পর্ব ২ – শহরতলির স্কুল

আমাদের স্কুলকে আদতে শহরতলির স্কুল বলা যায় কিনা সেই নিয়ে দ্বিমত আছে। শহরের অনেক নামী স্কুলের থেকে অনেক বিষয়ে এগিয়ে ছিল আমাদের স্কুল। ঐ স্কুলে ইন্টারভিউ-এর দিনটা আমার ঠিক মনে নেই৷ এখনকার মতো তখন ইস্কুলে ভর্তির দিনটা ঠিক ‘অবিস্মরণীয়’ ছিল না, মা-বাবা’দের গ্রুমিং সেশানও হত না। দিব্যি গিয়ে দমদমের বিরাট ক্যাম্পাসের ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে এসেছিলাম। বড়দির ঘরে। লেখা পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ হয়েছিল, তাও মারমার কাটকাট কিছু নয়। দুটি বিরাট খেলার মাঠ, দারুণ সাজানো বাগান যা কলকাতার নামী ইংরাজি স্কুলগুলিকে বলে বলে ছক্কা মারবে। বাংলা মিডিয়াম হলেও আমাদের স্কুলে ইনফ্যান্ট থেকেই ইংরেজি পড়ানো হত। ফার্স্ট ল্যাংগোয়েজ, সেকেন্ড ল্যাংগোয়েজ, থার্ড ল্যাঙ্গোয়েজ এর বিভাগ তখন ছিল না। বাংলা আর ইংরেজি দুটি ভাষাই পড়তাম। ক্লাস সেভেন ও এইটে সংস্কৃত। আমি বিদেশি ভাষা শিখিনি কিছু। এখন কান পাতলেই অবশ্য শোনা যায়, “আমার ছেলে জানো তো ফ্রেঞ্চ ও জার্মান দুটোই জানে।” এখন ভাষা জানার থেকেও আত্মপ্রচারটা মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে আত্মপ্রচার কতটা করব তা নিজের হাতে। তাই বিদেশী একটি ভাষা শেখা থাকলে সুবিধা হয় তো বটেই। সুতরাং এখনকার সবই যে খারাপ বলছি তা কিন্তু কেউ বলতে পারবেন না।
যাই হোক, ইনফ্যান্ট থেকেই ক্লাস টীচারদের সঙ্গে আমাদের সখ্যতা ছিল। আমরা তাদের ‘দিদি’ বলে ডাকতাম। এই ব্যাপারটি আমার পুত্রের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম হওয়া সত্ত্বেও একই আছে। এই সম্বোধনে বেশ একটা আন্তরিকতা আছে। আমাদের যেমন দুটো খেলার মাঠ ছিল তেমন দুটো টিফিন ছিল। পোষাকি ভাষায় ‘টিফিন’ ও ‘লাঞ্চ ব্রেক’, আমরা বলতাম ‘ছোট টিফিন’ ও ‘বড় টিফিন’। অধিকাংশ দিনই আমরা ছোট টিফিনেই সব টা খেয়ে নিয়ে অল্প রাখতাম বড়র জন্য, বাকিটা খেলতাম। বাঙুর থেকে নাগের বাজার পার হয়ে স্কুলে একাধিক দিন পৌঁছাতাম প্রায় ছোট টিফিনের সময়ে। স্কুল বাসে অফুরন্ত মজা হত। আমাদের বাসটি কস্মিনকালে একবার লাল রং করা ছিল বলে তার স্থায়ী নাম হয়েছিল ‘লাল বাস’। আমার বাসে চড়লে গা গুলতো বলে মা তা থেকে রেহাই দেন নি, বরং অভ্যাস করানোর জন্য স্কুল বাসেই যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে জানলার ধারে বসে গান করতাম। বমি হত না।

