বিবর্তনের ধারাপাত
পর্ব ৮
হলদিয়ার গল্প
বায়োটেকনোলজি পড়ব তথা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব তা কাউন্সেলিং হলে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিই। হলদিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি বা HIT তখন বায়োটেকনোলজিতে বেশ নামী কলেজ ছিল। প্রথম আবাসিক জীবন। আমি বাড়ি থেকে প্রথমবার হোস্টেলে যাওয়ার সময়ে একমাত্র দিদার (ঠাকুমা’র) চোখেই জল দেখেছিলাম। বাবা শুধু বলেছিল, ‘ ক্লাসে সামনের দিকে থাকার চেষ্টা করবি। তাহলে সব জায়গায় তোর অগ্রাধিকার থাকবে।’ বাবার এই “অমোঘ-বানী’ এরপর থেকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
প্রথমদিন তো খুব মনখারাপ ছিল। মা আবার তার ওপর ফেরার আগে বলেছিল, ‘অনেক পয়সা দিয়ে তোমাকে এখানে ভর্তি করা হ ল, ভালো লাগলেও তোমাকে এখানে থাকতে হবে, খারাপ লাগলেও থাকতে হবে।’ সেদিন খুব রাগ হয়েছিল, পরেরদিন আমার রুমমেট চান্দ্রেয়ী ও আমি হলদিয়া এক্সপ্রেসে বাড়ি চলে আসব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আসি নি। মা’র কথাটা মনে হয়েছিল। এবং আমরা জীবনের মহামূল্যবান চারটি বছর আবাসিক কলেজে কাটিয়েছিলাম। প্রথম বছর র্যাগিং থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের ‘স্বাতী কমপ্লেক্স’ নামক একটা জায়গায় রেখেছিল।
সব ক’টা জি প্লাস থ্রি ফ্ল্যাট। দোতলার ঘরে আমরা থাকতাম। লাগোয়া একটি বাড়িতে আমরা জানলা দিয়ে খেলা দেখতাম। ছোটবেলার সেই সবাই মিলে বসে ক্লাবঘরে খেলা দেখার মতো মজা হত। তবে হাল্কা র্যাগিং থেকে রেহাই আমরা পাই নি। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর বড়দের হোস্টেলে এলাম। সেখানেই হয়েছিল। মনে আছে আমাদের ব্যাচমেট , প্র্যাট মেমোরিয়ালে পড়া ফেমিদা হোসেনকে জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পরীক্ষার বাংলা বলতে বলেছিল। কিছু মন খারাপ বা আঘাত দেওয়া কথা ছাড়া আমাদের মেয়েদের ক্ষেত্রে অবশ্য আর কিছু হয় নি। আবাসিক কলেজের স্মৃতি অগুনতি তাই আমি এই পর্ব এবং পরের পর্বে আমার কিছু মজার স্মৃতি লিখব। দশম পর্বে আমার লেখা শেষ হবে।
কাউন্সেলিং এর সময়ে আমাদের যে প্রসপেক্টাস দেওয়া হয়েছিল, সেখানে হলদিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির পুরো একটা পাতা জুড়ে দারুণ ছবি দেওয়া ছিল। আমরা ভেবেছিলাম গিয়ে তেমনটাই দেখতে পাব। চোখে পড়ে নি নীচে একদম ছোট করে লেখা ছিল “proposed”। গিয়ে তো বিশাল ধাক্কা খেলাম। সামনে জল-কাদা, উপরে লম্বা লম্বা শিক উঠে আছে। আমার এক সহপাঠী দেবেশি তো কাদায় পা স্লিপ কেটে পড়ল। যাই হোক ক্লাস শুরু তো হল। আমার ক্ষেত্রে এই কলেজে পড়তে এসেই সিনিয়র দাদাদের মুখে প্রথম কান গরম করা সব গালাগাল শোনা। প্রথমদিন শুনে ত আমি আর চান্দ্রেয়ী মূর্চ্ছা যাই আর কি! তবে আস্তে আস্তে সব সয়ে গিয়েছিল। তবে কেন জানি না আমাদের মধ্যে অনেকেই আবাসিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েও বেশি গালাগাল শিখি নি, যা শিখেছিলাম তা কোনওদিন প্রয়োগও করতে পারিনি। এখন তো রাস্তায় বেরোলে পাড়া-গা-এর মধ্যে দিয়ে গেলেও দু-চার অক্ষর শোনা যায়, কিভাবে যে মানুষ রাস্তাঘাটে এইসব কথা উচ্চারণ করে আমার ভাবলে অবাক লাগে!
