কলম-বাসি কথা (পর্ব ৭)
২০২৪ সমাপ্তির পথে। লক্ষ্মীপুজোর পর অফিস, ইস্কুল, কলেজ খুলে ধুলো পড়া চেয়ার টেবিলে পালকের ঝাড়নের ছোঁয়া লেগেছে। আর তাদের কর্মীদের অনেকের মনই পালকের মতই হালকা। পুজোয় বেড়াতে গিয়ে তার স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসা মনে খুশির বোনাস। পাহাড় ঝর্না সমুদ্রের ঢেউয়ে মজে আছেন অনেকেই। বাবা মায়ের সঙ্গে যাওয়া কিশোরটির বাড়তি সংগ্রহে হয়ত বেড়ানোর দলের কোন এক কিশোরীর হরিণ চাহনি আর মোবাইল নম্বর।
আমেরিকাতেও বেড়ানোর জায়গা বিস্তর। ওদের খুব পছন্দ হাঁটা, লম্বা লম্বা ট্রেক করা, ক্যাম্পিং করা, রাতের আকাশ দেখা। প্রকৃতির সঙ্গে গা ঘষাঘষি করা। দেশটা ইউরোপ বা এশিয়া নয়। অতএব প্রাচীন স্থাপত্যে বুঁদ করে রাখার সম্পদ নেই। প্রাচীন বলতে তার কয়েক হাজার বছরের পুরনো আদিবাসিরা, যাদের চলতি কথায় বলি রেড ইন্ডিয়ান – তাদের বসবাসচিহ্ন। তা তাদের দলে পিষে মাড়িয়েই তো নব্য আমেরিকার উৎপত্তি আর বিস্তার। ফলে সে প্রাচীনতার অনেকটাই লুপ্ত। এই কিছুদিন হল তাদের অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদের শিল্প সংস্কৃতি পেয়েছে তথাকথিত সভ্য আমেরিকানের মনোযোগ। বনাঞ্চল, সেখানকার আদিবাসী বসবাসের অবশেষ এখন যত্নের সঙ্গে রক্ষা করছে নব্য আমেরিকা। এরকম পঞ্চাশটিরও বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল আমেরিকা জুড়ে। তেমনি এক বনাঞ্চল স্মোকি মাউন্টেন্স।
স্মোকি মাউন্টেন্স ন্যাশনাল পার্ক টেনেসি নদীর অববাহিকায় টেনেসি আর নর্থ ক্যারোলিনা প্রদেশের সওয়া ৫ লক্ষ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে এক সংরক্ষিত উদ্যান। তার বর্ণনায় বলা হচ্ছে : ‘Its broad shoulders stretch out across the horizon, with the point of its crowned head towering high above its peers. It lives at times amongst the clouds, often residing in the land of the Gods…..Like an island in preserves it harbors the secrets to life, its lungs give back to the earth what the world tries to take away……Often existing under a heavy mist it has captured the essence of its resounding name…..land of the smoking mountains…..the great Smoky Mountains National Park.’
আইনত সংরক্ষিত উদ্যানে পরিণত হবার আগে এ জায়গা ছিল ‘চেরোকি ইন্ডিয়ান্স’ নামে পরিচিত আমেরিকার আদিবাসীদের বিচরণক্ষেত্র। বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে এ অরণ্যের স্প্রুস, সেডার, মেপল গাছের ছায়ায় ছায়ায় অতিবাহিত হয়েছে তাদের বাল্য কৈশোর, পপলার আর ম্যাগনোলিয়ার নিশ্চিন্ত নির্জনতায় উদযাপন হয়েছে তাদের যৌবনের, আর প্রবীণ বার্চের পায়ের কাছে বিকেলের সূর্যের মরা আঁচে কেটেছে তাদের বার্ধক্যের দিনগুলো। টেনেসি নদীর থেকে ওঠা বাস্প আর ফার, ওক, মেপলের কোলে কাঁখে খেলে যাওয়া হাওয়ার মিশ্রণ এখানে তৈরি করে এক নীল কুয়াশা যা ঢেকে রাখে পাহাড়ের মুখ। চেরোকি ইন্ডিয়ান্সরা আদর করে এই জায়গার নাম দিয়েছে Sha-co-na-qe অর্থাৎ Land of blue smoke. তার থেকেই আজকের নাম স্মোকি মাউন্টেন্স। এই স্মোকির পাহাড়ের সানুদেশে কতকাল আগে তারা বানিয়েছিল কাঠের ঘর – পরিভাষায় লগহাট, যাদের অনেকগুলো পরমযত্নে আজও সংরক্ষিত। পাশাপাশি এক ব্যতিক্রমী সামাজিক রীতির উদযাপন করতে তারা তৈরি করেছিল এক বিশেষ ধরনের বাড়ী যার আজকের প্রচলিত নাম ‘Weaner’s cabin’। এখানে বিবাহ পরবর্তী জীবনের দীক্ষা দেওয়া হত নববিবাহিত