পর্ব – ৪

লাবোকের তুলোর ক্ষেত

এসেছি লাবকে। স্যারের বি এম ডাব্লিউ গাড়ি করে এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে চলেছি। এয়ারপোর্টের আশেপাশে কিছু বাড়ি ছিল, একটু পরেই সব শুনশান। বিশাল চওড়া রাস্তার দুপাশে শুধু বিস্তৃত ক্ষেত। শেষ দেখা যায় না, শুধু জল দেবার বিরাট যন্ত্র (ছবি ১) মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে।

ছবি ১ – জল সিঞ্চনের যন্ত্র

আর উঁচু উঁচু খামারবাড়ি একা একা দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ক্ষেতিবাড়ির সবটাই যন্ত্রনির্ভর। মাটি তৈরি করা, চারা রোপন করা, সারজল দেওয়া, ওষুধ ছড়ানো, ফসল কাটা, ইত্যাদি সবই করে যন্ত্র। ফলে চাষ আবাদে মানুষের ওপর নির্ভরতা খুব কম। এখানে থাকতে থাকতে পরে দেখেছিলাম, এক একজন চাষীর কয়েকশো বিঘের ক্ষেত। তাতে হাতে গোনা কয়েকটি লোক নির্দিষ্ট সময়ে বোতাম টিপে নির্দিষ্ট যন্ত্রটি চালিয়ে দিচ্ছে, আর তাতেই কাজ হয়ে যাচ্ছে। জমির মালিক ঘোড়ার পিঠে চেপে ভোরবেলা একবার ক্ষেতের চারদিক পাক দিয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের কাজটুকু সেরে নেয়। ক্ষেতের এককোণের খামারে যন্ত্রপাতি জমা করে রাখা থাকে। এরা বলে বার্ন।(ছবি ২)

ছবি ২ – খামারের বার্ণ

সেখানে উপস্থিত হাতে গোনা ক’জন মানুষকে দিনের কাজের SOP-টা ধরিয়ে দিয়ে মালিকের কাজ শেষ। জনবিরল দেশ, তাই কর্মসম্পাদনের এইটাই হয়ত সঠিক পদ্ধতি।
ঘরের কাজের ক্ষেত্রেও এইটাই ছবি। আপনা হাত জগন্নাথ। অবরে সবরে কাউকে নির্দিষ্ট কিছু কাজের জন্য ডাকা যায়। কাজ আর ঘন্টাপিছু মজুরির বয়ান লেখা চুক্তিপত্রে সই করে কাজের শেষে চেকে পেমেন্ট নিয়ে যায় তারা। মনে আছে ডা. পালের স্ত্রী আমার বউকে একদিন বলেছিলেন, “জানো সোনালী, তোমাকে আমি খুব হিংসে করি। আমাদের অনেক টাকা, বিরাট সাজানো বাড়ি। কিন্তু এটাকে সচল রাখতে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব আমাকেই করতে হয়। ঘুম থেকে উঠলে মুখের কাছে কেউ চায়ের কাপ ধরবে না, বাতের ব্যথায় হাঁটু কাবু হলে মলমটুকু এনে লাগিয়ে দেবার লোক নেই। অথচ তোমার? “
কথাটা উনি শেষ করেন নি। তাতে ওনার হতাশা আর অসহায়তাটা চাপা থাকে নি। শুনতে শুনতে নিজেদের বাড়ির কথা ভাবছিলাম। সেখানে রান্না করার দিদি আছেন ষোলো বচ্ছর ধরে। আরও দুজন আছেন বাড়ির এদিক সেদিক সামলানোর জন্য। ওদেশের তুলনায় যে টাকা নেন, তাতে ওদেশে বড়জোর দু ঘন্টার কাজ মিলবে। তাতেই হাসিমুখে সকালে এসে আমার গিন্নির চারদিকে চায়ের কাপ হাতে তাদের গোলটেবিল বসে। বর-দের মুণ্ডপাত, শাড়ির গল্প থেকে সবজির দাম, তাই থেকে দেশের অবস্থা, এই সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যখন সকাল প্রায় শেষ তখন হঠাৎ লাফিয়ে উঠে রান্নাদিদি বলেন, ও বৌদি, কি হবে গো, কত দেরী করিয়ে দিলেন। এবার কখন ভাত নামাব আর ডাল সাঁতলাব!
ডাঃ পালের আমেরিকাবাসি স্ত্রীর দৈনন্দিন যাপনে এই ট্রিভিয়ার মনিমুক্তরা নেই। অথচ আবশ্যকীয়ের বহতা নদীতে অপ্রয়োজনের ঢেউ লাগে যখন, তখনই তো সুর লাগে কথায়, জীবন বেজে ওঠে গানের মত। সেই সুর একদিন ছিল ওঁর জীবনে। মিসেস পাল বড় হয়েছিলেন এলাহাবাদের হাভেলিপ্রতিম বাড়িতে। ওকালতি ব্যবসায় চূড়ান্ত সফল বাবার একমাত্র লাডলি, এক গেলাস জল গড়িয়ে খাননি। সখিদের সঙ্গবিহীন একটা মুহূর্তও কাটান নি। আজ আমেরিকায় বসে মিডাস টাচের মালিক হয়েছেন, আর সেই ফাঁকে রসগোল্লাও হয়ে গেছে সোনার গোলা। কামড় দিয়ে স্বাদ নেবার সুযোগ নেই আর। পুরনো দিনের কথা ভেবে দুঃখ শুধু বহরে বাড়ে।

