এমন বিলাসবহুল হোটেলে ওঠা তো দূরের কথা, আগে কখনও চোখেও দেখেনি অনাদি। দুধের মতো সাদা নিভাঁজ চাদরে মোড়া পালকের মতো নরম বিছনায় বসে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে সোফায় বসতে গিয়ে দেখল, সেটার গদিও এত নরম যে শরীরের অনেকটা ডুবে যাচ্ছে। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বিহ্বল চোখে ঘরের চারপাশটা দেখতে দেখতে এক সময়ে ওর সন্দেহ হল, স্বপ্ন দেখছে নাতো?
প্যারিসের চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে সে একের পর এক এমন সব অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছিল, যা কখনও সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
তবে অবাক হওয়ার ব্যাপারটা যে তার এক তরফা নয়, ওকে যিনি রিসিভ করতে এসেছিলেন, তাঁকে দেখেই টের পেয়েছিল। ইস্তিরিবিহীন অতি সাধারণ সুতীর পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা, রাঢ়বঙ্গের মাটির মতোই রুখাশুকা চেহারা, মুখময় অযত্নে বেড়ে-ওঠা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল এবং বগলের নিচে অতি অকুলীন কাঠের ক্র্যাচ দেখে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ভদ্রলোক বার তিনেক একই প্রশ্ন করেছিলেন, আর য়্যু অনাডি সরঁগি, ফ্রম ইন্ডিয়া?
অনাদির উত্তর শোনার পরেও হয়তো ভদ্রলোকের সন্দেহ দূর হয়নি। অতঃপর ফরাসি ভাষায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বার কয়েক কথা বলে এবং অবশেষে মোবাইল ফোনে পাঠানো ছবির সঙ্গে মিলিয়ে তবে ওকে গাড়িতে তুলেছিলেন।
লাগেজ বলতে একটামাত্র ঝোলা ব্যাগ, তাতে কিছু গরম জামাকাপড়। বেচারা অফিসারটি আরও বিস্মিত, জিজ্ঞেস করেছিলেন, ওনলি দিস?
অনাদি ঘাড় নাড়তে ভদ্রলোক ঈষৎ অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলেন, এক্সকিউজ মি স্যার। আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ অ্যান অর্ডিনারিলি ইনর্ডিনারি পার্সোনালিটি ইন মাই লাইফ। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, স্যার।
লাগোয়া ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে দেখল, টেলিফোনটা বাজছে। রিসিভার তুলতেই ওপারে হোটেলের রিসেপশনিস্টের সুরেলা গলা, স্যার, য়্যু হ্যাভ অ্যা ভিজিটর হিয়ার, উইল ইয়্যু মিট রাইট নাউ।
অনাদি খুব অবাক হল। সে এ’বছর ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল লিটারেসি প্রাইজের জন্যে নির্বাচিত হয়েছে বটে, কিন্তু এদেশের কাউকেই তো সে চেনে না। ভাবল, রিসেপসনিস্ট বুঝি ভুল করছে। এখানে ওকে যাঁরা নিমন্ত্রণ করে এনেছেন, তাঁদের সঙ্গে তো একটু আগেই কথা হয়েছে। তবুও জিজ্ঞেস করল, ইস হি ফ্রম দি অরগানাইজারস?
রিসেপসনিস্ট হাল্কা হেসে বললেন, নট, হি স্যার। অ্যা লেডি, শি ক্লেমস দ্যাট শি ইজ নোন টু ইয়্যু।
অনাদি আরও ঘাবড়ে গেল। বলল, রিয়ালি? ইদার শি অর য়্যু মাস্ট বি মিস্টেকেন, আই প্রিজিউম।
মেয়েটি ফের বলল, শি মাইট বি, বাট আই অ্যাম নট। প্লিজ সি হার অন দ্য স্ক্রিন।
ঘরের দেয়াল জুড়ে বিরাট টিভির পর্দায় ভেসে-ওঠা সুবেশা যুবতীর ছবি দেখে চমকে উঠল অনাদি। রিসেপশানের সোফায় গা এলিয়ে হাসি হাসি মুখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ অনাদির বুকের সমস্ত রক্ত যেন হৃৎপিণ্ড ফুড়ে মুখে এসে জমা হল।


রিসেপশনিস্ট আবার জিজ্ঞেস করল, স্যার, ডু য়্যু নো হার? শুড আই সেন্ড হার টু ইয়োর রুম?
অনাদি কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। টিভির পর্দায় চোখ থাকা সত্ত্বেও সে মনের পর্দায় ভেসে ওঠা একের পর এক ছবিতে ডুবে যেতে থাকল।
দুই
অতি কষ্টে ধীরে ধীরে চোখ খোলার পর অনাদির মনে হল, কেমন ঝাঁপসা ঝাঁপসা জলছবি যেন সব, কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। চোখের উপর জোরাল আলো এসে পড়ায় বেশ কষ্টও হচ্ছিল।
সময়টা দিন না রাত, বোঝার জন্যে ঘাড় ঘোরাবার চেষ্টা করতেই একটা তীব্র যন্ত্রণার স্রোত মেরুদণ্ড বরাবর নামতে নামতে স্থির হয়ে গেল। কোমরের নিচে কেমন একটা ঝিঁঝিঁ ধরা ভাব, পা নাড়াতে গিয়ে দেখল, কেমন এক নির্ভার অনুভূতি। নাকের উপর কী যেন একটা কামড়াচ্ছিল, বোধ হয় মশা। মারার জন্যে হাত তুলতে গিয়ে দেখল, সেটাও নড়ছে না।
সে যে এখন কোথায়, এল কীভাবে, কিছুই তা বুঝে উঠতে পারছিল না। ফিনাইলের সঙ্গে কেমন যেন ওষুধ ওষুধ গন্ধ। অনাদির ঘ্রাণশক্তি বরাবরই প্রখর। মা বলে, আগের জন্মে তুই নির্ঘাত কুকুর ছিলি!
আসলে ছোটবেলায় অনাদির সারাক্ষণ খুব খিদে পেত। মা খাবারদাবার কোথাও লুকিয়ে রাখলেও সে ঠিক গন্ধ শুঁকে বের করে ফেলত! চাকরিবাকরি পেলে মাকে একটা ফ্রিজ কিনে দেয়ার ইচ্ছে আছে অনাদির। কিন্তু সে পরের কথা, আপাতত এই ওষুধ এবং ফিনাইলের গন্ধটা ওকে ভাবিয়ে তুলল।
ওর মনে হল, কারা যেন ব্যস্ত হয়ে চলাফেরা করছে। একজন মহিলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাকে যেন শাসন করছে। শুভদ্রা কি? না! তাঁর গলাটা এমন কর্কশ না।
— জ্ঞান ফিরেছে?
একটা গমগমে গলা। কার জ্ঞান ফেরার কথা জিজ্ঞেস করছে? অনাদির হঠাৎ কেমন যেন শীত করতে লাগল। মাথার উপরে বনবন করে ফ্যান ঘুরছে, সেটা বন্ধ করতে পারলে স্বস্তি হত। ঘাড় ঘুরিয়ে সুইচটা দেখার চেষ্টা করতেই আবার সেই মারাত্মক যন্ত্রণাটা ফিরে এল। ধীরে ধীরে আবার চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হতে হতে কালো হয়ে এল। চোখের পাতা দু’টো আপনা থেকেই ভারী হয়ে উঠল। অনাদির মনে হল, সে যেন ক্রমশ নিকষ কালো এক গহ্বরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে।
–এই যে, শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন আমাদের কথা?
অনাদির মনে হল, বহুদূর থেকে কারা যেন তাকে ডাকাডাকি করছে। অতি কষ্টে পুনরায় চোখ খুলে দেখল, অস্পষ্ট ছায়া ছায়া কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ যেন ওর মুখের উপর ঝুঁকে আছে।
একজন চেঁচিয়ে বলল, ওই তো চোখ খুলেছে! জ্ঞান ফিরেছে তাহলে। এবার কাজ শুরু করা যাক।
অনাদির সবকিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কী কাজ, ওর চোখ খোলার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক, লোকগুলোই বা কারা?
এলোমেলো চিন্তাগুলো গুছিয়ে নেবার আগেই অত্যন্ত কর্কশ গলায় প্রশ্ন ধেয়ে এল, নাম কী?
প্রশ্ন তো নয়, যেন কড়া ধমক। অনাদি থতমত খেয়ে বিহ্বল চোখে লোকটার মুখের দিকে চাইল। মোটা গোঁফ, পুরু ঠোঁট, বাঁদিকে ভুরুতে একটা বড় কাটা দাগ, দাঁতে খৈনির কালচে ছোপ, মাথায় পুলিশি টুপি।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে অনাদি অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, আমার নাম?
–না, তোর বাপের নাম! ন্যাকা চৈতন!
পাশ থেকে যে রাগী গলাটা ভেসে এল, অনাদি তার মুখ দেখতে পেল না। তিনি যে-ই হন, হঠাৎ কেন এমন মারমুখী হয়ে উঠলেন, বুঝতে পারল না। সে চিরকালই শান্ত প্রকৃতির, কেউ তেড়ে এলে প্রতিরোধ দূরে থাক, বরাবর নিজের মধ্যে কুঁকড়ে যায়। সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে, একদিন দেখল, ওর সামনের বেঞ্চে বসা ছেলেটা পকেট থেকে টুকলি বের করে লিখছে। দেখেই ওর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল, কিন্তু আসল বিপত্তিটা বাঁধল ইনভিজিলেটর আসার পর। সেই ছেলেটা ততক্ষণে টুকলিটা অনাদির পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে ভালো মানুষের মতো মুখ করে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটতে শুরু করেছে। ওর পায়ের কাছে কাগজের টুকরোটা আবিষ্কার করে ইনভিজিলেটরের সে কী হম্বিতম্বি! ও যথারীতি ঘাবড়ে গিয়ে চুপ! নেহাৎ ওর খাতার সঙ্গে টুকলির লেখা না মেলায় তিনি ওকে বেনিফিট অফ ডাউট দিয়েছিলেন বলে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু এসবের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় চলে যাওয়ায় জ্যামিতির একটা জানা একস্ট্রা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। সে দুঃখ অনাদির আজও যায়নি।
–কী হল? কথা কানে যাচ্ছে না? নাম কী তোর? বাড়ি কোথায়?
