গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

ভুল সিলেবাস

অনেক দিন সাড়াশব্দ নেই তিতলির। নিজে থেকে ফোন করিনা সচরাচর, কি জানি, ব্যস্ত আছে হয়ত। পুজোর মধ্যে দুটো দিন এলো বটে, তবে সে তো ঝড়ের মতন সফর!
রাত হয়েছে বেশ, তার মধ্যেই ফোনটা এলো,
মণি, কি করছ?

কী আর করা, নতুন একখান বই এসেছে হাতে, হাইকু র অনুবাদ, তাই উল্টোচ্ছি, বেশ লাগছে!

দিব্যি আছ,আমার তো চাপে চাপে জেরবার অবস্থা! আচ্ছা মণি, তোমার জীবনে কোনও অ্যাম্বিশন, কোনও কম্পিটিশন, কিচ্ছু নেই, না?

পাগল হয়েছিস? আমি ওসব ভুলভাল সিলেবাসের লোকই না! তাছাড়া এত বয়স হল, অসুবিধে তো হয়নি কোনও দিন, না ছুটেও তো ভালই আছি!

কিন্তু কম্পিটিশন তো সর্বত্রই, না ঢুকে উপায় কি?

কে বললে, এসব? সবাই করে বলেই সবাই করে! আর কেই বা মাথায় দিল যে সবকিছুই ঠিকঠাক করতেই হবে? একটাও ভুল করা চলবে না? একেবারে নিখুঁত হতে গিয়েই কত্ত লোকের সর্বনাশ হয়ে গেল জানিস? রোজ রোজ হচ্ছে, তবু লোকে ওই কমপালসিভ ধরনটা ছাড়তে পারলে না!

ভুল করলে চলবে নাকি? কী যে বলো তুমি!

ইয়েস ম্যাডাম, পৃথিবীর সব বড় বড় আবিষ্কার তো ভুল হয়েছিল বলেই হয়েছে, অতএব ভুল না করলে ঠিক হবে কোত্থেকে?

তাহলে তোমার সিলেবাসে কোনও রিস্ক নেই বলছ?

সেটা আবার কখন বললুম? আমি শুধু বলেছি ভুল ঠিক বলে কিছুই নেই, কাজ করো মনের আনন্দে,যা হবে সেটাই ঠিক, এত মারামারির কিছু নেই, এইতো! ভুল করতে করতেই ভুলের মজাটা একবার পেয়ে গেলেই বুঝবি এসব! যাকগে, অনেক বাজে বকেছি, এখন তোর খবর বল্?

মণি, আমি না কেমন কনফিউজড হয়ে গেলাম!
এই যে আমরা এতো ছুটছি, এর কোনও মানে নেই নাকি?

মানে তো ইভোলিউশনারী! সারভাইভালের! সারাক্ষণ ভয়, এটা না করলে হবেই না, ওটা তো করতেই হবে! সবসময়ই ভাবছি, সবাই সব করে ফেললে, নিয়ে নিলে আমার জায়গাটা কোথায় থাকবে!! আর এই করতে করতেই বেলা গড়িয়ে গেল, আমি কি পেলাম না সে হিসেবেই আর দেখাই হলোনা, কি কি হাতের কাছে পেয়েও ফেলে দিলাম!

তাহলে তোমার সিলেবাস টা বলো!

আমার সিলেবাস? সে খুব সহজ! পরিস্কার জানি, আমার ভাগে সবই আছে, সময় হলেই পাবো, তাই ছুটি না! লাফ দিয়ে লোকাল ট্রেনের জানলার ধারের মারামারি কবে ছেড়ে দিয়েছি, জানিই তো, ট্রেনে উঠলে একইসাথে পৌঁছে যাব! আমি ছবি তুলি, লোক দেখি, মুখের ভাব দেখি, প্রচুর ভিড়ের মধ্যেই ঝুলন্ত অবস্থাতেও মনে মনে গান আসে, সুর আসে, সকালের আলো দেখি, কালকের কচি পাতা টা আজ কেমন লক লক্ করে উঠল দেখতে পাই, বৃষ্টির জলে কত বিচিত্র প্যাটার্ন দেখতে পাই, অন্যরা যেটা পায়না!
আমার সিলেবাসে কোনও তাড়াহুড়ো নেই, অ্যাম্বিশন না থাকাটাই আমার টি আর পি রে!
সকলেই জীবন কাটায়, আমি উপভোগ করি তাই!

লোকে তাহলে এই সোজা পথটা দেখছে না কেন?

ওরা তো সবসময়ই কালকের কথা ভাবে রে, তাই আজকের বাঁচাটার কথা ভুলেই যায়!
রেগে যায়, টেনশন করে, আরও কত কি!
ওরা বোধহয় অমর হতে চায় সকলে!

তুমি চাওনা, অমর হতে?

চাই তো, আবার চাই না ও বটে!
এসেছি যখন, যাবও সিওর! যখন থাকব না, সেদিন লোকে কি বলবে সেটাই অমরত্ব!

তুমি আসলে কুঁড়ে!

কুঁড়ে লোক আসলে ইন্টেলিজেন্ট! সে তো আগেই জানে এতো খেটে লোকে নিশ্চিন্ত হতে চাইছে, বিশ্রাম চাইছে,সেটা তো সে আগেই পেয়ে গেছে, আর কী?

তোমার সঙ্গে কথা বলাই বৃথা! রাত দুপুরে এতটা সময় নষ্ট হয়ে গেল!

তাহলে একটা গোপন মন্ত্র বলে দিই?
আমি দু তিনটে কাজ কখনও করিনা!

কিরকম?

এক, খারাপ সময়ে ধৈর্য হারাই না। দুই, ভাল সময়ে জিভের লাগাম ছাড়িনা!

আর, তিন?

নিজে যে ব্যবহার পেতে চাই না, তেমন ব্যবহারও কারও সাথেই করিনা, ব্যস্!

রাত ঢের হয়েছে, তিতলির ফোনও গেছে কেটে, সেলফোন বলে কি মানুষ নয়!

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৩, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
5 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
1 year ago

Dr গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় এর লেখা খুব সুন্দর। খুব সহজ ভাবে কঠিন ভাবনাচিন্তা বুঝিয়ে দিতে ইনি বিশেষ পারদর্শী। প্রতি সংখ্যায় লিখবেন ও সবাই উপকৃত হবেন।

Tapan Ray
Tapan Ray
1 year ago

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ভুল সিলেবাস রচনার নামকরণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

পার্থ সারথি বণিক
পার্থ সারথি বণিক
1 year ago

অ্যাম্বিশন না থাকাটাই ‘টি আর পি’! সহমত। ম্যাকবেথ-এর vaulting ambition এর কথা মনে পড়ছে!

Subhamay Ray
1 year ago

ভালো লাগল। আপনাদের ওয়েবজিনের কোথাও ই-মেল যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। অনূদিত গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি বিবেচিত হয় কি না জানতে চাইছিলাম।

সম্পাদক
সম্পাদক
1 year ago
Reply to  Subhamay Ray

আপনি এই পত্রিকা পড়ছেন জেনে ভাল লাগল। লেখা পাঠানোর ঠিকানা সহ অন্যান্য যোগাযোগ শিগগিরই About Us পাতায় দেওয়া হবে। আপাতত contact@paramparabooks.com এই ঠিকানায় আপনার জিজ্ঞাস্য জানাতে পারেন।