পর্ব ৬

মনখারাপটা যাচ্ছে না। রোজ ভোরবেলা ঘুম ভাঙলেই সিরাজদ্দৌলা নাটকের সেই লাইনগুলো মনে পড়ছে – ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, তার শ্যামল প্রান্তরে আজ রক্তের আলপনা’। নাট্যকার শ্রী শচিন সেনগুপ্ত মশাই সেদিনের দুর্ভাগা সময়ে ‘রোরুদ্যমানা জননী’–কে কল্পনা করেছিলেন ‘সুপ্ত সন্তান শিয়রে’। আমরা কয়েক কদম এগিয়েছি। উন্নয়নের ধাক্কায় মৃতা ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিতা মেয়ের হতভাগ্য মা (এবং বাবা) সন্তানের শিয়রে বসার সুযোগটুকু পেতেও লড়াই করে যান। আসলে দেহ ছিনতাইয়ের চিত্রনাট্য রচনা করার পরিকল্পনা শচিন বাবুর চিন্তার বৃত্তে প্রবেশ করে নি কোনদিন, এ কথা হলফ করেই বলা যায়।

আর মাসটি যেহেতু সেপ্টেম্বর, তাই এই আবহেই প্রতিবারের মতন এবারও এসেছে বন্যা আর পুজো। প্রথমটির সঙ্গী ম্যান আর উওম্যান মেডের বিতর্ক, ত্রাণ নিয়ে বিপুল দখলদারি আর নয়ছয়। তবে একই গল্প প্রতিবার পড়তে পড়তে মন খানিকটা বিবশ হয়। বন্যায় ক্লিষ্ট মানুষের যন্ত্রণা যেন মনের উঠোনে বয়ে চলা স্রোত, তার ঘরের ভেতরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠ ডেসিবেল বাড়াতে থাকে। পুজোর উদযাপনেও তাই ঘাটতি পড়ে না। কিন্তু এই বছরে পট পাল্টেছে। একে তো এক ভয়ঙ্কর ঘটনা আর তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের প্রায় সমাজবিরোধী ভূমিকা, তায় আবার ‘উৎসবে’ ফেরার ধমক। তাতে উৎসব আর পুজোর মধ্যে একটা আড়াআড়ি ফাটল জন্মে গেছে। মানুষ পুজো হয়ত করবেন এ বছর, তবে তাতে আনন্দের ভাগে কম পড়বে খুব।

তবু যখন কলম্বাসের দেশ (এতে অবশ্য সত্যির চেয়ে মিথ্যে বেশি)-এর কথা বলতে বসেছি, এই পর্বে সে দেশের পুজোর কথাই কিছু বলি।

আমার ও দেশের পুজোর সঙ্গে প্রথম পরিচয় ২০১০ সালে। কয়েকটা কথা তো সকলেই এখন জানেন যে এখানে যে কোন অনুষ্ঠানের অবকাশ উইকএন্ডের দুই দিনে। মাকে, থুড়ি মায়ের পুজোকে কেটে কুটে টেলরমেড করে নিয়ে তার উদযাপন হয়। দিনক্ষণ ফ্লেক্সিবল, অসীম ক্ষমতাধর বাঙ্গালিরা নক্ষত্রের অবস্থানকে হাতে করে ঠেলেঠুলে তিথি বানিয়ে নেন। টেক্সাসের লাবক শহরে এক শনিবারের সকালে তেমনি এক পুজোবাড়িতে আমেরিকার প্রথম পুজোর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ।

যাঁর বাড়ির কথা বলছি, তাঁকে একডাকে পৃথিবীর গুনীজনেরা চেনেন। প্রফেসর শঙ্কর চ্যাটার্জি টেক্সাস টেক ইউনিভার্সিটির ভূ-বিদ্যার অধ্যাপক, জীবাশ্ম চর্চায় জগৎজোড়া খ্যাতি তাঁর। ওনার আর একটি পরিচয় উনি মহীনের ঘোড়াগুলি দলের কিংবদন্তি শিল্পী শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের আপন ভাই। ওনাদের রক্তে সঙ্গীত, তাই ছেলেরাও বিজ্ঞানের শাখায় ভীষণ ভীষণ সব গবেষণাকাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেও প্রাচ্য পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রায় বিশারদ।
পৌঁছলাম যখন, তখন বিশাল লিভিং রুমে ঠাকুর এসে গেছেন। মাটির তৈরি প্রায় চার ফূট মাপের ঠাকুর, শোলা আর জড়ির সাজে একেবারে উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – এত বড় ঠাকুর নিয়ে এলেন কোথা থেকে?

