বিবর্তনের ধারাপাত
পর্ব ৪ – বয়ঃসন্ধির আগমনবার্তা
‘বয়ঃসন্ধি’ আসলে ঠিক কী? মা-বাবা কখনওই এই বিষয়ে কোনও আলোচনা বাড়িতে আমার সঙ্গে করে নি। তখন ঠিক প্রয়োজনও মনে হয়নি হয়তো। তবে মনে ও শরীরে ধারাবাহিকভাবে কিছু কিছু পরিবর্তন তো আসতে শুরু করেছিল; আমার ক্ষেত্রে তার শুরু ক্লাস এইট থেকে অর্থাৎ একদম টিনএজের শুরু; তেরো বছরে। কিন্তু কিছু বন্ধুদের দেখেছিলাম ক্লাস ফাইভেই সূত্রপাত হয় অর্থাৎ দশ বছরে। আমাদের লাল স্কার্ট ও সাদা জামা ছিল। লাল স্কার্ট হওয়ায় এই সময়ে বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছিলাম আমরা। সেই সুবিধা অবশ্য ক্লাস এইটের বেশি স্থায়ী হয় নি, কারণ ক্লাস নাইন এবং টেন আমাদের সাদা সালোয়ার-কামিজ ও লাল ওড়না ছিল। তাই বেশ সাবধানী থাকতে হত।
ক্লাস ফাইভ পার হওয়ার পরেই বেশ কিছু মেয়ে চেষ্টা করত হাঁটুর ওপরে স্কার্টের ঝুল ওঠাবার। কারণটা আমার মতো ‘টিউবলাইট’ মেয়েরা বুঝতে পারতাম না প্রথম প্রথম। তারপর তাদেরই এক দু’জনকে ক্লাস এইটের কাছাকাছি ছুটির পর আমাদের স্কুলের অনতিদূরে ২১৯ বাস-স্ট্যান্ডের কাছে ইতি-উতি ‘একই টিউশনিতে পড়া বন্ধু’ বা ‘পাড়ার দাদা’ গোছের কারও সঙ্গে দেখা যেত৷
কিন্তু স্কার্টের ঝুলের ব্যাপারে আমাদের সময়ে দিদি’রা খুব কড়া পদক্ষেপ নিতেন… কিছুদিনের মধ্যেই ঝুল আবার ঠিক হয়ে যেত৷।
আমাদের স্কুলে ‘বয়ঃসন্ধি’ আগমনের একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ছোট ক্লাসের মেয়েরা বড় দিদিদের এক এক জনের ‘admirer’ বা ‘ফ্যান’ হয়ে পড়ত। তাদের সঙ্গে টিফিন টাইমে গল্প করা, ফোনে বাড়ি থেকে কথা বলা এইসব চলত। ঠিক কি কারণে বড় দিদিদের ‘পাখা’ হতাম তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। এমনিই তাদের ভালো লাগত। স্বভাব,চুলের কাট। কিন্তু এই সম্পর্কের মধ্যে শরীর বা সমকামী-যৌনগন্ধী কোনও ব্যাপার থাকত না। এমনকি সেইসব দিনগুলির প্রথম দিনটি অযাচিতভাবে অর্থাৎ preparation ছাড়া এলে স্কুলের দিদিরা তো বটেই এমনকি পুরুষ কর্মীরা বা স্কুলবাসের ড্রাইভার বা কন্ডাক্টর কাকুরা কোনও রকম ভাবে খারাপ লাগার মতো ব্যবহার করতেন না, বরং অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা সামলাতেন, এখন ‘ট্রোলিং’ এবং ‘বডি শেমিং’ এর যুগে যা বিরল।
আমাদের স্কুলের দিনগুলোয় সাদা-কালো টিভির যুগে বয়ঃসন্ধির আগমনবার্তা আরও একভাবে বোঝা যেত। বাবা-মা উচ্চস্বরে ঘোষণা করে দিতেন ডিডি২ দেখা বন্ধ। ঐ চ্যানেলে অল্প জামাকাপড় পরে নায়িকাদের বিভিন্ন গান-নাচ দেখাত…অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘সুপারহিট মুকাবলা’। ওটি অনেক বড় বয়স অবধি নিষিদ্ধ ছিল। আর সিনেমার মধ্যে দেওয়ালের ছায়ায় বা নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠ কোনও দৃশ্য আসতে চলেছে মনে হলেই অঘোষিতভাবেই উঠে আসতাম টিভির সামনে থেকে। কোনওদিন কেউ বলেছে বলে মনে পড়ে না! তবে ব্যতিক্রমী ছিল ‘টাইটানিক’ সিনেমা দেখার দিনটি। এসপ্ল্যানেডের গ্লোব সিনেমা হলে দেখা। ক্লাস এইটে পড়ি তখন। স্কুলে তুমুল আলোচনা — আচ্ছা জ্যাক আর রোজ গাড়ির মধ্যে অত হাঁফাচ্ছিল কেন? বন্ধুরাই কথা বলেছিলাম। বাড়িতে জিজ্ঞাসা করার সাহস ছিল না।
