কলম-বাসি কথা পর্ব ৮
আমেরিকার স্মোকি মাউন্টেন সংরক্ষিত উদ্যানে বেড়াতে এসেছি। একটু ধরতাই দিয়ে দিই, যে আগের মাসের পর্বে তার সদর দরজায় এসে পৌঁছেছিলাম। জায়গাটার নাম গ্যাটলিনবার্গ। সেখানে সুগারল্যান্ড তথ্যকেন্দ্র থেকে জোগাড় হয়েছে আগামী সফরের প্রয়োজনীয় ইনফর্মেশন।
গ্যাটলিনবার্গ থেকে ক্লিংগম্যান্স ডোম ২৪ মাইল রাস্তা। না থেমে চোখে ঠুলি বেঁধে চললে আয়নায় মুখ দেখা রাস্তা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগবে বড়জোর ৩০ মিনিট। কিন্তু রাস্তার পাশে পাশে অসংখ্য পুল আউট অর্থাৎ গাড়ি দাঁড়ানোর জায়গা। সেখানে দাঁড়ালেই কখনো পাহাড় ঝাঁপিয়ে পড়ে, কখনো ফারের বন জড়িয়ে ধরে, কখনো নদীর বুক ছুঁয়ে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া চুমো খায়। ফলে মাঝদুপুরে চলা শুরু করে পৌঁছতে পৌঁছতে দেখি সূর্য ডোবার সময় উপস্থিত। এটা সূর্যাস্তের ছবি তোলার জায়গা।
চওড়া একটা পাটাতনের ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো ট্রাইপডস্থিত ৩০ – ৪০টা ক্যামেরা। তাদের পেছনে উদ্বিগ্ন মুখ পুরুষ মহিলা ফটোগ্রাফার। সামনে যে ‘দিন ঢল যায়ে হায়’ – ঠিক ঠিক মুহূর্তকে ঠিক ঠিক এক্সপোজারে ধরা চাই। দাড়িওয়ালা আ্যমেচারকে পরামর্শ মাঝবয়সি প্রফেশনালের – হোয়াইট ব্যাল্যান্সটা ক্লাউডে রাখবেন। আর এক্সপোজারটা ওয়ান স্টপ ডাউন রেখেছেন তো? আমিও বিজ্ঞমুখে বাড়িয়ে ধরি আমার ক্যামেরা। চোখ সরু করে দেখে নিই মেঘের পেছনে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্য, ফারের বন, সার দেওয়া পাহাড়। আর কামেরায় আওয়াজ ওঠে খচ, খচ। ফলাফল যাই হোক, কেউ যেন ভেবে না বসেন আমি অ্যানসেল অ্যাডামসের থেকে খুব একটা কম কেউ। মিনিট ৪০ নানা কসরতের শেষে সূর্যাস্তকে ফ্রেমবন্দী করার যাবতীয় চেষ্টায় ইতি টানলাম। কারণ ততক্ষণে আমি দেখে ফেলেছি অলক্ষ্যে থাকা বিধাতাপুরুষের হাসি। রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে, সেই সীমান্তে বসে তিনি বলছেন আমার এই রঙকে ফ্রেমবন্দী করার ফ্রেম কোথায় রে অর্বাচীন? লেন্সের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দু চোখ ভরে দেখ শেষ সূর্যের অপরূপ রূপ। মেঘের ফাঁক দিয়ে যে আলোর রশ্মির ফলা ছুঁড়ে দিলাম পৃথিবীর দিকে, তা প্রবেশ করুক তোর চেতনার গভীরে। গভীরে যা, আরও গভীরে যা। উল্টোদিকে পশ্চিম আকাশেও গভীর নীল রং, তাতে পূর্ণচাঁদের টিপছাপ পড়েছে। হাওয়ার বেগ বাড়ছে। ৬৬৪০ ফুট উঁচু ক্লিংগম্যান্স ডোমে পাল্লা দিয়ে কমছে তাপমাত্রার পারদ। তাতে হাওয়ার কামড় বসে যাচ্ছে কোটের কলারের ফাঁক দিয়ে গলা আর বুকের চামড়ায়। আর নয় – এবার তাড়াতাড়ি পা, থুড়ি গাড়ি চালিয়ে পিজিয়ন ফোর্জে পৌঁছন চাই। ওখানকার হোটেলের পায়রার খোপ আমাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
পিজিয়ন ফোর্জ শহরতলি মূলত ক্ষণিকের অতিথির শহর, উইক এন্ডারদের শহর। তাই বাসাবাড়ীর থেকে হোটেল, মোটেল বা ফ্লোটেলের আধিক্য বেশী। আর রয়েছে শো-হাউস। নাচ,গান, সিনেমা, কমেডি শো, এ্যডভেঞ্চার রাইড – কিছুই তার পরিধির বাইরে নেই। ম্যাজিক শো চলছে ওয়ান্ডার ওয়ার্কস নামে এক শো-হাউসে। চমকের শুরু বাড়ীটার গঠন থেকেই। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সনাতন গথিক স্থাপত্যের বাড়ীটাকে উল্টো করে বসিয়ে দিন – অর্থাৎ তেকোনা ছাদ মাটিতে বসানো, সিঁড়ি আছে ওপরে আকাশের গায়ে, সেখান থেকে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ ঝুলছে ফুলের টব, সিঁড়িতে বসান আলোরা, থামগুলো কোনটা ভেঙ্গে গেছে। এমনকি WONDERWORKS এই কথাটাও লেখা আছে উল্টো করে।
