বিবর্তনের ধারাপাত
পর্ব ৩ – স্কুলের দিদি’রা
পাড়ার যে স্কুলে যেতাম সেখানে শিক্ষিকাদের ‘মিস’ বলা হত৷ ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলে এ নিয়ম ছিল না। সেখানে আমরা শিক্ষিকাদের ‘দিদি’ বলে ডাকতাম। মা-বাবা-দিদা-ঠাকুমাদের যেমন কেউ ডাকতে শেখায়নি, এমনিই শিখেছিলাম, তেমনই ‘দিদি’দের ‘দিদি’ ডাকতেও কেউ শিখিয়েছিল কিনা মনে পড়ে না এখন আর। অন্নপূর্ণাদি, ইলাদি, বনানীদি, কুমকুমদি, তৃপ্তিদি, শুভ্রাদি, যূথিকাদি,শুক্লাদি, সীমন্তীদি, রেখাদি, মৃদুলাদি, নমিতা দি, অশ্রুদি, পর্ণাদি, অপর্ণাদি, প্রণতিদি,নীলিমাদি মেরি মৌমিতাদি, সুমনা দি….আরও অনেকে। একই নামের দুই দিদি থাকলে আমরা যিনি বয়সে নবীন তাঁকে ‘ছোট’ এবং যিনি বয়সে প্রবীন তাঁকে ‘বড়’ বলতাম। যেমন ‘বড় তৃপ্তিদি’ এবং ‘ছোট তৃপ্তিদি’, ‘বড় অপর্ণাদি’ ও ‘ছোট অপর্ণাদি’ ইত্যাদি। সামনে বলতাম না অবশ্যই, নিজেদের মধ্যে বলতাম। শুধু প্রিন্সিপাল দিদিকে ‘বড়দি’ বলতাম। আমি অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ওঁর নামই জানতাম না।
কিছু দিদিদের কথা খুব মনে পড়ে, কিছুজনের সঙ্গে যোগাযোগও আছে৷ এখন একটা কথা বার বার ভাবি পড়াশুনোয় ভালো হওয়া সত্ত্বেও টুকটাক চড় বা হাতে জোড়া স্কেলের বাড়ি তো খেয়েইছি….এক বারের জন্যও তার জন্য দিদিরা কাঠগড়ায় দাঁড়ান নি….মা-বাবারা বরং জেনে-শুনেই দিদিদেরকে খোলা হাতে আমাদের শাসন করার অধিকার দিয়ে রাখতেন। এখন অবশ্য সেযুগ আর নেই….পেরেন্ট-টীচার্স মিটিং না হলে বাবা-মা’রা আন্দোলন করেন, ছেলে-মেয়ের গায়ে হাত তুললে কোর্ট কাছারি পর্যন্ত হয়…..এখন শিক্ষিকারা ‘ম্যাম’ যে….’দিদি’ নয় তো….তাই সম্পর্কটাও প্রফেশনাল…আত্মিক নয়। স্বল্প কিছু সংখ্যক স্কুলে এখনও শিক্ষিকাদের ‘দিদি’ বলে ডাকা হয়, তবে তা খুবই নগণ্য৷
তা যাই হোক স্কুলের দিদিদের মধ্যে যূথিকাদি আর শুক্লাদির শাড়ি পরা আমাদের খুব ভালো লাগত৷ যূথিকাদি বাংলা পড়াতেন আর শুক্লাদি অঙ্ক। দুজনেই দীর্ঘাঙ্গী ছিলেন, কিন্তু একদম বিপরীত স্বভাবের৷ যূথিকাদি বকাবকি, জোরে কথা একদম বলতেন না, শুক্লাদি খুব রাগী ছিলেন। কিন্তু এক জায়গায় দুজনের খুব মিল ছিল। দুজনেই খুব ভালো পড়াতেন নিজের বিষয়গুলি। আমি বাড়িতে গিয়ে কতবার যে দিদাকে বলেছি, ‘জানো, শুক্লাদি আর যূথিকাদি শাড়ি পরার পর মনে হয় সেটা ইস্ত্রি করে নেন। কি ভালো লাগে দেখতে!” দিদা হাসতে হাসতে বলতেন, ‘না রে, পরার আগেই ওভাবে পাট করে নেওয়া যায়।’
দিদিদের সাজের প্রতি একটু বড় হওয়ার পর থেকেই বেশ কৌতূহল লাগত। আমাদের স্কুলে কেউ সালোয়ার পরতেন না। মা’ও শিক্ষিকা…. তাঁকেও দেখতাম রোজ শাড়ি পরে কলেজে যেতে, স্কুলেও দিদিদের দেখতাম শাড়ি পরে আসতে। আমাদের এই কৌতূহল এসেছিল প্রায় বছর ১২তে….টিনটিন দশম বর্ষ আসার আগেই বাড়িতে এসে দেখি ঠাম্মিকে দিদিদের শাড়ির রং-ডিজাইন নিয়ে গল্প করে। এভাবেই যুগে যুগে জানার পরিধিটা এগিয়ে আসে….বয়সটাও সম্মুখধাবন করে।