কলেজ হস্টেলে নানা মজার ঘটনার মধ্যে একটি অন্যতম হল হলদিয়া উৎসবে সোনু নিগমের লাইভ পারফরমেন্স দেখে গেট টপকে হোস্টেলে ঢোকা। ছাত্রজীবনে কলেজে ঐ একটিই দুঃসাহসিক কাজ করেছিলাম। হলদিয়া উৎসব শীতকালে হত এবং অনেক নামী গায়ক ও শিল্পীরা আসতেন। সেবার আমরা তো ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড সেমেস্টার সোনু নিগম আসবে শুনলাম। আমার তখন মারাত্মক ক্রাশ ছিল সোনু নিগমের প্রতি। ‘অব মুঝে রাত দিন’ শুনে পাগল পাগল অবস্থা। তাকে সামনে থেকে দেখতে পাব এই উত্তেজনায় আগের রাতে তো ঘুম হল না। এবার সোনু উঠলই স্টেজে রাত নটায়। সিনিয়র দিদিরা যদিও তারা অন্য হোস্টেলে থাকে জানাল যে তাঁরা পুরোটা শুনে যাবে এবং আমাদের হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। এর মধ্যে ঘটল এক কেলোর কীর্তি! ফার্স্ট ইয়ারে আমার কাছে ফোন ছিল না। মা হোস্টেলের ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। আমাদের ইন-টাইম ছিল আটটা। হোস্টেল থেকে জানানো হয় আমরা বেশির ভাগ মেয়েরা বাইরে। মা তো সেই শুনে বেশ খানিক উত্তম-মধ্যম দেয় — দায়িত্বজ্ঞানহীন ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কয়েক মিনিট পরেই আমি মেলার মাঠ থেকে মা’কে কল করি এবং জানতে পারি এই ঘটনা। সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা কমিউনিকেশান গ্যাপ জীবনে কি জটিলতা আনতে পারে। যাই হোক সেদিন সোনুর উত্তেজনায় এই ঘটনা মস্তিষ্কে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। আমরা হোস্টেলে ফিরেছিলাম রাত দুটোয়। আমাদের যাথারীতি ঢুকতে দেওয়া হয় নি, আমাদেরই এক বেশ ডানপিটে বন্ধু গেট টপকে ভিতরে গিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে ওয়ার্ডেনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে গেট খুলে দিয়েছিল। সকলের নাম কলেজে যাবে বলে ওয়ার্ডেন ভয় দেখালেও পরে আর তা করেন নি। আমার জীবনের প্রথম নিয়ম ভাঙার স্বাদ, সোনুর জন্য।
সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমার আর চান্দ্রেয়ীর খুব বন্ধু ছিল অরিজিৎ ও প্রদীপ্ত। অরিজিতের বাড়িতে আমার এবং প্রদীপ্তর বাড়িতে চান্দ্রেয়ীর ফোন নম্বর দেওয়া থাকত। একবার ওরা কোন এক স্যারের বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে সেখান থেকে অন্য কোথায় একটা চলে গেছে। দুজনের ফোনেই রেস্পেকটিভ কাকুদের ফোন এসেছিল। আমরা অবলীলায় বলে দিয়েছিলাম সব ঠিক আছে। আমরা সঙ্গেই আছি।
তবে একবার বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে অ্যামোনিয়ার বোতল বার্স্ট করে আমার নীচের ঠোঁটটা পুড়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে ছিলাম এক রাত। কাতারে কাতারে ছেলেরা আমাদের দেখতে এসেছিল। যদিও পরে শুনেছিলাম আমাদের ড্রেসের বোতাম ঠিক কতটা খোলা সেটা দেখতে এসেছিল সবাই। যাই হোক আমরা এসবে কিছু মনে করি নি। তখন বয়সটাই এমন ছিল।
একটা ঘটনায় বেশ চাপ হয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ারেই আমার থাই-এর ভিতর দিকে একটা ফোঁড়া হয়েছিল। মারাত্মক যন্ত্রণা হত। কলেজে টেরিলিনের ফুল প্যান্ট পরতে হত, তাই জায়গাটা খোলা রাখার কোনও উপায় ছিল না। আস্তে আস্তে নিজের থেকেই ফেটে গিয়ে সেরে গিয়েছিল। দীর্ঘকাল আমি পা-দুটো ফাঁক করে হাঁটতাম। কিম্ভূত লাগত দেখতে। ফার্স্ট ইয়ারে তো বেশি ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতাম না। পরে শুনেছিলাম ছেলেরা ভাবত আমার অনন্তকাল পিরিয়ড চলছে। বেশ মজা লেগেছিল।
ফার্স্ট ইয়ারে আর একটা ভয়ংকর সাবজেক্ট ছিল মেকানিক্স। আমি আর চান্দ্রেয়ী কোনও মতে দুটো সেমেস্টারেই ডি গ্রেড পেয়ে পাশ করেছিলাম। যেনতেন প্রকারে তখন সেকেন্ড ইয়ারে ওঠাতাই ছিল আমাদের মেইন ফোকাস। তাহলেই জৈবপ্রযুক্তির নানান বিষয়ে ডুব দেওয়া যাবে।
সেকেন্ড ইয়ার থেকেই শুরু হয়েছিল ঘটনাবহুল জীবন। কলেজের বাকি মজার ও দুঃখের কথা পরের নবম পর্বে।
Khub bhalo laagche porte..porer episoder opekhhai thaklam
দারুণ লাগছে ।