‘আপনি’ নয়, ‘তুমি’ নয়, একেবারে ‘তুই! অনাদি কী যে বলবে, ভেবে পেল না। ওদের ওখানকার মাঠেঘাটে কাজ করা অশিক্ষিত সাঁওতাল-বাউরি-বাগদিরা অবশ্য সবাইকে ‘তুই’ করে বলে। তবে সেই ‘তুই’–এর মধ্যেও অদ্ভুত এক সম্ভ্রমের পেলবতা থাকে।
অনাদি শান্তস্বরে বলল, আমার নাম অনাদি। অনাদি ষড়ঙ্গি। বাড়ি কেন্দুয়া।
–কেন্দুয়া? সেটা আবার কোথায়?
–ঝাড়গ্রামের জামবনি ব্লক।
–বাহ! এক্কেবারে দুয়ে দুয়ে চার! বোমাটা কি নিজেই বানিয়েছিলি? বেশ পাকা হাত তো তোর! মিষ্টির দোকানের স্টিলের শাটারটা পর্যন্ত দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিল, দু’জন জ্বলজ্যান্ত মানুষ আকাশপানে ফুট দশেক উঠে না কি ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। কোনটা কার হাত, কার পা, আলাদা করে চেনা যায়নি।
অনাদির আবছা আবছা মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। সেদিন সকালে কিছু ডকুমেন্ট জেরক্স করাতে বেরিয়েছিল। আচমকা একটা বিকট শব্দ হল, প্রায় কান ঘেঁষে বাজ পড়ার মতো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর চোখে অন্ধকার নেমে এসেছিল।
–তা বাছাধন, সময়ের গোলমালটা হল কী করে? রিমোট টিপেই তো তোমার ধাঁ হওয়ার কথা, নিজের কেরামতি স্বচক্ষে দেখবার জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলে না কি? তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। মুফতে পুলিশের নাগরদোলায় চড়ার সুযোগ পেলে!
লোকগুলো খিক খিক করে হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণ সকলেই চুপ। হঠাৎ ওঁদের মধ্যে একজন সহানুভূতির গলায় বললেন, সেদিন অমন অবস্থায় তোকে ফেলে রেখে যারা পালিয়েছিল, তাদের ওপর তোর ঘৃণা হচ্ছে না? কিংবা রাগ! এতদিনে নিশ্চয় বেঝে গেছিস, বিপদের সময় পুলিশই আসল বন্ধু! তা বাপ, এই বন্ধুদের কাছে তোর সেদিনের সেথোদের সকলের নামধাম চটপট বলে ফেল তো!
লোকটা কি পাগল! কী সব আবোলতাবোল বকছে! প্রচন্ড বিরক্ত হল অনাদি। যে বীভৎস শব্দটা শুনে লুটিয়ে পড়েছিল সে, সেটা কি তবে বোমার শব্দ ছিল?
সে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আপনাদের কথা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বোমা, দল, এসব কী বলছেন আপনারা?
–বুঝতে পারছিস না? তবে কি আমরা মেনেন নেব যে, জঙ্গলমহল থেকে সেদিন সাতসকালে তুই নাগেরবাজারে মর্নিং ওয়াক করতে এসেছিলি, তাই তো? বেশি ভ্যানতাড়া না করে সোজাসুজি বলে ফেলো তো বাছাধন! না হলে–!
ধীরে ধীরে অনাদির সব মনে পড়ে যাচ্ছিল। সে আসলে ভিসা করাতে কলকাতায় এসেছিল। অন্যান্য বারের মতো এবারও নাগের বাজারে পিসতুতো দাদার বাসায় উঠেছিল। সেদিন সকালে কিছু কাগজপত্র জেরক্স করাবার জন্যে বেরিয়েছিল। তার পরে ওই ঘটনা।
–কিরে শুয়োরের বাচ্চা, কথা বলছিস না যে! লাল, না গেরুয়া, কার হয়ে বোমাটা রেখেছিলি? আট বছরের যে বাচ্চাটাকে সেদিন উড়িয়ে দিলি, তার কী দোষ ছিল?
অনাদির মনে হল, ও বুঝি কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ সে খুব ঘামতে শুরু করল, গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ, মনে হল, একটু জল পেলে বেশ হত। তবুও প্রাণপণ শক্তি সঞ্চয় করে বলল, দেখুন, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি একজন রিসার্চ স্কলার, সামনের মাসেই পোস্ট-ডক করার জন্যে টরেন্টো যাওয়ার কথা। সেই জন্যেই-
–ন্যাকা চৈতন! আমাদের ভোগা দেয়ার চেষ্টা কোরো না বাওয়া, তোমার মতো রিসার্চ স্কলার দেখতে দেখতে আমাদের চোখে ন্যাবা পড়ে গেছে! তা কী নিয়ে গবেষণার জন্যে তুমি স্কলারশিপ পেয়েছ? বোমা বানানোর?