এর ভেতরে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন ম্যাজিশিয়ান। সাজপোশাক, আলো আর পরিবেশনের গুণে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কমা, সেমিকোলনের মত ছোট ছোট রসিকতা আর জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন ম্যাজিশিয়ান মহাশয়। কায়দা করে নিজের প্রচারও চলছে। হঠাৎ শূন্য থেকে একটা ট্রফি এনে বসিয়ে দিলেন লাল ভেলভেটে ঢাকা টেবিলের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে ট্রফিটার নাম ‘মারলিন ট্রফি’ – ম্যাজিকের জগতে যা নাকি অস্কারের সমতুল। সুতরাং ম্যাজিকের জগতে তার কোথায় অবস্থান তার হদিশ নিশ্চয়ই দর্শকরা পেয়ে গেলেন। এর পাশাপাশি বানিজ্যেও তার ব্যুৎপত্তি প্রগাঢ়। ছোট্ট এক ছেলেকে স্টেজে তুলে শেখালেন ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক। সাথে সাথে বাতলালেন তার পিছনের কৌশল, তাকে উপহার দিলেন একটি ম্যাজিক রোপ। তারপর জনতার উদ্দেশ্যে মোক্ষম লোভনীয় অফার – ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক সহ আরও চব্বিশটি ম্যাজিকের কৌশল শিখতে চাইলে শো শেষে সিডি কিনুন বাইরের দোকান থেকে, সঙ্গে একটি রোপ ফ্রি। অবশ্যই উপরি পাওনা তাঁর দুর্লভ অটোগ্রাফ।
প্রায় ম্যাজিকের দ্রুততায় সেই হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে যার ইশারায় মজলাম তা একটা যাদুঘর। প্রেক্ষাগৃহের নীচতলায় এ যাদুঘরে শুধুই ম্যাজিকের উপকরণের আর ছবির সংগ্রহ। সেখানে ঢুকতেই দেখা পি সি সরকারের সঙ্গে। বিশাল তৈলচিত্রে তাঁর ভুবনভোলান হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেওয়াল আলো করে। নীচে ক্যাপশন – ওয়ার্ল্ড’স গ্রেটেস্ট ম্যাজিশিয়ান।
আনন্দে চোখে জল এল, গর্বে বুক ফুলে উঠলো, পাশাপাশি একটা চিনচিনে ব্যাথাও যেন টের পেলাম। পেরেছি কি আমরা আমাদের গর্বের মানুষটার নামে এমন একটা যাদুঘর তৈরি করতে? এমন কি নামটার ‘পি’ আদ্যাক্ষর পুরোটা কি জিজ্ঞেস করলে শতকরা নব্বই জন শিক্ষিত বাঙালী বলবেন পি মানে ইয়ে, ওই আর কি পেটে আসছে মুখে আসছে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ পিজিয়ন ফোর্জএর মত এক অখ্যাত শহরতলি কি সন্মানের সঙ্গে স্মরণ করছে তাঁকে। রয়েছে ম্যাজিকের আদি পিতা হ্যারি হুডিনির আসল পোশাক, তাঁর সেই বিখ্যাত বাক্স, শেকল আর তালা যার বাঁধন বার বার খুলে বেড়িয়ে এসেই তিনি হুডিনি। রবার্টসনের মূর্তির গায়ে পরানো রয়েছে তাঁর শেষ ষ্টেজ-শোর পোশাক। আর ছড়িয়ে রয়েছে জাদুর অসংখ্য সরঞ্জাম, দলিল, ছবি আর বই। বলতে হবে, এই বইয়ের সংগ্রহে রয়েছে ‘দ্য ইন্ডিয়ান ম্যাজিক আর্ট’ নামে ১৯১২ সালে প্রকাশিত একটি বই। ১৫০০০ কিমি দূরে ভারতের সঙ্গে এক ভারতীয়ের এই সাক্ষাতকার সবটাই কি গর্বের না খানিকটা লজ্জারও – কে জানে !
এই রকম শো হাউস অসংখ্য। একশ রকমের মজার জন্য রয়েছে একশ রকমের আয়োজন, যার প্রতিটা অন্তরঙ্গে আর বহিরঙ্গে অতুলনীয়। তবে জীবনের এই মজাদার ‘শেড’-এর বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে প্রকৃতির রং, রূপ, গন্ধ, স্পর্শ আর ফল কালার্স সমৃদ্ধ স্মোকি মাউন্টেন্স। কাল সকালে তার সঙ্গে আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
(ক্রমশ)
[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]