অতিশ্রুত রবীন্দ্রসংগীতের তালিকা করতে বসলে, এই গান খুব উপরের দিকে থাকবে। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা।
গ্রাম-মফস‌্সলের নবীন সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের অনেকেই শুরুর দিকে এই গান শেখে। সহজ সুর, মারপ্যাঁচহীন, খুব বেশি চড়াই উৎরাই নেই। এমনকি, গানের বাণী আর মূল ভাবনাটিও— রবীন্দ্রনাথের মানের নিরিখে বলতে গেলে— যথেষ্ট সাদামাটা-মধ্যবিত্ত। আমার, অন্তত, এই মনোভাব ছিল। বোধহয় আরও অনেকেরই, এমন; এ-গানকে সিরিয়াসলি নেওয়ার রেওয়াজ কমই, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতে তার প্রমাণও মেলে।
বস্তুত খুব কম বয়স থেকেই— রেডিওয়-মাইকে-মঞ্চে, জলসায়-রবীন্দ্রজয়ন্তীতে, বাসরঘরে-ক্লাসরুমে— নামী শিল্পী, মাঝারি গাইয়ে, অত্যুৎসাহী শিক্ষানবিস, বেসুরো আনাড়ি সব্বার গলায় হরবখত শুনে শুনে এই গানটা আমার কাছে ভোঁতা হয়েই গিয়েছিল। অন্তত আমার কাছে নতুন কোনও রোমাঞ্চকর উন্মোচন নিয়ে এ আর হাজির হতে পারবে না, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম।
তারপর একদিন, আমাকে অতর্কিত আঘাত হানল এই ‘নিরীহ’ গান।


সে-এক বসন্তদিনে অন্যমনস্ক হয়ে গাইছিলাম, যেমন বহু-বহু মুখস্থ গান গেয়ে একঘেয়েমি কাটানো আমার অভ্যাস; যেন অসচেতনেই, বেখেয়ালেই। সরল সুর, সাধারণ কথা— বহু-শ্রবণের, বহু-গায়নের অভ্যাস থেকে এমনিই উঠে-আসা গুনগুন। সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা। সেই স্মৃতিটুকু কভু ক্ষণে ক্ষণে যেন জাগে মনে, ভুলো না, ভুলো না। …মামুলি গল্প, মামুলি বক্তব্য। পৃথিবীতে লক্ষবার এইসব কথা বলা হয়ে গেছে।
কিন্তু পরের লাইনগুলো গাইতে গিয়ে হঠাৎই খেয়াল হল, ধীরে ধীরে আমার মনের মধ্যে কিছু-একটা পাপড়ি মেলছে। একটা বিস্ময়বোধ, একটা অননূভূতপূর্ব শিহরন। যেন বহুকালের চেনা কালো মেয়েটির গালে এসে পড়ল অলৌকিক কনে-দেখা আলো!
এ সব কী লেখা আছে অন্তরাতে? শুনেছি, গেয়েছি, খেয়াল করিনি!
সেদিন বাতাসে ছিল, তুমি জানো/ আমার মনের প্রলাপ জড়ানো।
বনের মধ্যে ফুলের দোলনায় দুজনে দুলেছিনু, স্মৃতিটুকু যেন মনে থাকে, ভুলো না গো… এই সব প্রচল-প্রথাসিদ্ধ অতি-সাধারণ লঘু-রোমান্টিকতার লিরিক-কনভেনশন থেকে এক লহমায় ফণা তুলল সেই আশ্চর্য, সেই মৌহূর্তিক অঘটন। চমকে উঠল স্নায়ুরা। সেদিন বাতাসে— ফুলের রেণু নয়, বসন্তের সুগন্ধ নয়, পত্রমর্মর নয়, কাকলি-কূজন-গুঞ্জরণ এমনকি আনন্দ-হিল্লোল গোছেরও কিছু নয়— যা জড়িত ছিল তা হল: ‘আমার মনের প্রলাপ’!
এমন পংক্তি এর আগে কেউ কখনও লিখেছেন? পরেও কেউ, বাংলা গানে?
না, এখানেই শেষ নয়। তার পরের বাক্যটি আরও ছলকে উঠবে, আরও বিপুল আঘাতে আমার রোম দাঁড় করিয়ে দেবে।
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো…