চকিতে বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল অনাদির। কনকদুর্গা মন্দিরের পুরুত বংশের সন্তান সে। শুধু চিল্কিগড়ের নয়, আশপাশের এলাকার সকলেই ওদের চেনে, শ্রদ্ধা করে। তার ওপরে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র হিসেবে ওর নিজের পরিচিতিও কম না। ফলে এই অপ্রত্যাশিত হেনস্থার মুখে পড়ে সে কী যে বলবে, তা বুঝে উঠতে পারছিল না।
অনেক কষ্টে বার কয়েক ঢোক গিলে আস্তে আস্তে বলল, আপনারা এভাবে কথা বলছেন কেন? কী করেছি আমি? আপনারা দয়া করে একবার আমার গ্রামে খবর নিন। আমি দিল্লির জে এন ইউ থেকে অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে পি এইচ ডি করেছি।
–অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে পি এইচ ডি! সে তো তোমার হাতের কাজ দেখেই বুঝেছি, বাপ! জে এন ইউ, মানে কানহাইয়ার চ্যালা! কিন্তু সে কি ইদানীং গুলি-বোমার দিকে ঝুঁকেছে? কই, শুনিনি তো!
–অনেক ন্যাকড়াবাজি হয়েছে! এ শালা এমনি এমনি মুখ খুলবে না মল্লিকদা। আপনি সরুন, আমি দেখছি। এই বেজন্মার বাচ্চা, বল, তোর সঙ্গে সেদিন আর কারা ছিল! তোদের মাথা কে?
আচমকা অনাদির মুখের উপর একটা ভারী ঘুসি এসে পড়ল। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে ঠোঁট চুইয়ে একটুখানি মুখে যেতে নোনতা স্বাদ টের পেল। তবে এই অনুভূতি স্থায়ী হল না। একটু একটু করে মাথাটা যেন আবার হালকা হয়ে আসতে লাগল। তারই মধ্যে অনাদি শুনতে পেলে, কাদের মধ্যে যেন উত্তপ্ত বাদানুবাদ শুরু হয়েছে।
–এটা কী করলেন আপনি? পেশেন্টের সবে সেন্স এসেছিল, বুঝতে পারছেন না, ও কতটা ট্রমাটাইজড? এজন্যেই আপনাদের ইন্টেরোগেট করতে দিতে চাইছিলাম না।
–ছাড়ুন তো মশাই! একজন টেররিস্ট, তার আবার ট্রমা!
–আপনারা কি সিয়োর, ছেলেটা টেররিস্ট? আর যদি হয়ও, ও এখন একজন সিরিয়াসলি ইনজিয়োরড পেশেন্ট, স্টিল নট স্টেবল, মেরে ফেলবার ইচ্ছে থাকলে আপনারা এখানে আনলেন কেন?
–আপনি কি ডাক্তার, নাকি এদের সিম্পাথাইজার?
–মিস্টার পুলিশ, এটা আপনার থানা নয়, এটা হাসপাতাল এবং আমি একজন চিকিৎসক।
–আমার কাজে বাঁধা দিচ্ছেন? আপনাদের নরম মনোভাবের জন্যেই এই শখের বিপ্লবীরা আবার এ রাজ্যে ঢুকতে শুরু করেছে! এ কাদের হয়ে কাজ করছে, সেটা জানতে হবে না? আপনাদের মতো আসামী নিয়ে পুতুপুতু করলে পুলিশের চলে না মশাই! মনে রাখবেন ডাক্তার, আমারও নাম অবনী সেন। পুলিশের কাজে নাক গলাতে এলে যে কী হয়, সেটা শিগিগির টের পাবেন।
উত্তপ্ত কথাবার্তা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে সে আবার গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেল।

তিন
আজ দু’দিন হল, অনাদিকে আই সি ইউ থেকে জেনারেল বেডে ট্রান্সফার করা হয়েছে। তবে ওষুধের প্রভাবে কিনা জানে না, এই দু’দিন বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেটেছে। আজও ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল, কুমুদিনী বিদ্যামন্দিরের বাংলার দিদিমণি যেন সুর করে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শোনাচ্ছে, ‘ঘরের সামী মোর সর্ব্বাঙ্গে সুন্দর আছে সুলক্ষণ দেহা/ নান্দের ঘরের গরু রাখোআল তা সমে কি মোর নেহা’।
সুভদ্রা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও তৎকালীন সমাজ জীবনের উপর পি এইচ ডি করছে। সুযোগ পেলেই ও সুর করে বড়ু চন্ডীদাস শোনায়। আজকাল একটু ঘুমিয়ে পড়লেই শুভদ্রাকে দেখতে পায় অনাদি।
এর মধ্যে অনেকগুলি মেজর অপারেশান হয়ে গেছে। ব্ল্যাস্টের সময় নাকি কোমরের নিচ থেকে অনেকটা মাংস উড়ে গিয়েছিল, গত সপ্তাহে প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে সেটা মেরামত করা হয়েছে। আগেই ডান পা’টা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল, সে ক্ষত এখনো শুকোয়নি। মেরুদন্ডের মধ্যে নাকি এখনো একটা স্প্লিন্টার আটকে আছে। ডাক্তারবাবুরা সেটা এখনই অপারেট করার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।
