(আমেরিকার স্মোকি মাউন্টেন বেড়ানোর এটা তৃতীয় ও শেষ পর্ব। ‘কলম–বাসি কথা’-রও। কথার তো শেষ নেই। তবে কিনা কথা কইতে জানতে হয়। তবেই না কথা বয় সহস্র ধারায়। আগামী কিছু সময় সেই শৈলী আয়ত্ত্বের সাধনায় সময় কাটাই। আর একটু ভাল করে বলতে শিখতে পারলে আবার নাহয় আসা যাবে আমেরিকার কথা নিয়ে পরম্পরার অভিজাত পাঠকের দরবারে।)

Wish that I was on old Rocky top,
Down in the Tennessee hills.
Ain’t no smoggy smoke on Rocky top,
And no telephone bills.
Once I had a girl on Rocky top,
Half bear the other half cat.
Wild on a mink but sweet as soda-pop,
I still dream about that.

ষাটের দশকের শেষে অসবোর্ন ব্রাদার্সের এই গান নীল কুয়াশার মত আচ্ছন্ন করেছিল আমেরিকা, ইউরোপ এবং ভারতবর্ষের কিছু মানুষকেও। এতে রকি টপ বলে যে জায়গাটার কথা বলা হচ্ছে তা আদতে কেড’স কোভ – আমাদের পরেরদিনের প্রথম গন্তব্য। কোভ মানে উন্মুক্ত জায়গা। সত্যিই এটা পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা বিস্তীর্ণ সমতলক্ষেত্র। চেরোকি ইন্ডিয়ান্সরা এখানে চাষ-আবাদ করত, ধরতো শিকারও। ইউরোপীয়রা এখানে এসেই প্রথম বসতি স্থাপন করে এবং ইন্ডিয়ানদের এক মোড়ল কেড-এর নামে নাম দেয় কেড’স কোভ। দীর্ঘ বসবাসের স্বাক্ষর বহন করছে বেশ কিছু পুরনো লগহাট, তিনটে গির্জা, একটা ছোট কারখানার অবশেষ।

অবশেষ, কিন্তু ধ্বংসাবশেষ নয়। এই কারখানায় আজও সেই প্রাচীন পদ্ধতিতে তৈরি হয়ে চলেছে ইন্ডিয়ানদের হস্তশিল্পের নমুনা। হেরিটেজ সীলমোহর পাওয়া এই অবশিষ্টাংশ হেরিটেজের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে উপযুক্ত সংরক্ষণসহ। বন্যজন্তু, বিশেষত ভালুকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দুটি জায়গার একটি এই কেড’স কোভ। যদিও আমরা তাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাইনি। সাদা কানের হরিণ কয়েকজন এসে আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে গেছে। এসেছে দশ বারোটা এল্‌ক-এর দল। কয়েকটা বুনো টার্কি। আর এসেছে গাছের পাতারা – লাল জামা, হলুদ জামা, সবুজ জামা, কোথাও বা বেগুনি জামা পরা পাতার দল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হেসেছে আমাদের বিস্ফারিত দৃষ্টি আর ঝুলে পড়া চোয়াল দেখে। ঢলে পড়া সূর্যের আলোয় যখন পাহাড়ের গায়ের গাছের মাথাটুকুতে আলো আর পায়ের কাছে ছায়ার খেলা – যে আলো সাদা হয়ে ঢুকে স্ফটিকের বিপরীত পৃষ্ঠতল থেকে বেরনো বর্ণালীর রং হয়ে পাতার ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে দৃশ্যমান প্রকৃতিকে – তার দিকে তাকিয়ে অনুভব করেছি সেই মহামহিমের গরিমা। তোমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর আমার প্রেম হোত যে মিছে। গাছে গাছে লাগা আগুন দেখতেই তো আসা – তবে দেখতে পেয়ে কেন যে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ! অনুভব করি আমার চোখে এখন অভাবনীয়কে পাওয়ার আনন্দাশ্রু।