শঙ্কর বাবু রসিক মানুষ, মুখে একটা স্মিত হাসি লেগেই থাকে। কবছর আগে স্টার আনন্দে ‘সেরা বাঙ্গালি’-র পুরস্কার নিতে তাঁকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা মনে করতে পারবেন নিশ্চয়ই। গলার স্বরে একটা শান্ত ভাব, তবে একটা হিউমারাস আন্ডারটোন (এটার সঠিক বাংলা করা মুশকিল) আছে।
সেই স্বরে গলায় মজা এনে মিটি মিটি হেসে বললেন, ‘ঠাকুর তো কোথাও যাননি! উনি তো এখানেই থাকেন’।

আমি আরও হতভম্ব। এর আগে ওঁর বাড়িতে কমবার তো আসা হল না আমার। কখনো কোন মন্দির বা ঠাকুরের দেখা তো পাইনি!

জিজ্ঞাসা করাতে চোখ টিপে বললেন ‘কাল দেখাব’।

রীতিমত কৌতূহল চেপে রেখে বাকি পুজোয় সামিল হলাম।

লাবকের জ্ঞানী মানী মানুষদের অনেকেই উপস্থিত। তাঁদের পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই এখানে বেড়ে ওঠা, ভারতীয়তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই বা কম। ফলে পুজো আর উৎসবের মধ্যে এখানেও একটা আড়াআড়ি ফাটল। সিনিয়ররা তাদের বিগত দিনের স্মৃতি আর পরম্পরার উদযাপনে অনেক বেশি পুজোয় মগ্ন, আর পরের জেনারেশন তার উৎসব অংশটার প্রতি বেশি উৎসাহী। শেষে বুফে লাঞ্চের টেবিলে সব মত ও পথের মিলনমেলার দেখা মিলল। মিসেস চ্যাটার্জি আর তাঁর হাতে হাত লাগানো ক’জনের পারদর্শিতায় কলকাতার প্যান্ডেলে সারা পাড়া এক হয়ে পাত পেড়ে খাওয়ার স্মৃতি ফিরে এল।

বাঙালির দশটা মাথা এক হলে এগারতম ব্যক্তি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আগমন অবধারিত। আর এমন বাড়িতে হারমোনিয়াম থাকবে না সেটা প্রায় অসম্ভব। অতএব গান এল। ছোটদের আবৃত্তিতে নজরুল, সুকুমার রায় এলেন, অবশ্য সাহেবী বাংলা উচ্চারণে। প্রোফেসর চ্যাটার্জির ছোট ছেলে বেহালায় সুর তুলল “অসীম কাল সাগরে…।” ভুবন তখন সত্যিই ভেসে যাচ্ছে নবজীবনের উদ্বোধনের মন্ত্রে।

পরদিন দধিকর্মা। ঘটের সুতো ছেঁড়ার পর বিসর্জন। দেখি ঠাকুরের চেয়ে একটু বড় মাপের এক বাক্স বেরিয়েছে, সামনের ডালা খোলা। ঠাকুরের অস্ত্রশস্ত্র, সাজের ডিসপোজেবল অংশ খুলে ফেলা হল, রাখা হল একটি ছোট বাক্সে। আর ঠাকুর সেঁধোলেন বড় কাঠের খাঁচায়। এক বছর বয়স বাড়লে আবার আলোর মুখ দেখবেন।

ডালাটা বন্ধ করতে করতে প্রোফেসর চ্যাটার্জি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। প্রত্যুত্তরে একটা বোকা হাসি ফিরিয়ে দিলাম সকলের চোখের আড়ালে। ওনার ভাইয়ের কথায় “আর কি বা দিতে পারি?”

এর বছর দশেক পরে আমেরিকার বারোয়ারী পুজো দেখার সুযোগ হয় পোর্টল্যান্ড শহরে এসে। পড়াশোনার গন্ডি পেরিয়ে মেয়ে তখন এখানে তার কর্মজীবনে থিতু হয়েছে। চতুর্দিকে প্রবাসী বাঙ্গালির মেলা। অবাঙ্গালি ভারতীয়দেরও প্রবল উপস্থিতি। বস্তুত এখনকার বড়, মেজ এমনকি কিছু কিছু ছোট শহরেও ভারতীয়দের সংখ্যা চোখে পড়ার মত। প্রায় প্রত্যেক জায়গায় আছে এদের সংগঠন যারা বিভিন্ন ভারতীয় উৎসবের আয়োজন করার থেকে তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করায় সবিশেষ ভূমিকা রাখে। এইসব প্রবাসী সংস্থায় বাঙ্গালিরা আয়োজন করে দুর্গা পুজোর। তবে আয়োজক তারা হলেও অবাঙ্গালিরা বিপুল সংখ্যায় অংশ নেয় তাতে।