হাসপাতালের গেটে দু’জন সশস্ত্র পুলিশকে সারাক্ষণ পাহারায় রাখা হয়েছে, যাতে আসামী পালিয়ে যেতে না পারে। পুলিশ দেখে অবশ্য অনাদির হাসি পায়। ওর যা অবস্থা, তাতে উঠে দাঁড়াতেই কতদিন লাগবে কে জানে! পালানো তো অনেক দূরের ব্যাপার।


বিছানার পাশে গত মাসখানেকের পেপার কাটিং। অনাদির স্কুলবেলার বন্ধু অসীমের কীর্তি। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে কীসব সাহিত্য টাহিত্য করে বেড়ায়। সঙ্গে নানারকম সমাজ সেবার বাতিক আছে ছেলেটার।
খবরের কাগজওয়লারা ফলাও করে অনাদির জীবনপঞ্জি ছেপেছে। ঘটনাটা না ঘটলে অনাদি জানতেই পারত না, এত সব মারাত্মক লোকজন এবং সংগঠনের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। রাজ্যের পুলিশ তদন্ত করে প্রতিদিন নতুন নতু্ন তথ্য আবিষ্কার করছে। কাগজের রিপোর্ট তো নয়, যেন বেশ রগরগে ক্রাইম থ্রিলার! রিপোর্টাররা যে আজকাল এত ভাল গল্প লিখতে পারে, আগে জানা ছিল না।
ইতিমধ্যেই পুলিশের বড়কর্তা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের মাস্টারমাইন্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাজ্য পুলিশের পক্ষে এ এক বিরাট সাফল্য। সে আপাতত চিকিৎসাধীন, একটু সুস্থ হলেই তাকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে পেশ করা হবে। রাজ্য পুলিশের এই সাফল্যের জন্যে কয়েকজন পুলিশকে নাকি কী সব মেডেল টেডেল দেওয়া হবে।
বাবাকে খবরটা প্রথমে পুলিশই জানিয়েছিল। পরিবারের লোকজনকে তো বটেই, অনাদির সঙ্গে যাদের সামান্যতম সংশ্রব আছে, পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের সকলকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া পর্ব এখনো অব্যাহত। জনে জনে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ কি শুভদ্রার কাছেও গিয়েছিল? অনাদি আশা করেছিল, খবর পেলে সুভদ্রা অন্তত একবার হাসপাতালে আসবে দেখা করতে। অসম্ভব মনের জোর ওর, অনাদির সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসাটা তার পক্ষে কিছু অসম্ভব নয়।
অসীম যেদিন পেপার কাটিংযের ফাইলটা দিতে এসেছিল, শুভদ্রার কথাটা জানতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল অনাদির। কিন্তু চিরকালের মুখচোরা সে, সঙ্কোচবশত কথাটা জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি।
তবে এর মধ্যেই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে ওর। আজকাল উনি নিয়ম করে সকাল-বিকেল দেখতে আসেন। অমায়িক হাসেন, শরীরের খোঁজখবর নেন। দু’একবার নিজের হাতে ড্রেসিংও করে গেছেন। কথা শুনে মনে হয়, অনাদি যে কোনও ক্রাইম করেনি, বরং ভিক্টিম, এ কথাটা পুলিশ না বুঝলেও উনি বুঝেছেন।
মূলত ডাক্তারবাবু এভাবে ওকে আগলে রাখার জন্যেই হয়তো পুলিশ এখন আর জেরার নামে অত্যাচার করতে সাহস পায় না। তবে হাসপাতালে তাদের আনাগোনার বিরাম নেই। প্রতিদিনই নতুন নতুন মুখ, সঙ্গের ফেউগুলো নতুনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, বড়, মেজ, সেজ- পুলিশে যে কত কর্তা, মনে রাখা কঠিন।
তাঁরা এসে গম্ভীরমুখে ওর সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়েন। তারপর শুরু হয় দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই প্রশ্ন, অনাদির মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে। দু’দিন তো ভিডিও ক্যামেরায় অনাদির বক্তব্য রেকর্ডও করা হল। জানে না, কোন কম্মে লাগবে ওগুলো। টিভিতে দেখাবে কি? তাহলে শুভদ্রা দেখবে, অনাদি একখানা পা খুইয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পড়া বলার মতো করে পুলিশের একঘেঁয়ে প্রশ্নের উত্তর আউড়ে যাচ্ছে!