অনলাইনে সংগ্রহ করতে, ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন


তিষ্ঠ ক্ষণকাল!
‘আছিল’? এই প্রয়োগটা তো বড্ড এলায়িত, পুরনোগন্ধী— এমনই ভেবে এসেছি এতদিন। যেন অমনোযোগী প্রয়োগ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, নিছক ছন্দ মেলানোর দায়ে। আজ, এই প্রথম, মগজে একটা ঢেউ দিল। রবীন্দ্রনাথ ছন্দ মেলানোর সম্রাট, তিনি কি ‘ছিল গো ছড়ানো’ জাতীয় কিছু বিকল্প খুঁজে নিতে পারতেন না একটি তুড়িতেই? আমাকে তো বিশ্বাস করতেই হবে, গীতরচয়িতা রবীন্দ্রনাথ কখনও একটিও অমনোযোগী শব্দ প্রয়োগ করেননি, এমনকি অপেক্ষাকৃত মামুলি গানেও। হ্যাঁ, এখানেও, এ তো সচেতন প্রয়োগ, দেখছি আজ! ‘আছিল’ শব্দটির মধ্যে মোক্ষম, অভ্রান্ত এক প্রাচীনত্বের আবহ ধরা আছে; এবং তা মধ্যযুগের এক বিশেষ-গোত্রের বাংলা সাহিত্যেরই ঘ্রাণ। পূর্ণিমা-রাতে ফুলডোরে ঝুলনের সঙ্গে সেই সাহিত্যের সম্পর্ক— বুঝ লোক, যে জান সন্ধান!
আবার লাইনটাতে ফিরি। আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো…
আকাশে আকাশে?
আকাশ শব্দের দ্বিত্ব-প্রয়োগ আমরা রবীন্দ্রনাথের আগে (মনে পড়ে যায়, ‘গগনে গগনে’ তাঁরই একটি প্রিয় প্রয়োগ) কাউকে করতে দেখেছি? আকাশ তো অখণ্ড, অনন্ত। ‘সারা আকাশে’ বা ‘আকাশ জুড়ে’র মতো প্রচলিত প্রয়োগ ভেঙে ‘আকাশে আকাশে’ যেই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ, কী অপূর্ব একটা আলংকারিক ব্যাপ্তি খুলে গেল না? যেন বাহ্যিক আকাশ শুধু নয়, প্রেমিকের চিদাকাশেরও একটা ইঙ্গিত!
কিন্তু, এখনও চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছইনি আমরা। আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো… কী? কী ছড়ানো?
আমরা তো দেখছি, এটা পূর্ণিমা-রাত (পরের স্তবকেই বলা হবে)— বনের পথে যেতে যেতেই চাঁদ উঠেছিল। তাহলে আকাশে কী ছড়ানো থাকার কথা? কী আবার, রুপোলি চাঁদের জোছনা।
মানে, এইরকমই কিছু। সাধারণ বুদ্ধি তাই বলে। ছন্দ-মিলেরও অভাব হয় না তাতে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এক উন্মাদ জাদুকর। তিনি বললেন, ‘তোমার হাসির তুলনা।’
ব্যস! এই লাইনটা, আমাদের একদম চোখের সামনে, লাফ দিয়ে— ঐ আকাশেই উঠে গেল। এই চিত্রকল্পটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই তা লক্ষ-শব্দের ভাবসম্প্রসারণের আয়ত্তাতীত হয়ে গেল, একমাত্র উপলব্ধিকারীর রোমাঞ্চিত চিত্ত ছাড়া এর কোনও উপযুক্ত আধার নেই। এই পংক্তি তুলে নিয়ে এল মানস-সায়রের সেই দেবদুর্লভ শতদল— যার নাম অনির্বচনীয়, যার নাম অপার্থিব, যার নাম কবিতা। শুধু বিরল মুহূর্তেই যা প্রকট হয়। চকিত, ক্ষণপ্রভ, ভাগ্যবানের কয়েক পলের ভোগ্য।
ঠিক যেমন— প্রেম!
দমকা হাওয়ার মতো, বিজলির চমকের মতো, চকমকির ফুলকির মতো তা আচম্বিতে আসে। তারপর চুপচাপ শেষ হয়। মরমানুষের জীবন, তার আসার আগেও যেমন, চলে-যাওয়ার পরেও তেমনই থেকে যায়— মামুলি, মধ্যবিত্ত, ম্যাড়মেড়ে। সঞ্চয় থাকে শুধু স্বর্ণময় স্মৃতি। ‘স্পর্শ পেয়েছিল যার এক পল ভর…’!
এমনকি, যার সঙ্গে সারাটি জীবন পাশাপাশি সংলগ্ন হয়ে কাটবে, তার সঙ্গেও— অমন প্রলাপী বাতাসের মায়ায় অমন কোনও চন্দ্রাহত মহা-লগনের যাপন, অমন কোনও কুঞ্জকাননে ফুলডোর-দোলন— ঐ, এক-আধ পলই। অনন্ত মুহূর্ত। ক্ষণস্থায়ী বলেই স্মৃতিতে বেঁধে রাখার অত আর্তি। ভুলো না, ভুলো না, ভুলো না।
বাকিটা? নিতান্ত সাধারণ, উচ্চাবচহীন, শিহরন-রহিত শব্দসমাবেশ। বেলা নাহি আর, বিরহের ভার, বাঁধিনু যে রাখি, সে রাখি খুলো না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখা গান হলেও, তাতে নতুন কোনও স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় না আর। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম: এই-যে গানের অন্তরাটি, ঐটিই হল সেই মহার্ঘ অথচ স্বল্পায়ু প্রেমের চকিত উদ্ভাস। আর, আগে-পরের বাকিটুকু, অন্যমনের অভ্যাসে গুনগুনিয়ে যাওয়া— আমাদের অবশিষ্ট সব সপ্তাহ-মাস-বছর; ছাপোষা গৃহস্থের তেল-নুন-লকড়ির দিনক্ষয়।
রবীন্দ্রনাথের এই গান— আমার মনে হল— এ যেন আমাদের একটা আস্ত জীবন।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]