এভাবেই যাই নিউ ফাউন্ড গ্যাপ রোডে। বত্রিশ মাইল লম্বা এই রাস্তা স্মোকির বুক মাঝবরাবর চিরে ফিতের মতন পড়ে রয়েছে একপ্রান্তে টেনেসি আর অন্য প্রান্তে নর্থ ক্যারোলিনাকে নিয়ে। নামের আগে ‘নিউ’ বিশেষণটার কি অর্থ ? কতটা নিউ ? খুব বেশী নয়। মাত্র ১৮০৫ সালে স্মোকির আদিবাসীরা হঠাৎ খুঁজে পায় একটা ছোট্ট পরিসরের যার মধ্যে দিয়ে অনেক সহজেই স্মোকিস-এর মূল অঞ্চলে প্রবেশ করা যায়। তার আগে অনেক উঁচু দিয়ে এক পায়ে চলার পথ ছিল এই অঞ্চলের একমাত্র প্রবেশপথ। নতুন পাওয়া এই পরিসর পরিচিত হল নিউ ফাউন্ড গ্যাপ নামে। পরে ন্যাশনাল পার্ক তৈরির পর্বে পরিকাঠামো গড়ার অংশ হিসেবে এই গ্যাপকে কেন্দ্রে রেখে টেনেসি থেকে নর্থ ক্যারোলিনা পর্যন্ত তৈরি হল এক আধুনিক রাস্তার – নাম দেওয়া হল নিউ ফাউন্ড গ্যাপ রোড। এই নতুন পথ উচ্চতার সমস্যা আর ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি দিল চেরোকি ইন্ডিয়ানদের। আর আজকের ভ্রমণপিপাসুদের জন্য খুলে দিল এক অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জগত। কারণ এর দুদিকেই সর্বাধিক সমারোহ পরিভাষায় যাকে বলে ফল কালার্সের বাহারের। চলতে গিয়ে দেখলাম শুরুর দিকটা অনেকটাই সমতল। সেটুকু পেরিয়ে বাঁ দিকে বেঁকতেই রাস্তার অভিমুখ ওপরের দিকে হয়ে গেল। আর কোণা থেকে উঁকি মারল বিশাল পাহাড়। তার গায়ে গজিয়ে ওঠা গাছেরা সেই বিখ্যাত নীলাভ কুয়াশায় ঢাকা। ডান পাশ দিয়ে সঙ্গে চলেছে লিটিল পিজিয়ন ফোর্জ নদী। বিশালবপু গাছেদের আড়ালে একবার মুখ দেখিয়ে আবার কোথায় লুকিয়ে পড়ছে – পরক্ষণেই বেড়িয়ে এসে বলছে, টু—কি। আর কাছের সেই গাছেদের গায়ে বিস্ফোরণ হচ্ছে লাল হলুদ সবুজের।

চলতে চলতে আর দেখতে দেখতে, দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই চেরোকি গ্রামে। গ্রামের নাম ওকোনালুফটি। ছোট্ট একটা ছবি যেন। অল্প কিছু বাড়ী, একটা পেট্রোল পাম্প, একটা আটাকল যা আজও চলছে পাশে বয়ে চলা ওকোনালুফটি নদীর জলশক্তিতে, কয়েকটা স্মারকের দোকান। এমনই একটা দোকানে ঢুকি। বিক্রেতারা সবাই বয়স্কা মহিলা। পরম মমতায় একটা একটা করে স্মারকের নমুনা দেখান তাঁরা। জানতে চান আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি, কারণ তাদের কেউ কেউ কখনো ইন্ডিয়া এসেছেন। এদের একজন কাঠের তৈরি এলক-এর ছোট্ট মূর্তি খোদাই করা এক জোড়া কানের দুল তুলে আমাকে বলেন – but this must be looking awesome in your wife’s ears. প্রাইস ট্যাগটা আর দেখিনা। ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলি – Oh yes of course, please pack it. এ আমার চেরোকির স্মারক, আমার স্মোকি মাউন্টেন্সের স্মারক, স্মোকিতে পাওয়া সত্তরোর্ধ এই নিঃসঙ্গ রমণীর চোখে হঠাৎ খুশির আলোর স্মারক। কখনো যদি কোনভাবে এই মহিলার নাতি বা নাতনির সঙ্গে দেখা হয় এ দেশের কোন বিন্দুতে, তখন তাকে এই দুলদুটো দেখিয়ে বলতে পারব – Hey, you know, I had been to the Smokys sometime.

(সমাপ্ত)

সহযোগিতার হাত বাড়াতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

[পর্ব ৮]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য