বিবর্তনের ধারাপাত
পর্ব ৫ – বয়:সন্ধির আরও কিছু ঘটনা ও স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশন
আমার স্কুলে পড়ার সময়ে মা-বাবা এই ‘বয়:সন্ধি’ বা ‘ঋতুস্রাব’ বা ‘টিন-এজ কালীন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন’ নিয়ে অতটা চিন্তিত থাকতেন না। সময়ের হাতেই তারা এটি ছেড়ে রাখতেন। অপরাধ হয়ত তখনও ঘটত। তাও আমাদের জানার পরিধিটা সীমিত ছিল বলে এতটা চিন্তা হত না। এখন সামাজিক মাধ্যম, মূলত ওটিটির দৌলতে রাখ-ঢাক প্রায় নেই। এই বিষয়গুলি শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভূক্ত না হওয়ায় একই সময়ে সকলের জানাও হচ্ছে না। যারা আগে জেনে যাচ্ছে তাদের আরও আগ্রহ জন্মাচ্ছে। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা না করে বিষয়টি বন্ধুদের বলছে। তখন আর সেটি ‘স্বাভাবিক’ নয়, ‘অত্যন্ত রসালো’ আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ এই ঘটনাগুলি অর্থে ঋতুস্রাব, স্বমেহন,শারীরিক মিলন ইত্যাদি যে ভিন গ্রহের বস্তু নয় এই ধারণা তাদের জন্মাচ্ছে না। এবার কোন সময়টি তাহলে এইসব বিষয়ে জানা বা অভিভাবকদের বলে দেওয়ার জন্য সঠিক? অনেকের সঙ্গেই এই বিষয়ে আলোচনা করে আমি সদুত্তর পাই নি। তবে বেশিরভাগ সময়ে ছেলেদের ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসা জন্মায় বাড়িতে মা’এর ব্যবহার করা ‘স্যানিটারি প্যাড’ দেখে। জিজ্ঞাসা এলে অনুসন্ধিৎসু মনের কৌতূহল মেটাতে আমরা রাখ-ঢাক যতই রাখি না কেন, গুগলে একটা কী-ওয়ার্ড সার্চ মারলেই AI এর দৌলতে সব বৃত্তান্ত চোখের সামনে নিমেষে হাজির হবে। তাই জেনে যাওয়ার পর্যায়ে যাওয়ার আগে জানিয়ে দেওয়াটাই শ্রেয়, অতিরিক্ত কৌতূহল যাতে পরে অপরাধপ্রবণতায় পরিবর্তিত না হয়।
এই প্রসঙ্গে দুটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। বাঙুরে আমরা যে ফ্ল্যাট বাড়ির পাঁচ তলায় থাকতাম তারই চার তলায় যে পরিবার থাকত তাদের সঙ্গে আমার বাবার কস্মিনকালে একবার বেশ বড় রকম ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকে মা-বাবা সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করলেই বিভিন্ন গালাগাল ভেসে আসত। তার মধ্যে ‘বরাহনন্দন’, ব দিয়ে দুটি তিন এবং চার অক্ষরের শব্দ ছিল। এগুলির অর্থ আমি প্রায় অনেক বড় বয়স অবধি জানতে পারি নি। মা-বাবাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় নি। আমার ঠাকুমা বলেছিলেন শুধু যে শব্দগুলি খারাপ, আমি যেন কখনও কোথাও ব্যবহার না করি। এখন অবশ্য অবস্থা বদলেছে, ফ্ল্যাট বাড়ির অন্দর থেকে ঐ ব -দিয়ে শব্দগুলি রাস্তায় বেরোলে যত্রতত্র শোনা যায়। কবে টিনটিন এসে ওগুলির অর্থ জিজ্ঞাসা করবে সেই অপেক্ষায় দিন গুনি। নিজের থেকে বলে দেওয়ার সাহস এখনও জুটিয়ে উঠতে পারিনি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও ‘রসালো’। ১১-১২ ক্লাসে আমার কো-এডুকেশনে প্রথম পা দেওয়া। তখন উল্টোডাঙায় রেল কলোনীর কাছে একজন ছাত্রের বাড়িতে আমি বাংলা যাঁর কাছে টিউশন নিতাম তিনি কয়েকদিন আমাদের ব্যাচটিকে পড়িয়েছিলেন। ছেলেটিও আমাদের সমবয়সী। একদিন স্যার এসে পৌঁছানোর আগে সে একটি চটি ছবির বই আমাদের দেখিয়েছিল এবং বেশ কয়েক পাতা আমরা পড়েছিলাম। ছেলে-মেয়ে মিলে, কোনও ‘দুর্ঘটনা’ ছাড়াই। আমার মনে আছে সেই বইতে যে ভাষা,শব্দ এবং ছবি দেখেছিলাম তা মনে পড়ে আমার পরের বেশ কয়েকদিন মারাত্মক বমি পেত। মানসিকভাবে দুর্বল ছিলাম অবশ্যই এবং মা-বাবাকে বলি নি যথারীতি। কলেজে উঠে জেনেছিলাম ওগুলিকে ‘বটতলার বই’ বলে এবং কলকাতায় বিশেষ বিশেষ জায়গায় এই বই পাওয়া যায়৷ আমরা কলেজ হস্টেলে ঐ বই আবার পড়েছিলাম। কিন্তু তখন আর সেই স্কুলের প্রতিক্রিয়া হয় নি। বন্ধুরা মিলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাই তখন এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম যে আমি যখন জেনেছিলাম তখন আমার ঐ ব্যাপারে জানার এবং বিষয়টি আত্মস্থ করার পরিণতি আসে নি। যখন এসেছে তখন আর গায়ে লাগে নি। এই বিষয়টিতে এখন আর বই লাগে না। বিভিন্ন সাইটে ঘুরলে তা অত্যন্ত সহজলভ্য। তাই এক্ষেত্রেও কৌতূহল নিবারণ-ক্ষণের অপেক্ষায় আছি। যেদিন মনে হবে পরিণতি এসেছে, অবশ্যই তা এখন কলেজে উঠে নয়, তখন এই ব্যাপারে সবই বলে দিতে হবে।
যাই হোক, এই বিষয়ে মূল বক্তব্যটি হল, সন্তান সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন অভিভাবকদের বন্ধুর পর্যায়ে নেমে এই বিষয়টি সঠিক সময় অনুধাবন করে আলোচনার মাধ্যমে বলে দেওয়া ভালো। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন অসদুপায় অবলম্বন করা, ‘অতিরিক্ত’ পর্ণ দেখা এবং অপরাধ প্রবণতা খানিকটা হলেও সীমাবদ্ধ হতে পারে।
এইবার গুরুগম্ভীর গল্প ছেড়ে একটু হাল্কা হওয়া যাক। আমাদের স্কুলে খুব বড় করে annual ফাংশন এবং প্রাইজ ডে হত। এটি অবশ্য এখনও সব স্কুলেই হয়। কিন্তু এখনকার অধিকাংশ স্কুলের সঙ্গে আমাদের স্কুলের একটা বড় পার্থক্য ছিল। আমাদের শহরতলির স্কুলে যেমন দুটি খেলার মাঠ ছিল তেমনই দারুণ সুন্দর একটা অডিটোরিয়াম ছিল। সেখানেই আমাদের annual function এবং prize day-র অনুষ্ঠান হত। আমাদের স্কুলের মূল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা যেতে হত। রাস্তার ডানহাতে আমাদের একটি প্রার্থনাগৃহ বা চ্যাপল ছিল। আর বাঁহাতে ছিল অপূর্ব বাগান। ক্লাসে রিহার্সাল শুরু হলেও শেষ কয়েকদিন অডিটোরিয়াম খুলে দেওয়া হত রিহার্সালের জন্য। যারা এই ফাংশানে করত, তাদের কাছে এই অডিটোরিয়ামে রিহার্সাল দেওয়াটা বেশ একটা ‘কলার তোলা’ টাইপ ব্যাপার ছিল। নাচ,গান,নাটক সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার ছিল। আসল প্রোগ্রামের দিন একাধিক পারফর্মারের আবার প্রাইজ থাকত। তারা সেজেগুজে মেকআপ করেই প্রাইজ নিতে উঠত। এটা বেশ মজা লাগত।
এখনও বেশিরভাগ স্কুলেই এই রিহার্সাল দিয়ে ফাংশান করার রীতি অব্যাহত। যারা এই দরুণ যে ক্লাস মিস করে দিদিরা দাদারা পরে সেগুলি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে করিয়ে দেন।আমাদের সময়ে এই সব অনুষ্ঠানগুলি ভিডিও করার তেমন কোনও সুবিধা ছিল না। এখন এই বিষয়টিতে আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি। যে কোনও ছোট অনুষ্ঠান ভিডিও রেকর্ডিং করে ইউটিউব বা ড্রাইভে রেখে দেওয়া যায়। পরে যখন ইচ্ছা দেখা–এতে স্মৃতি রোমন্থন এবং ভুল সংশোধন দুই-ই হয়। এইটিতে বঞ্চিত ছিলাম আমরা।
কিন্তু সব মিলিয়ে প্রাইজ ডে বা annual function এর রিহার্সাল শুরু হলেই একটা সাজো সাজো রব উঠত, এবং তার রেশ তারিয়ে তারিয়ে অনেকদিন উপভোগ করা হত। এই রীতি এখন যখন পুত্রের ক্ষেত্রে দেখি নিজের স্কুলের দিনগুলো বার বার মনে পড়ে… যে দিনগুলি ইউটিউবে ধরা না থাকলেও মনে ধরা আছে হুবহু।
[পরের পর্বে ‘স্কুলের কিছু মজার ঘটনা এবং স্কুল ড্রেস পরিবর্তনের গল্প’ এর গল্প]
ভালো লাগলো। লিখে যান।
Khub bhalo laglo… school diner gulor koto smriti : )
Eibhabei aro onek porbo asbe asha rakhlam
Khub bhalo laagche porte. Porer episode tar jonno opekhhai thaklam. All the best.
ভালো লাগছে । ছোটবেলার স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে ।