বিবর্তনের ধারাপাত (পর্ব ১০)
হলদিয়ার কলেজ থেকে কর্মজীবনে উত্তরণ
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে থার্ড ইয়ার থেকেই চাকরির ক্যাম্পাসিং হতে শুরু করে। অন্য সব ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের ক্যাম্পাসিং হলেও বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়েরা ব্রাত্যই ছিল কারণ কোনও Core কোম্পানি ক্যাম্পাসিং এ আসত না। আমাদের সময় প্রথমবার Wipro আমাদের বায়োটেকনোলজির ছেলেমেয়েদের ক্যাম্পাসিং allow করেছিল। কিন্তু বলেছিল যে প্রথম দশের মধ্যে যারা আছে ওই ক্যাম্পাসিং এ বসতে পারবে। আমার কোনদিনই আইটি কোম্পানিতে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। আমার সিটটি তাই আমি আমাদের ক্লাসের সন্দীপ ভদ্র কে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এবং পরে খুব গর্ব হয়েছিল যে সন্দীপ ওই ইন্টারভিউতে ক্র্যাক করেছিল এবং প্রথম কর্মজীবনে ও Wiproতেই জয়েন করেছিল। এখন অন্য একটি কোম্পানিতে কাজের সূত্রে সে আমেরিকায় বসবাসরত। বব্রু থার্ড ইয়ারে আমাদের মধ্যে প্রথম একজন ছিল যে GATE পরীক্ষায় ক্রাক করেছিল। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর আমাদের জীবনের দুটি মূল প্রাপ্তি ছিল বয়েজ হোস্টেলের কাছে গাংচিলে আমরা যেতে পেরেছিলাম এবং ক্যাম্পাসের বাইরে নূর’দার দোকানে খেতে যাওয়ার জন্য eligible হয়েছিলাম। কিন্তু তার সঙ্গে একটা খারাপ লাগা কেমন যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসতো। সবাই আস্তে আস্তে এই কলেজ থেকে নিজেদের কর্মজীবনের সূত্রে হয়তো আলাদা হয়ে যাব, আর হয়ত দেখাই হবে না সেইভাবে। ফাইনাল ইয়ারের একদম শেষে ক্রোমাস বায়োটেক নামে একটি কোম্পানী ক্যাম্পাসিং-এ এসেছিল এবং সেখানে আমি আর চান্দ্রেয়ী দুজনেই সিলেক্টেড হয়েছিলাম। আমি জয়েন করেছিলাম কিন্তু চান্দ্রেয়ী শারীরিক কারণে কলকাতা ছেড়ে যাবে না বলে কেমবায়োটেক জয়েন করে। ও পরে হায়ার স্টাডি persue করে কিন্তু আমি ক্রোমাসেই রয়ে যাই। প্রথম দিন কলেজে গিয়ে নির্মীয়মান অবস্থা দেখে যে পরিমাণ আশাহত হয়েছিলাম, যেদিন কলেজ ছাড়লাম একই দুঃখ নিয়ে বেরিয়েছিলাম কিন্তু দুই দিনের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। এখন অনেক কলেজেই দেখি বেরোবার আগে বড় বড় হোটেলে নিজেরাই সবাই বিলাসবহুল ফেয়ারওয়েল পার্টি করে। আমাদের সেই সামর্থ্য বা রীতি কোনওটাই ছিল না। আমরা হোস্টেল থেকে দল বেঁধে কাছাকাছি একটি হোটেলে খেতে গিয়েছিলাম এবং খুব আনন্দ করেছিলাম। অনিন্দিতা ওর কথামতো চাকরি পাওয়ার পরআমাদের দুজনকে প্রথমবার মদ্যপান করিয়েছিল। কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে শঙ্খচিলে বসে আমার আর চান্দ্রেয়ীর প্রদীপ্তদের কাছ থেকে প্রথমবার সিগারেট টেস্ট করা…. এইসব স্মৃতি সারা জীবন অমলিন রয়ে যাবে। চান্দ্রেয়ী আমার বিশেষ বন্ধুর জায়গায় এখনও আছে। রোজ না হলেও নিয়মিতই কথা হয় অনিন্দিতাও দেশে এলে দেখা-সাক্ষাৎ হয় মাঝে মাঝে। এছাড়াও অনন্যা, দেবস্মিতা,প্রদীপ্ত,অরিজিৎ,সন্দীপ,শঙ্খর সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রয়ে গেছে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কর্মজীবনের সুপ্রতিষ্ঠিত। তাও কথা হলেই কলেজের দিনগুলো আমরা বারবার রোমন্থন করি। যে নন্দন স্যার আমাদের পুজোয় আগে বাড়ি যাওয়ার জন্য বকেঝকে কলেজে ফিরিয়ে এনেছিলেন, তিনিই আবার আমরা চলে যাওয়ার