এর মধ্যেই একদিন বিকেলের রাউন্ডে এসে ডাক্তারবাবু অনাদির হাতখানা নিজের মুঠোয় নিয়ে বললেন, তোমাকে একটা খবর দেওয়ার ছিল। আমার বদলির অর্ডার এসেছে, সোজা দার্জিলিং! হয়তো শিগগিরই চলে যেতে হবে।
তারপর ওর অসহায় চাউনি দেখে বলেছিলেন, ভেঙে পোড়ো না। তুমি তো অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছ। একখানা পা চলে যাওয়া মানে জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়। মনে রেখো, তোমাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। আরেকটা কথা, পুলিশি টানা-হ্যাঁচড়া নিয়ে বেশি ভেবো না। আমার কয়েকজন বন্ধু আছেন, যারা তোমার মতো মানুষদের আইনি সহযোগিতা দেন। তোমার কথা তাঁদের বলেছি। পুলিশ আগে তোমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিক, তারপর আমি দেখব।
ডাক্তারবাবুর সহানুভূতিতে অনাদির চোখে জল এসে গেল। সে আবেগতাড়িত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি তো আমাকে চেনেন না, তবু কী করে আপনি এত নিঃসংশয় হচ্ছেন, যে আমি প্রকৃত দোষী নই?
ডাক্তারবাবু হেসে বলেছিলেন, শুধু আমি কেন, পুলিশও জানে, তুমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিন্তু ওঁরা যে বাঘের পিঠে বসে পড়েছে। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে পি এইচ ডি, জেএনইউ, জঙ্গলমহল, সব কিছু খাপে খাপে মিলিয়ে দিয়ে মিডিয়ার তারিফ থেকে বিশেষ কৃতিত্বের মেডেল, সবই নেওয়া হয়ে গেছে। এখন কোন লজ্জায় বলবে যে তুমি অপরাধী নও! সুতরাং ইনটেরোগেশানের নাটক ওদের চালিয়ে যেতেই হবে!
অনাদি কান্নাভেজা গলায় বলল, আমার ওপর আপনার অনেক করুণা, তাই না ডাক্তারবাবু?
উনি ওর পিঠে স্নেহের হাত রেখে বললেন, কারও প্রতি করুণা করা কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করার শক্তি কোথায় আমার? আমি শুধু সত্যের পক্ষে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর উনি ফিস ফিস করে বললেন, তোমাকে আরো একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার বন্ধুদের কাছে যা খবর, পুলিশ এখনও পর্যন্ত তোমার বিরুদ্ধে এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ যোগাড় করতে পারেনি, যাতে তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
–তার পরেও ওরা কেন আমার পিছনে এমনভাবে পড়ে আছে ?
–আমি শুনেছি, তোমাদের কনকদুর্গা মন্দিরে প্রতিদিন পাঁঠা বলি হয়। যাঁরা মানত পূরণের জন্যে কাঁঠালপাতা খাওয়াতে খাওয়াতে ছাগশিশুকে যূপকাষ্ঠে পুরে দেন, তাঁরা কিএ একবারও ভাবেন, সেই নিরীহ ছাগশিশুর কী অপরাধ?
চার
‘রাধিকাধিকবিশুদ্ধমানসা কামিকৃষ্ণকরতঃ কথঞ্চ।
প্রাপ্য বুদ্ধিবিভবন্ময়া সহ ত্রাণমেণনয়নাগতা গৃহতা’।।
বড়াই আইহন জননীকে বলছে, সে কোনোক্রমে বুদ্ধি করে কৃষ্ণের হাত থেকে রাধাকে উদ্ধার করে ঘরে নিয়ে এসেছে।
বড়ু চণ্ডীদাস থেকে শ্লোকের ব্যাখ্যা করতে করতে শুভদ্রা হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। অনাদি বলল, কেন, কৃষ্ণ কি এতটাই লম্পট যে রাধাকে তার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্যে বড়াইকে এত বুদ্ধি খরচ করতে হল?
শুভদ্রা বলল, লম্পটই তো! তা না হলে সম্পর্কে গুরুস্থানীয়া কোনও বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে অমন উদ্দাম প্রেম করতে পারে? তবে একটা কথা মানতেই হবে, লম্পট হোক আর যাই হোক, কৃষ্ণের সাহসের কিন্তু তুলনা হয় না। ভেবে দেখ, তুমি এমনই মেনিমুখো, গুছিয়ে প্রেমটাও করতে পারো না।
শুভদ্রা অবজ্ঞাভরে অনাদির পিঠে যেন আলতো ধাক্কা দিল।
জেগে উঠে অনাদি দেখল, ডাক্তার গুহ গম্ভীরমুখে ওর পিঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মানে, ও এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। অনাদিকে চোখ খুলতে দেখে হাসলেন ভদ্রলোক। তারপর ওর রুগ্ন হাতখানা ধরে বললেন, আমি চললাম, ভাই।
–চললাম মানে?
–মানে আমাকে আজ রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। উইথ ডিরেকশান টু রিপোর্ট নিউ প্লেস অফ পোটিং ইমিডিয়েটলি।
–কিন্তু কেন?
— ইন দি ইন্টারেস্ট অব পাব্লিক সার্ভিস, অর্ডারে লেখা আছে।!
