথাগুলি যেন আপনা আপনি আমার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
মাধবী ঘাড় দুলিয়ে হেসে বলল, আন্দাজ করো। পারলে না তো? অপলক আমার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, শিমূলতলা। আমাদের শিমূলতলা।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]