শুক্লাদি, নমিতাদি’র সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে। পর্ণাদি, অপর্ণাদি, মেরী মৌমিতাদি, মৃদুলাদির সঙ্গেও। শুক্লাদির সঙ্গে একটা ছোট মজার ঘটনা মনে পড়ে। বড় টিফিনে কাগজের বল বানিয়ে চুটিয়ে লোফালুফি খেলছি,কখন ঘন্টা পরে গেছে টের পাই নি। শুক্লাদির অঙ্ক ক্লাস ছিল। সিঁড়ি দিয়ে ক্লাসের দিকে উঠতে যাবেন আমার ছোঁড়া কাগজের বল ওঁর হাতে লাগল। ব্যাস! তুলে নিলেন। আমার তো দেখে ভয়ে, উত্তেজনায় স্কার্ট ভিজিয়ে ফেলার অবস্থা। দিদি আমার ঐ গলদঘর্ম দেখে বললেন, ‘বলটাই নিলাম, শাস্তিস্বরূপ। আজ ক্লাসে আয়, পরের দিন আর এরকম হলে আসবি না।” আমার বেশ মন খারাপ ছিল কয়েকদিন।
‘ছোট রেখাদি’ আমাদের additional বায়োলজির ক্লাস নিতেন। আমার এই বিষয়টি ভালো লাগায় আমি খুব পড়তাম। রেখাদি বিনুনির নীচে দিকে রাবার ব্যান্ড বাঁধতেন না। আর পরীক্ষার সময়ে হলে ঢুকেই বলতেন, ‘তুই লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বস। কাউকে জিজ্ঞাসা করবি না। কেউ তোকে জিজ্ঞাসা করবে না। শান্তিতে পরীক্ষা দে।’ এই মজার কথাগুলো মনে পড়লে এখন হাসি পায় বটে।
মৃদুলাদি পি.টি করাতেন এবং দারুণ নাচতেন। দিদি এখনও নাচেন। ফেসবুকে ওঁর নাচের ভিডিওগুলি ওঁর অদম্য প্রাণশক্তির পরিচয় দেয়৷
আমাদের জীবননিজ্ঞানের শিক্ষিকা শুভ্রাদি ১৫ই আগস্ট উপলক্ষ্যে একবার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শেষ অভিযানের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। নাম ভূমিকায় ছিলাম আমি। আমাকে স্বদেশী গল্প এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের বিবরণ যারপরনাই আকর্ষণ করত। মূল দিনে দৃশ্যের স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে আংটি থেকে বিষপান করে মৃত্যুবরণের দৃশ্যে আমাদের শান বাঁধানো স্টেজে এত জোরে পড়েছিলাম কপালে লেগে ফুলে গিয়েছিল খুব। দিদি স্টেজ থেকে নামার পর জড়িয়ে ধরেছিলেন আর পরম যত্নে কোথা থেকে যেন বরফ জোগাড় করে ঘষে দিয়েছিলেন কপালে। স্বর্গত শুভ্রাদি এই স্মৃতি-রোমন্থন পড়লে আজ খুব আনন্দ পেতেন।
ইস্কুলে পড়াকালীন দুটি বিষয় দেখেছিলাম। এক, বিষয়ের প্রতি আগ্রহ-উদ্রেকের সঙ্গে পড়া তৈরি হওয়া সমানুপাতিক৷ আর দুই, সংশ্লিষ্ট দিদি যদি সেই বিষয়টি ভালো করে পড়াতেন তাহলে বাড়িতে আর কারও সাহায্য লাগত না। এই ধারার বিবর্তন এখনও হয় নি।
শুক্লাদির সঙ্গে খুব সম্প্রতি দেখা করেছিলাম। এখন অবসর জীবনে অঙ্কর সঙ্গে দোসর হয়েছে দেশ-বিদেশ বেড়ানো। স্কুলের ভিতরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিদির ‘প্রতাপ’ খানিক স্তিমিত হলেও মেরুদণ্ড এবং বাচনভঙ্গি অসীম ঋজুতার পরিচয় দেয় এখনও,যা উনি দায়িত্ব নিয়ে আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতেন,এই বিষয়টি আজকের অনলাইন বা পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষার যুগে সামান্য নিম্নগামী মনে হয়।
[পরের পর্বে ‘গার্লস স্কুলে বয়ঃসন্ধির আগমনবার্তা’…]
Khub bhalo laagche porte. Nostalgic o laagche. Porer part er jonno opekkhai thaklam.
স্মৃতি মধুর লেখা ভালো লাগলো।
অভিনন্দন।
Khub valo laglo. Porer porber opekkhay roilam