ভদ্রলোক হাসলেন। তারপর অনাদির হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বললেন, আরও ক’টা দিন থাকতে পারলে ভালো হত, অন্তত তোমাকে পুরোপুরি সুস্থ দেখে যেতে পারতাম। কিন্তু নতুন জায়গায় জয়েন না করলে বেতন হয়ে যাবে, অগত্যা–।
অনাদির চোখ ফেটে জল আসবার উপক্রম হল। ধরা গলায় বলল, আমার জন্যেই কি-
ভদ্রলোক ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এসব ভেবে তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমার তো বদলিরই চাকরি। সকলের চোখে গুড বয় হয়ে এক জায়গায় যে বেশিদিন থিতু হতে পারি না, সেটা আমারই ব্যর্থতা। এখানেই বরং বেশিদিন থাকা হয়ে গেল। পাক্কা চোদ্দ মাস!
চলেই যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। কী ভেবে আবার ফিরে এলেন। বললেন, তুমি যেভাবে রিকভার করছো, আমার ধারণা, দিন পনেরোর মধ্যেই হয়তো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর পুলিশ কী করবে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে এতদিনে নিশ্চয় চার্জ ম্যানুফ্যাকচার করা হয়ে গেছে। প্রথামাফিক ওরা হয়তো তোমাকে কোর্টে প্রডিউস করবে। তবে তুমি ভেবো না, আমি না থাকলেও আমার বন্ধুরা তোমাকে সাহায্য করবেন।
–চার্জ ম্যানুফ্যাককচার মানে?
— মানে পুলিশ-প্রশাসনের সাফল্য নিয়ে মিডিয়ার কাছে এতদিন যে সব ঢক্কানিনাদ হল, তার স্বপক্ষে কিছু তথ্য-প্রমাণ তো প্রাথমিকভাবে দাখিল করতে হবে! সেগুলো তৈরি করতে হবে না? তারপর কী হল, কে খবর নিতে যাচ্ছে? মিডিয়া হয়তো ছোট্ট একটা রিপোর্ট করবে, তারপর সবাই ভুলে যাবে। পাব্লিকের স্মরণশক্তি খুব দুর্বল।
অনাদির ওসব কথাবার্তা ভালো লাগছিল না। একটু আগে দেখা স্বপ্নের বিষয়টাই যেন ওর মনকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। একটু ইতস্তত করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ডাক্তারবাবু?
ভদ্রলোক ওর সঙ্কোচ দেখে হেসে উঠলেন। বললেন, স্বচ্ছন্দে।
–আচ্ছা ডাক্তারবাবু , এর মধ্যে আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল? মানে আমি তো বেশিরভাগ সময়ে ঘুমিয়ে থাকি, কে আসে, কে যায়, ডাকাডাকি না করলে টের পাই না!
–হ্যাঁ, ঝোলা-কাঁধে তোমারই বয়েসী একটা ছেলে মাঝে মাঝে আসে, তোমাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কয়েকদিন সে না ডেকে ফিরে গেছে। কী যেন নাম বলেছিল, হ্যাঁ মনে পড়েছে, অসীম বসু।
–না, আমি অসীমের কথা বলছি না, অসীম যে আসে, তা আমি জানি। কোনও মেয়ে-
ডাক্তারবাবু চোখ কুঁচকে তাকালেন। তারপর বললেন, তুমি কি শুভদ্রার কথা জিজ্ঞেস করছ?
–না, মানে, হ্যাঁ। সে কি এসেছিল?
–না, আমার ডিউটি আওয়ারে কোনও মেয়ে কোনওদিন তোমাকে দেখতে আসেনি।
-তাহলে ওই নামটা আপনি জানলেন কেমন করে?
মৃদু হাসলেন ডাক্তারবাবু। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঘুমের মধ্যে এই নামটা তুমি অনেক বারই বলেছ!