এখন অবশ্য নেট-বিপ্লবে যুগ বদলেছে। সব কিছুই খোলা-পাতা। আগের রাখ-ঢাক ঠিক ছিল নাকি এখনকার খোলামেলা ঠিক সেই বিতর্কে যাচ্ছি না– কারণ দুইয়েরই কিছু না কিছু ভালো-মন্দ আছে। তবে না- বয়সোচিত বা তথাকথিত ‘নিষিদ্ধ’ কোনও বিষয়ই এখন আর মা-বাবা’র অনুমতি সাপেক্ষে হয় না; নিজের খেয়ালেই হয়, এবং বেশ আগেই হয়। বাবা-মা হিসেবে আমরা নজর রাখতে পারি, সাবধান করতে পারি-এটুকুই। এরপরও পরের প্রজন্ম আগুনে হাত দিয়ে হাত পোড়াবে কিনা এটা একান্তভাবেই তাদের চয়েসই বটে।
একটা ছোট ঘটনা বলে এই পর্বে ইতি টানব। বয়ঃসন্ধি ঘটিত আরও কিছু ঘটনা পরের পর্বে থাকবে। একদিন অটোতে করে acropolis থেকে গড়িয়াহাট যাচ্ছি। একটি ক্লাস ফোরের বাচ্চা (কথোপকথনেই জানতে পারলাম) তার মা’এর সঙ্গে অনেক বিষয়েই কথা বলছিল। শুনতে মন্দ লাগছিল না। শেষে প্রায় নামার সময় এসেছে তখন বাচ্চাটি মা’কে বলল, ‘জানো তো মা আজ না ক্লাসে একজন ‘F-ck’ শব্দটি ব্যবহার করে ডানহাতের মাঝের আঙুলটা দেখাল। এটার মানে কি গো?’ আমি অটোতে বসেই ভাড়া বের করে রাখি। তাই প্রশ্নের উত্তর শোনার আগেই আমি হাঁটতে শুরু করেছিলাম, উত্তরটা কানে আসে নি। কিন্তু আমার পুত্র আমাকে যদি এই প্রশ্ন কোনওদিন করে কী বলব ঠিক করে উঠতে পারিনি এখনও। ভেবে দেখলাম আমার বয়ঃসন্ধি তো ক্লাস ফোরে আসে নি। এই প্রশ্নেরও অবকাশ হয় নি।
কি জানি, আমি হয়ত বড়ই সেকেলে। তাই যুগের সঙ্গে চলতে পারি না। সিনেমা হলে অন্তর্বাসের আর টিভিতে ‘manforce’ এর বিজ্ঞাপন এলেই অস্বস্তি বোধ হয়, হাত চলে যায় চ্যানেল বদল করার দিকে। বাস্তব অবশ্যম্ভাবী জেনেও যেন পালানোর চেষ্টা করতে থাকি; যতদিন না বলে থাকা যায়৷ মা বর্ষাকালে সাঁতারে যাওয়ার আগে পায়ের তলায় সর্ষের তেল লাগিয়ে দিত, কাশ্মীরে গিয়ে ওয়াটারপ্রুফ উলের মোজার মধ্যে পা থাকবে জেনেও টিনটিনের পায়ের তলায় সর্ষের তেল লাগিয়ে দিতাম আমি। সৌমিত্র তারস্বরে সাবধান করত, ‘কতদিন এসব করবি! বরং নিজেকে বাঁচিয়ে চলাটা শেখা’। চকিতে মনে পড়ে যায় নির্ভয়ার ক্ষেত্রে যে ছেলেটি সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজটি করেছিল তার বয়স ঐ তেরো-চোদ্দ’র আশেপাশে…জুভেনাইল হওয়ায় তার তেমন শাস্তি হয় নি… তার মা’ও তো চেয়েছিলেন ছেলে ‘মানুষ’ হোক, যত্ন করতেন নিশ্চয়ই..চুল আঁচড়ে দেওয়া, তেল মাখিয়ে দেওয়া…তাও ‘মানুষ’ তো সে হল না।
তাও চেষ্টা তো জারি রাখতেই হয়, তা সে বয়:সন্ধি আগে আসুক বা পরে,আধুনিক মা হই বা না হই…লড়াই জারি থাকেই।
[পরের পর্বে ‘বয়ঃসন্ধির আরও কিছু ঘটনা ও স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন’ এর গল্প]
Khub valo laglo. Porer porber opekkhay roilam
Khub bhalo hoyeche lekhata….
Khub sundor likhechish past and present comparison ta. Outlook er onek change hoye jai to. Onek kotha bolte ichha kore regarding this topic.kokhono sujog Pele bolbo. Chesta to chaliye jetei hobe. Opekhha roilo porer episoder. All the best.