বিবর্তনের ধারাপাত
পর্ব ১ – শহরতলির প্রিস্কুল
ছোটবেলায় মা’কে প্রায় দিনই বলতাম, ‘তোমাদের কি মজা পরীক্ষা দিতে হয় না, রোজ স্কুলে যেতেও হয় না।’ মা তখন হেসে বলতেন, ‘যত বড় হবি বুঝতে পারবি, স্কুলের দিনগুলোই জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়। পরীক্ষা দেওয়ার স্মৃতির থেকে বন্ধুদের কথা, এই সময়ের দুষ্টুমির কথা সেগুলোই বেশি মনে থাকবে।’ তখন খুব বিরক্ত লেগেছিল এবং রাগ হয়েছিল মা’ র উপর। এইরকম ছোটবেলায় মা-বাবা র উপর হওয়া অনেক রাগ অভিমান এখন দেখি মানে আমার মাতৃত্বের প্রায় এক দশক পার হওয়ার পর দেখি খুব অবান্তর মনে হয়।
কলকাতায় শহরতলির বাঙুর এভিনিউতে কেটেছে আমার শৈশব ও কৈশোরের বেশ কয়েকটি বছর। তখন ঐ দু-তিন বছর বয়স থেকে ঠিক প্রি-স্কুলে পাঠানোর কনসেপ্ট ছিল না। তখন মন্টেসরি স্কুল বা নার্সারি স্কুলে পাঠানো হত যেখানে বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান এবং অল্প কিছু শেখানো হত, মূলত বাড়ি থেকে বাইরে মা-বাবা চেনা গণ্ডি থেকে দূরে কিছুক্ষণ থাকতে অভ্যাস করা। আমি মারাত্মক কাঁদতাম। থাকতেই চাইতাম না স্কুলে। আমার মা-বাবা কাজে থাকলেও আমার মনে হত যে,দিদার (আমি ঠাকুমাকে ‘দিদা’ বলতাম) কাছে থেকেই আমার সব পড়া হয়ে যাবে।
আমার মন্টেসরি স্কুলের একজন টীচার ছিলেন দত্তা আন্টি। মারাত্মক বকাবকি করতেন এবং টানতে টানতে বাচ্চাদের নিয়ে যেতেন। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের গায়ে হাত দিলে শিক্ষকদের জেলে যেতে হত না। এখন তো দেখি বন্ধুরা ধরাধরি করে খেলতে গিয়ে একজন আর একজনের গায়ে পড়লেও বাড়িতে কমপ্লেইন আসে যে একজন আর একজনকে মেরেছে। আমরা যতই বলি না কেন ব্যস্ততা বেড়েছে, এই সব ছোট ব্যাপারে ঠিকই সময় থাকে। তা যাই হোক, মন্টেসরি স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করার ক্ষেত্রে আমাদের ফ্ল্যাটের দারোয়ান, পোষাকি ভাষায় যাকে আমরা কেয়ারটেকার বলি, তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মহেন্দ্রকাকু। মহেন্দ্রকাকুর ভূমিকা আমার জীবনে অপরিসীম। দারোয়ানের হাতে ছোট মেয়েকে মন্টেসরি স্কুল থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিতে মা-বাবা’র তখন বুক কাঁপত না, সেরকম কোনও দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও ছিল না। মহেন্দ্রকাকু তার এক মেয়ে ও দুই ছেলে এবং কাকিমাকে নিয়ে আমাদের ছাদের একটা ঘরে থাকত। আমাকে মেয়ের মতোই দেখতেন। আঁকার স্কুল, মন্টেসরি স্কুল থেকে মহেন্দ্রকাকু নিয়ে আসত মাঝে মাঝে। এখন ফ্ল্যাটের দারোয়ান মেয়েকে দেওয়া-নেওয়া করবে….মা-বাবা রা একথা ভাবতেও পারবে না। অবনতি তো বটেই। মহেন্দ্রকাকুরা বিহারী ছিল। ছটপুজোর সময়ে কাকিমার বানানো ঠেকুয়া মুখে লেগে থাকত।
এখন যুগ বদলেছে। দু-তিন বছর বয়স থেকে ছেলে-মেয়েদের পাঠানো হচ্ছে স্কুলে। এখন আমরা সব আর্বান পেরেন্টস। পাশের গলির কিডজিতে একবার খোঁজ নিয়েছিলাম। জানলাম তারা শুধু ‘পটি ট্রেনিং’ করায় বাচ্চাদের শুরুতে। আমাকে আমার মা ঠিক কিভাবে পটি ট্রেনিং করিয়েছিল আমার মনে নেই, কিন্তু এর জন্য স্কুলে পাঠায় নি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
আমিও আর্বান এবং কর্মরতা মা হওয়া সত্ত্বেও সবিনয়ে বলেছিলাম ‘পটি ট্রেনিং’ আমি বাড়িতেই করাতে পারব। এখন আবার অনেকে ক্লাস ওয়ানেও দেখি ড্যায়াপার পরে আসে..…তাদের প্লেস্কুলে যাওয়া সত্ত্বেও পটি ট্রেনিংটা হয় নি। এদের দেখে মনে সাহস হয় বইকি।
আমার নিজের শহরতলির প্রিস্কুলে পড়ার সবচেয়ে বড় ফলাফল হল আমি ক্যালকাটা গার্লসে চান্স পাই নি….চান্স পেয়েছিলাম ক্রাইস্ট চার্চ গার্লস হাই স্কুলে। দুটো খেলার মাঠ, দারুণ সাজানো বাগান। আমার আত্মজ অবশ্য আমার মতো বাংলা মিডিয়ামে পড়ছে না….ওকে প্রিস্কুলে দিই নি….খুব বড় স্কুলেও দিই নি। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি বড় স্কুলে পড়লেই যে বড় হব তা নয়….ভালো শিক্ষা ছোট স্কুলে পড়েও পাওয়া যায়।
[পরের পর্বে স্কুলের গল্প]
ভালো লাগলো। সাবলীল ভাষার প্রয়োগ মন ছুঁয়ে গেল। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তীর জন্য।
খুব খুশি হলাম পড়লে বলে।
অসাধারণ লাগল। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
খুব খুশি হলাম পড়লি বলে
Khub bhalo laaglo lekhata pore. Porer lekhatar jonno opekhhai roilam.
অসংখ্য ধন্যবাদ গো।
Khub khub bhalo laglo Sumedha….. sotti tomar ei dharaner lekhagulo pore jeno mone hoy nijer moner katha…
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।