গাড়ি চলছে। রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলতে চলতে বাঁ দিক দিয়ে দ্রুতগামী গাড়িরা যখন সাঁ সাঁ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে, শরীর মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে। তাই নিয়েই পাশের তুলো ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে তুলোর গল্প মনে এল। ছোট্ট করে সেটাই বলি বরং।
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের কথা। আসলে সেটা ছিল বস্ত্রশিল্পের বিপ্লব। আর তার মূল উপাদান ছিল তুলো। অথচ তুলোর আদি ইতিহাসে ইউরোপের অস্তিত্ব নেই। আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া অস্ট্রেলিয়ায় যখন তুমুল তুলোচাষ হচ্ছে, তখন ইউরোপ আটকে আছে হেম্প আর উলে। আসলে বিষুবরেখার উত্তর দক্ষিণে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব অব্দি অঞ্চলই তুলো চাষের জন্য উপযুক্ত তার তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার কারণে। আমেরিকাতেও তুলো চাষের সোনার ক্ষেত মেক্সিকো পেরু আর উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ ভাগেই বেশি। এশিয়ার ভারতে, চিনে তুলো চাষের পরম্পরা খ্রিস্টজন্মের ৫০০০ বছর আগের তো বটেই। মজার বিষয়, সেইসব জায়গা থেকে চতুর্দশ শতকে যখন ইউরোপে তুলো আমদানি শুরু হয়েছে, ( যদিও তার ব্যবহার বস্ত্র তৈরিতে ততটা নয়) তখন ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত লেখক জন ম্যান্ডেভিল তাঁর ‘The travels of Sir John Mandeville’ বইতে ১৩৫০ সালে লিখছেন, ভারতে একধরনের গাছ আছে যার ফল হচ্ছে ছোট ছোট ভেড়া। তারা ডাল নুইয়ে মাটি থেকে ঘাস খায়। তাদের গা থেকে উল কেটে নিয়ে স্থানীয় মানুষেরা তুলো তৈরি করে। (ছবি ৩)

ছবি ৩ – টার্টারির ভেড়া গাছ

আশ্চর্য লাগে এইটা ভাবতে, ১৩৫০ সালে তুলো সম্পর্কে এই যাদের ধারণা, তারা আর ৪০০ বছর পর শিল্পবিপ্লব করছে, যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন সুতো আর বস্ত্রের বন্যায় অন্তত ৫০০০ বছরের পুরোনো ভারত তথা বাংলার বস্ত্রশিল্প সংকটে পড়ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে বাংলার গর্বের মসলিন।
তুলতুলে নরম তুলোর ইতিহাস এমনই কঠিন গদ্যে মোড়া। আমেরিকান তুলোর ইতিহাসে যেমন জড়িয়ে আছে ক্রীতদাসের কান্না।(ছবি ৪)