দম্পতিকে। লোকালয় থেকে দূরে এই বাড়ীর নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে নবদম্পতি আপন খেয়ালে কাটাত কয়েক সপ্তাহ সময়, আর অল্প দূরে তাদের পরিবারের মানুষেরা মজুত থাকতেন তাদের বাসন মাজা, কাপড় কাচার মত অবাঞ্ছিত কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য। পরবর্তীকালে ১৮১৮ থেকে ১৮২১ – এই সময়ের মধ্যে সংলগ্ন অঞ্চল আর ইউরোপ থেকে এসে বাসা বাঁধেন কিছু শ্বেতকায় পরিবার। গড়ে ওঠে স্কুল, গির্জা, ছোটখাটো কারখানা, খামারবাড়ি এমন কি পোস্টঅফিসও। ক্রমে দল ভারি হতে শুরু হয় এদের। শুরু হয় সভ্য মানুষের সভ্যতার আস্ফালন। রীতিমতো আইন করে পাশ হয় ‘ইন্ডিয়ান রিমুভাল অ্যাক্ট’ যার ক্ষমতাবলে শুরু হয় সমস্ত চেরোকি ইন্ডিয়ান মানুষদের পুনর্বাসনের নামে নির্বাসিত করার প্রক্রিয়া। ঠাঁই হয় মিসিসিপি নদীর পূর্বপারে ওকলাহোমা প্রদেশে। তার অমানবিক ইতিবৃত্ত ইতিহাসে Trail of Tears নামে ঠাঁই পেয়েছে। তবে সবটাই পরাজয়ের ইতিহাস নয়। সালি (Tsali) নামের অমিতবিক্রম এক মানুষের নেতৃত্বে বেশ কিছু ইন্ডিয়ান তাদের দখল বজায় রাখে অরণ্যের একটা বড় অংশে। সেই অংশটাই আজকের স্মোকি মাউন্টেন্স ন্যাশনাল পার্ক।
এ হেন একটা জায়গার মুখোমুখি বসতে আমরা উত্তেজনার আঁচ পুইয়েছি কয়েকমাস ধরে। প্রস্তুতি নিয়েছি দীর্ঘ। অথচ যাবার সময় হঠাৎ বিপদ। যে সময়ে আমেরিকায় পৌঁছলাম সে সময়ে চলছে গভর্নমেন্ট শাট্-ডাউন নামে এক কিম্ভুতকিমাকার জিনিস। কারখানা বনধ্, বাজার বনধ্, বাংলা বনধ্ ছাড়িয়ে একেবারে সরকার বনধ্। আমরা চূড়ান্ত হতাশ; এত অপেক্ষার শেষে প্রেমিকার দেখা না পাওয়া গেলে আর কি বা থাকতে পারে প্রাপ্তির কোটায়। তবে প্রাণপণ ইচ্ছাশক্তির কাছে ভগবানও হার মানেন, আমেরিকান গভর্নমেন্ট তো ছেলেমানুষ। ১৬ তারিখ থেকে উঠে গেল শাট্ ডাউন। আমাদের যাত্রা ১৭ই। অতএব ১৬ই মধ্যরাত্রি থেকে দ্বিগুণবেগে আমাদের যাত্রা উৎসবের ষষ্ঠীপূজো।
পরদিন সকাল ৭টায় বিমানযাত্রা লাবক শহর থেকে আটলান্টার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে ৪ ঘণ্টা দূরে পিজিয়ন ফোর্জ শহর। পুরো রাস্তার শেষ ১০ মাইল মনে করালো আমাদের জ্যামবিঘ্নিত বম্বে রোডকে। যানজটে এটুকু রাস্তা পেরোতে সময় লাগল ১ ঘণ্টারও বেশী সময়। আসলে স্মোকিস-এর কাছে বছরে আসেন ৮০ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ আর সুনামিটা আসে এই অক্টোবরেই। ফলে এই ব্যতিক্রমী অবস্থা। এ সুনামির ঢেউয়ে চড়েই আমাদের প্রথম গন্তব্য গ্যাটলিনবার্গ শহরতলি যা আসলে স্মোকিস-এ ঢোকার সদর দরজা। পিজিয়ন ফোর্জ তখনো ৫ মাইল দূরে।
প্রথামত আমরা যাব গ্যাটলিনবার্গের সুগারল্যান্ড তথ্যকেন্দ্রে আর সেখান যাবতীয় তথ্য ও ম্যাপ সংগ্রহ করে পিজিয়ন ফোর্জে উঠব হোটেলে। সেখান থেকে এক এক দিনে এক এক দিকে পাড়ি দেবো। কিন্তু তথ্যকেন্দ্রেও বলা যায় তথ্যের সুনামি। পাহাড়, ঝরনা, ঐতিহাসিক সংরক্ষিত বাড়িঘর ইত্যাদি মিলিয়ে যাবার জায়গা কম করেও ৪০। আর আমাদের সময় কুল্যে ৩ দিন। আমার মেয়ে তর্জনী আর মধ্যমা প্রবলবেগে নাড়িয়ে একসময় স্থির করে বলল, বাবা ধরো। ধরলাম, আর আমাদের প্রথম গন্তব্য নির্দিষ্ট হল ক্লিংগম্যান্স ডোম। এইভাবেই স্থির হল ক্রমানুসারে যাওয়া হবে রোরিং ফর্ক ট্রেল, কেড’স কোভ, নিউফাউন্ড গ্যাপ রোড, আর চেরোকি গ্রাম। আগামী তিন দিনে তাদের উঠোনে গিয়ে খাওয়া বসা চলবে আমাদের।
(ক্রমশ)
বেশ ইনফরমেটিভ ভ্রমণ কাহিনী। ভালো লাগছে পড়তে।
ধন্যবাদ দীপক বাবু।
খুব ভালো লাগলো
খুব ভাল লাগছে পড়তে। পরবর্তী সংখ্যার অপেক্ষায় রইলাম।