২০১৯ এর অক্টোবরের এক শনি রবিবার দেখে পোর্টল্যান্ডে সেবার আয়োজন হয়েছে পুজোর। সকলের চাঁদায় এক্কেবারে ক্ল্যাসিকাল বারোয়ারী পুজোর আয়োজন। ব্যবস্থাপনায় পুজোর গায়ে বেশ একটা কর্পোরেট কালচারের ছাপ। তেল খাওয়া যন্ত্রের মসৃণতায় চলে সব, তবে তা মাখতে কড়ি বড় কম ফেলতে হয় না। আয়োজন হয়েছে স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে। প্রথম দিনের সক্কালবেলা মা ছানাপোনা নিয়ে বাক্স থেকে বেড়িয়ে এসেছেন। বিরাট হলের একদিকে মণ্ডপ, রীতিমত ফুল পাতা আর কাপড়ের নানা কারুকাজ দিয়ে তৈরি। কাগজের স্টেন্সিলে করা নক্সা, থারমোকল আর শোলা কেটে নানা মাপের মোটিফ আগে থেকেই তৈরি হয়েছে বাড়ি বাড়ি। একঘন্টার মধ্যে তারা যে যার নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে গেছে। পুরোহিত মশাই গরদের ধুতি চাদর পড়ে তদারকি করছেন। ভদ্রলোক সেই এয়ার মেল আর টেলিগ্রামের আমল থেকে এদেশের বাসিন্দা। নিষ্ঠা সহ দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন, এখন পুরোহিতের অ্যাসাইনমেন্টেও যে সমান নিষ্ঠা তাঁর, সেটা তাঁর চলাফেরা আর তদারকির ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে। সামনের ঘেরা অংশে মেয়েরা ফল কাটতে লেগেছে। নৈবেদ্য সাজাচ্ছে। ওমা, ওটা সায়ন্তনী না? শাড়িতে একেবারে রাজবাড়ির গিন্নিমা লাগছে রে তোকে! তিনমাসের ছেলে কোলে করে চলে এসেছে ব্রততী, তারপর বাপের কোলে ছেলে ছুঁড়ে ফেলে বসে পড়েছে চন্দন বাটতে। কে বলবে অফিসে এর প্রতাপে সাদা চামড়ার ছেলেমেয়েগুলোও থরহরি কম্পমান। পিঠের ওপর ছড়ানো ভিজে চুলের থেকে টপটপ জল পড়ে ব্লাউজ ভিজিয়ে দিচ্ছে রূপসার, দেখে পুজোয় আসা মায়ের চোখ ভিজে উঠছে তৃপ্তিতে, অপত্যস্নেহে।

বাইরে রেজিস্ট্রেশনের টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে সুমিত আর তাঁর পাঁচ সঙ্গী। ডলার নিচ্ছে, তারপর যে যেরকম অংশ নিতে মনস্থ করেছে, অর্থাৎ কেউ শুধু পুজোর প্রসাদেই খুশি, কেউ দুপুরের লাঞ্চটিও খাবে, কেউ একদিনের সন্ধ্যেবেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আছে, কেউ দুদিনই ফাংশান দেখবে – এমন সাত সতেরো ভ্যারিয়েশনের নানা রঙের আর মাপের টিকিট আর রিস্ট ব্যান্ড সরবরাহ করে যাচ্ছে তারা। প্রত্যেকটির গায়ে কিউ আর কোড। স্ক্যান করে তবেই না হাতে আসবে খিচুড়ি আর লাবড়ার লাঞ্চ, কানে পৌঁছবে ইমনের গলার সুর।

হ্যাঁ, সেবারে দ্বিতীয় দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ইমন চট্টোপাধ্যায়ের গান। প্রথম দিন অবাক করেছে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য আর মান। ৭০-এর সিনেমার গান নামের এক অনুষ্ঠানে পেছনের বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে দৃশ্যটি, আর সামনে মেয়েরা নাচ করছে, তাদের কস্টিউমে সেদিনের বেলবটস আর সালোয়ার স্যুট। চিরকুমার সভার অংশ অভিনয়ে শুধু মঞ্চসজ্জার দিকেই তাকিয়ে কেটে যাচ্ছে সময়, সঙ্গে দুরন্ত অভিনয় আর কস্টিউম তো আছেই। দ্বিতীয় দিনে ইমনের গলায় দু ঘন্টার সুরের বন্যায় ভেসে গিয়েছিল প্রায় ছয় সাতশো শ্রোতার অডিটোরিয়াম। অনুষ্ঠান শেষে সকলের মাঝে সহজ হয়ে নেমে এসেছিলেন শিল্পী আর তাঁর সহযোগীরা। দীর্ঘক্ষণ গল্প আর অন্তরঙ্গ আলাপশেষে যখন কারোর ইমনদি, কারোর ভাই ইমন হয়ে তিনি বিদায় নিচ্ছেন, তখন মনে হল দিনের শেষে আকাশের তারারাও মাটি ছুঁতে চান।

মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কপালে ভালোবাসা আর মমতার চন্দনের টিপ লাগলে তবেই না পুজো হয়ে ওঠে উৎসব। এই সহজ সত্যটা বোঝেনা আমাদের দুর্বিনীত শাসক। অথচ আমেরিকার মাটিতে তার সুবাস পেতে কখনও অসুবিধে হয় না।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য