ছবি ৪ – তুলো ক্ষেতে অত্যাচারিত ক্রীতদাস

ইউরোপ থেকে বসতি করতে আসা সাদা চামড়ার মানুষেরা প্রথম ফ্লোরিডায় তুলোর চাষাবাদ শুরু করে। এমনিতে বুনো তুলো নানান জায়গাতেই হত। তাকে চাষবাসের শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলার কৃত্বিত্ব এই ‘সেটলার’-দের। শুরুর দিন থেকে আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে যখন তুলোর চাষ ছড়িয়ে পড়ল, তখন প্রয়োজন হল প্রচুর শ্রমিকের। তার জন্য আফ্রিকা থেকে মানুষকে ক্রীতদাস করে আনা হতে লাগল। কী অমানুষিক বর্বরতার সঙ্গে তাদের ব্যবহার করা হত তার উদাহরণ নিজের চোখে দেখেছি আফ্রিকার জঞ্জিবারে, যা নাকি ছিল দাসব্যবসার সবচেয়ে বড় খোলা বাজার।(ছবি ৫)

ছবি ৫ – শৃঙ্খলিত দাস (জাঞ্জিবার)

সেখান থেকেই শুরু হত তাদের আমেরিকা যাত্রা। গলায় লোহার বকলস, পায়ে লোহার বেড়ি পড়িয়ে রাখা হত তাদের। মাইলের পর মাইল রোদ্দুরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। তাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে দুর্বলজ্ঞানে গলাটা কেটে মুণ্ডু আলাদা করে দেওয়া হত। তিনদিন অন্ধ কুঠুরিতে নির্জলা উপবাসে বন্দী রেখে তারপর বাইরে এনে গাছের গায়ে বেঁধে চাবুক মারা হত। এই অত্যাচার সয়ে বেঁচে থাকত যারা, তারাই নির্বাচিত হত রফতানির জন্য। বাকিদের জন্যে আফ্রিকার অরণ্যের সিংহ আর সমুদ্রের দানবীয় মাছেরা তো ছিলই।

এইভাবে ১৭ শতক থেকে ১৮০৮ সালে আন্তর্জাতিক দাসব্যবসা অবলুপ্তির বিজ্ঞপ্তি জারির আগে পর্যন্ত এই ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’-এর পথ ধরে আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় চালান হয়েছিলেন সোয়া এক কোটি ক্রীতদাস। ইতিহাসে এর নাম ‘মিডল প্যাসেজ’। এতে আন্তর্জাতিক দাস ব্যবসা বন্ধ হল বটে, কিন্তু দেশের মধ্যে দাস কেনাবেচার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলনা। দক্ষিণের তুলো ক্ষেতে শ্রমিকের বিপুল চাহিদার কারণে চালু থাকল উত্তরের রাজ্য থেকে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এদের চালানের প্রক্রিয়া। সেই মা থেকে সন্তান, স্বামীর থেকে স্ত্রী – পরিবার ছিন্নভিন্ন করার প্রক্রিয়া চলেছিল ১৮৬৫ অব্দি(আমেরিকান সিভিল ওয়ারের বছর)। ১৭৮৭(আমেরিকার সংবিধান রচনার বছর) থেকে ১৮৬৫, এই পর্বে শিকড় উপড়েছিল ১০ লক্ষের বেশি মানুষের, ইতিহাস যাকে বলছে ‘Trail oF Tears’.
ইতিহাসের চাকা ঘুরেছে। তুলো চাষ পুরোমাত্রায়ই আছে। সৌভাগ্য যে এখন আর তাতে মানুষের রক্ত আর কান্না মিশে থাকে না।
তবে টেক্সাসের দুরন্ত গরমে ঘাম মিশে থাকাটা বন্ধ হয় নি, হবেও না।

[পর্ব ৩]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, আগস্ট ২৪, সূচিপত্র]