এই গান করার বিষয়টি খুব উপভোগ করত আমাদের বাসের কন্ডাকটর কাম হেল্পার সুশেন কাকু। এই সুশেনকাকুর এক কার্যকলাপ নকল করতে গিয়ে একবার কি বিপদেই না পড়েছিলাম! রোজ দেখতাম সুশেনকাকু ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ হাতের তালু কিছুক্ষণ ঘষে, তারপর হাত থেকে কি একটা নিয়ে নীচের ঠোঁটের ভিতর দেয়। বেশ কয়েকদিন এই জিনিস লক্ষ্য করার পর একদিন বাড়িতে আমিও একই জিনিস করতে গিয়ে দেখি ঐভাবে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে তো হাতের ময়লা উঠছে কালো কালো। কি কাণ্ড সুশেনকাকু হাতের ময়লা খায়! মা’কে যেই বলেছি মা তো হেসে কুটিপাটি! জানা গেল ওটাকে বলে খৈনী। একধরণের নেশা করার জিনিস। এই কথা জানার পর থেকে আর নকল করিনি। আমাদের বাসের হেল্পার সুশেনকাকু আর ড্রাইভার রাজেনকাকু আমাদের খুব যত্ন নিত। গল্প করত। দু’একবার তো মনে আছে সুশেনকাকু বাস দাঁড় করিয়ে রেখে রাস্তা পারও করে দিত। হাসিমুখে। এখন এই দৃশ্য….জানিনা দেখা যায় কিনা! আমার চোখে তো পড়ে নি।
ছুটির পর স্কুল বাস সেকেন্ড ট্রীপে আমাদের নিত। তাই আরও এক ঘন্টা বাড়তি আমরা খেলতাম। আলাদা আলাদা খেলার কোচিং তেমন ছিল না তখন, ক্রিকেট আর ফুটবলটাই বেশি শোনা যেত। আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল বলে আমাকে মা ছোটবেলায় নাচ,যোগব্যায়াম,সাঁতার সব শিখিয়েছিল। আমার পুত্র আবার জিনসূত্রে শ্বাসকষ্টের ব্যাপারটি লাভ করেছে। আমাদের হাতে এখন অনেক অপশান। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবল টেনিস, স্কেটিং, রোয়িং— গুনে শেষ করা যাবে না। তাই আগের বছর প্রায় পুরো গরমের ছুটি আমাদের ভাবতেই চলে গেল কিসে দেব….শেষ পর্যন্ত সাঁতারেই দিলাম….কিন্তু অনেক অপশান থাকার কারণে সময়টা নষ্ট হল খানিক। সহজলব্ধতার বিড়ম্বনা বটে!

আমাদের স্কুলে সরস্বতী পুজো হত না, তবে বড়দিনের ছুটি পড়ার আগে একটা বড় অনুষ্ঠান হত। আর হত আনন্দমেলা বছরে একবার। আনন্দমেলাতে সারাদিন নানা গেমস, খাওয়া – দাওয়া এবং কেনাকাটার ব্যবস্থা থাকত৷ আমাদের স্কুলে সেলাই বা ওয়ার্ক এডুকেশান একটা সাবজেক্ট ছিল। আমি আবার সেলাই করতে খুব ভালোবাসতাম। আনন্দমেলায় আমাদের হাতে করা সব জিনিসই বিক্রি করা হত। আমার মা অন্য অনেক মা’এর মতোই তার মেয়ের হাতে করা জিনিসটা আগে গিয়ে কিনে নিত, ঘরের জিনিস যাতে ঘরে আসে। আমার বিয়ের সময়ে আমার সমস্ত হাতে করা জিনিস মা আর দিদা একটা ট্রে-তে সাজিয়ে দিয়েছিল।

আমি ঠিক জানি না এখনও কোনও স্কুলে সেলাই বা উলবোনা শেখানো হয় কিনা। প্রোজেক্ট আর ক্রাফটের ভিড়ে তারা হয়ত ব্রাত্য। তবে আমি দেখেছি সেলাই জানাটা পরবর্তী জীবনে খুব কাজে দেয়৷ টিনটিনকেও ভেবেছি বোতাম সেলাই করাটা অন্তত শিখিয়ে রাখব।

স্কুলের কথা এক পর্বে শেষ হওয়ার নয়। তাই পরের পর্বে আসবে ‘স্কুলের মিস থুড়ি দিদি’দের কথা’।

[পর্ব ১ – শহরতলির প্রিস্কুল]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]

5 1 ভোট
Article Rating
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Mala Bagchi
Mala Bagchi
7 months ago

Khub uopobhog korchi tor lekha. Aro porar opekhha te thaklam.

Payel Bhattacharjee
7 months ago

Darun laglo…porer porber opekkhay roilam

Simontini Mukherjee
Simontini Mukherjee
7 months ago

Khub bhalo laglo re lekhata porey..

Soumitra
Soumitra
7 months ago

Valo hocche.