সময় চোখের জল ফেলেছিলেন। ক্রোমাস কয়েক মাস থাকার পর আমি কলকাতায় টিসিজি লাইফ সাইন্সেসে জয়েন করি। কিছু বছর পরে পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ থেকে স্যারের বেশ কিছু স্টুডেন্টকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিটে পাঠিয়েছিলেন। কথা হয়েছিল। স্যারের সঙ্গে দেখাও করতে গেছিলাম পাঁশকুড়াতে। উনি এখন ওই কলেজের প্রিন্সিপাল। যেদিন পাঁশকুড়া গিয়েছিলাম একটা লেকচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঘুরিয়ে দেখালেন। আদর আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি করেননি। বারবার হলদিয়ার দিনগুলোর কথা সেদিন মনে পড়ে যাচ্ছিল। কলেজ জীবনের পরে হলদিয়াতে বেশ কয়েকবার গিয়েছি বিভিন্ন বিষয়ে লেকচার দিতে। অন্যরকম অনুভূতি হত। কলেজ জীবনে আরও একজন শিক্ষিকা আমাদের খুব পছন্দ করতেন। বিশেষত আমাকে আর চান্দ্রেয়ীকে। সুরভী ম্যাডাম। উনি পরে দুর্গাপুর এনআইটি-তে ফ্যাকাল্টি জয়েন করেন এবং এখনও ওখানেই আছেন খুব সিনিয়র পোস্টে। একবার দুর্গাপুর এনআইটিতে গিয়ে লেকচার দিয়েছিলাম ওঁরই আমন্ত্রণে। শিক্ষকদের প্রিয় হওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বক্তৃতা দেওয়ার ডাক পেয়েছি,দূরদর্শনেও যেতে পেরেছিলাম আমার কলেজেরই এক অনুজপ্রতিম অনিন্দ্যর ডাকে। কলেজের দিনগুলো সত্যি এখন কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগে। দৈনন্দিন জীবনের মধ্যেও মাঝে মাঝে এই দিনগুলো পপ আপের মত উঠে আসে এখন দেখি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে খুব ছোট বিষয়ে কথা কাটাকাটি প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। আমাদের সময়ে এটা হতো না। আমাদের এত ডাইভারশনও ছিল না। আমরা ঝগড়া হলেও পরে আবার তা কথাবার্তা বলেই মিটিয়ে নিতাম।যুগের সঙ্গে ঝগড়ার ধর্মও বদলে গেছে। এখন কলেজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমন কি সহকর্মীদের মধ্যেও দেখি অন্যকে দোষ দিয়ে বা হেয় করে নিজের ওপরে ওঠার এক অদম্য ইচ্ছা। কতটা পারদর্শিতা আছে সেটা নয়, অন্যকে ছোট করে কতটা উপরে ওঠা যায় সেই বিষয়েই মনোনিবেশ করে অথচ ভালো কাজের দিকে অথবা লোকের ভালো করার দিকে যদি একটু মনোযোগ দেওয়া যেত তাহলে হয়ত সদিচ্ছা প্রকাশ পেত।
দশম বর্ষীয় ছেলেকে বড় করতে গিয়ে প্রতি পদে বুঝতে পারি আমরা যেভাবে স্কুল এবং কলেজ জীবন কাটিয়েছি এদের জীবনটা সত্যিই বেশ কঠিন। প্রথমত শৈশব বলে কিছু নেই, পুজোতে একমাস ছুটি নেই। পরীক্ষার চাপে জর্জরিত প্রাণ। বাহ্যিক চাপে প্রকৃতি আর পরিজনকে অনুভব করাটা ও তাদের হয়ে উঠছে না। অনেকেই হিংসার বশবর্তী হয়ে অন্যের ক্ষতি করতে উদ্যত হচ্ছে। বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। আমরা অভিভাবকরা চেষ্টা করে যাচ্ছি নিরন্তর। কিন্তু ফলাফল সবসময়ে ইতিবাচক হচ্ছে না। বিবর্তিত হতে হতে আজ প্রাকৃতিক সম্পদ খুইয়ে, মেরুদেশের বরফ গলিয়ে, পশু-পাখির বাসস্থান ছিনিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অমোঘ পরিণতির সামনে৷ চরম আত্মশুদ্ধি ছাড়া এই সভ্যতার ধ্বংস রোধ প্রায় অসম্ভব।
( শেষ)
লেখিকার শেষ কয়েক লাইনের অমোঘ সত্য কথা ভাবলে ভয় লাগে! অথচ পরিত্রাণের উপায় কি?
পুরো লেখা পড়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি। ধন্যবাদ জানাই।
Shesh o hoye galo ? Jah, mon bhorlo na kintu. Future e aro likhbi, opekhhai roilam. Enjoyed a lot. All the best.