পাঁচ
প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, তারপর কিছুদিন বহরমপুর, ফের কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেল, বছর দু’য়েকের মধ্যে ভালোই ঘোরাঘুরি হল অনাদির। ওর বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থকে যেসব চার্জ গঠন করা হয়েছিল, তার কোনওটাই প্রমাণ হয়নি। কিন্তু মুখ রক্ষার জন্যে পুলিশের পক্ষ থেকে একের পর এক অ্যাডজর্নমেন্ট চাওয়া হচ্ছিল। ভাবখানা এমন, যেন আসামীর বিরুদ্ধে প্রচুর তথ্য-প্রমাণের হদিশ পাওয়া গেছে, শুধু একটু সময় পাওয়া গেলেই সেগুলো আদালতে পেশ করা হবে।


বিচার-পর্ব চলতে চলতেই বছর দু’য়েক জেল খাটা হয়ে গেল অনাদির। অসুস্থ, অশক্ত বাবা-মা মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। প্রতিবারই যাওয়ার সময় মা খুব কান্নাকাটি করে, ওর কষ্ট হয়।
সেদিন সকালে ওকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় জেলার সাহেবের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। মাঝবয়েসী ভদ্রলোক চাকরির বাইরে কিছু লেখালিখিও করেন। সেই সূত্রে বার কয়েক অনাদির সঙ্গে গল্প করে গেছেন।
একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন, আজ তো জাজমেন্ট হওয়ার কথা। আপনার জন্যে অনেক শুভেচ্ছা রইল।
আজকাল আর এসব কথার কোন মানে খুঁজে পায় না অনাদি। তবু সৌজন্যবশত একটু হাসল শুধু।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রায় দিয়ে দিলেন জজসাহেব। অনাদি ষড়ঙ্গি, পিতা ব্রজভূষণ ষড়ঙ্গি, গ্রাম কেন্দুয়া, থানা জামবনি, জিলা ঝাড়গ্রাম-এর বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা যাবতীয় অভিযোগ এবং তথ্যপ্রমাণ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, আসামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। তাই তাকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হল।
এর পরে জজসাহেব পুলিশের উদ্দেশ্যে কী কী কঠিন মন্তব্য করলেন, তা শোনার মতো মনের অবস্থা কিংবা ধৈর্য ছিল না অনাদির। আদালতের মধ্যেই বাবা এসে যখন ওকে জড়িয়ে ধরল, তখন কেঁদে ফেলল অনাদি।
গ্রামে ফেরবার পর অনাদি লক্ষ্য করল, পরিচিত লোকজনও ওর দিকে কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। অসীম ছাড়া পুরনো বন্ধুরা সকলেই দেখা হলে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে কাটল কিছুদিন। বিগত দু’ বছর যদিও শুভদ্রার সঙ্গে সে যোগাযোগরহিত, তবু একটু ক্ষীণ আশা ছিল, ও ফিরেছে জানতে পারলে সে হয়তো একবার খোঁজ নেবে।
কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মাস কেটে গেলেও শুভদ্রা এল না। হঠাৎ একদিন একটা বিদেশি পার্সেল এল অনাদির নামে। খুলে দেখল, শুভদ্রাকে লেখা কয়েকটা চিঠি এবং ওকে উপহার দেওয়া নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ বইখানি। সঙ্গে সম্বোধনহীন অতি সংক্ষিপ্ত একটা চিঠি, টাইপ করা।
‘শুনলাম, তুমি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছ। আমার পক্ষে তোমার জন্যে অপেক্ষা করা যে সম্ভব ছিল না, একথা তুমি নিশ্চয় মানবে। আমার এনআরআই স্বামীর সঙ্গে বিদেশে সুখেই আছি। তোমার অমূল্য উপহারগুলো ফেরত পাঠালাম। আমার কিশোরীবেলার ছেলেমানুষিগুলো পারলে ভুলে যেও। ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করলেই খুশি হব’।
বইটা তুলতেই কয়েকটা শুকনো বিবর্ণ গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ল। শুভদ্রাকে কবে যেন ফুলটা দিয়েছিল সে।
সেই রাত্রেই ডক্টর শুভাশিস গুহকে অনাদি মেসেজ পাঠাল, এই বাতিল জীবনটা বয়ে বেড়াবার তো আপাতত কোন মানে খুঁজে পাচ্ছি না।
মেসেজটা পেয়েই ডাক্তারবাবু ফোন করেছিলেন।
তাঁর সৌজন্যেই অমন একটা জগৎ দেখবার সুযোগ পেয়েছিল অনাদির। মানুষ তো নয়, যেন জন্তুর জীবন ওদের। দু’বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, মাথার ওপর আচ্ছাদন নেই, পরনের ত্যানাটুকুও সব সময় জোটে না, জুটলেও নিজেরাই তা বিক্রি করে নেশা করে ফেরে। অল্পদিনের মধ্যে সে ওদের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাজ শুরু করেছিল। ওদের জন্যে সরকারি সুযোগসুবিধে আদায় করার জন্যে প্রশাসনের দরজায় দরজায় তদবির করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং সর্বোপরি শিশুদের লেখাপড়া শেখানো। বছর দু’য়েক ওদের মধ্যে থাকতে থাকতে অনাদি যেন ওদেরই একজন হয়ে উঠেছিল।
কয়েক মাস আগে একজন ব্রিটিশ অ্যান্থ্রোপলজিস্ট ওখানে এসেছিলেন গবেষণার কাজে। তিনিই প্রথম ওখানকার মানুষদের জীবনচর্যার পরিবর্তন এবং তার নেপথ্যে অনাদির ভূমিকাকে জনসমক্ষে তুলে ধরেন।
-স্যার, উই বোথ আর ওয়েটিং ফর ইয়োর রেসপন্স।
রিসেপশনিস্টের সুরেলা কন্ঠের বিনীত জিজ্ঞাসায় অনাদির ধ্যানভঙ্গ হল।
ওর ভীষণ ইচ্ছে হল, শুভদ্রাকে একবার অন্তত ভিতরে আসতে বলে। কিন্তু সেই প্রবল ইচ্ছের টুঁটি টিপে ধরে অনাদি মাউথপিসটা মুখের কাছে ধরে অত্যন্ত শান্তস্বরে বলল, সরি, আই অ্যাম বিজি।

সাহায্যের হাত বাড়াতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

3.7 3 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য