তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম সূত্রে আমার পিতামহ। আমার পিতা প্রয়াত সরিৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়


পিতামহকে আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের প্রথম সতেরোটা বছর। ওই সময় তাঁর সঙ্গে একই ছাদের তলায় বাস করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাই, আজ যখন জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পিছন ফিরে প্রারম্ভের দিনগুলোর দিকে তাকাই, তখন এক অজানা স্মৃতি মেদুরতায় বুকের মাঝে টনটনিয়ে ওঠে – মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, হায়, এই সতেরোটা বছর এত তাড়াতাড়ি কেটে গেল কেন?

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর সাথে নাতি সৌম্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৬৫ সালে সিউড়িতে।


তারাশঙ্কর ছিলেন এক বটবৃক্ষ। বহু মানুষ এমনকী অনেক জীব জন্তুও তাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে সেই বটবৃক্ষের ছায়ায়– তাঁর ডালপালায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তিনি গভীর মমতায় তাদের পরিচর্চা করেছেন, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন– অসীম পারদর্শীতায় তাদের সুখ দুঃখের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাদের মধ্যে যেমন গণদেবতার দেবু ঘোষ রয়েছে, তেমনি তমসার অন্ধ পঙ্খীও রয়েছে। রয়েছে কুসংস্কারকে আঘাত করা হাঁসুলীবাঁকের করালী, ঠিক তেমনই রয়েছে স্বৈরিণী বসন কিম্বা বৈষ্ণবী কমলিনী। আবার রংলালের সঙ্গে রয়েছে তার প্রকাণ্ড দুই মহিষ কালাপাহাড় ও কুম্ভকর্ণ। কিম্বা খোঁড়া শেখের সঙ্গে তার পোষা উদয় নাগ – না, নাগ নয় – নাগিনী বিবি।


আমি অবশ্য এখানে তারাশঙ্করের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি, কারণ সে বিদগ্ধতা আমার নেই। আমি বরং পিতামহকে কেন্দ্র করে আমার জীবনের দু একটি পাতা খুলে বসি, আপনাদের শুনতে হয়তো ভালো লাগবে।
সে প্রায় আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগের কথা, ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসের এক শীতের দিন। বাবার চাকরি সূত্রে আমরা তখন সিউড়ি আইটিআই কলোনির বাসিন্দা। বীরভূম জিলা স্কুলে পড়ি। কিছুক্ষণ আগেই স্কুল থেকে ফিরে এসেছি – আকাশ ভেঙে শীতের বৃষ্টি নেমেছে। বাড়ির বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মনটাও বিশেষ ভাল নাই। স্কুলে ক্লাস চলাকালীন কথা বলার জন্য অঙ্কের পিরিয়ডে তিরস্কৃত হয়েছি। এমন সময় হঠাৎই বাড়ির সামনে এক সাদা অ্যামবাসেডার এসে দাঁড়াল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং পিতামহ।
জানতাম পিতামহ আসবেন – আহমেদপুর স্টেশনে তাঁকে আনতে গাড়ি গিয়েছে। পরদিন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে সিউড়ির রামরঞ্জন পৌরভবনে তাঁকে এক সম্মর্ধনা জ্ঞাপনের আয়োজন করা হয়েছে।
ভিজতে ভিজতেই বারান্দায় উঠে এলেন। আমাকে দেখেই কী যেন ভাবলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে ভাই – এমন ম্লান মুখে বসে আছ কেন?’

হায়রে অবুঝ বালক মন, সে এ কথার কোন উত্তর দিতে পারেনি – শুধু ঝর ঝর করে চোখের জল ফেলে তার মনের ব্যথা ব্যক্ত করেছিল।
কিন্তু তিনি যে তারাশঙ্কর – মানুষের মনের কারবারি – মুহূর্তেই যেন সবই বুঝতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তিরস্কৃত হয়েছো – অন্যায় করেছো? কিন্তু এই তো চোখের জল ফেলছো – তার মানে সে অন্যায়ের গ্লানি তুমি হৃদয়ে অনুভব করেছো। তার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছো। তাই নাই বা করলে সে রকম অন্যায়, যাতে পরে চোখের জল ফেলতে হয় – মনে গ্লানি হয়।
এই রকমই আর একটি পাতা ১৯৭০ সালের। সেও এক ডিসেম্বরের সন্ধে। বাংলার আকাশ বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। বাবা তখন সিউড়ি থেকে কলকাতায় বদলি হয়ে এসেছেন, আমিও বীরভূম জিলা স্কুল ছেড়ে ভর্তি হয়েছি কলেজ স্কোয়ারের পাশে হিন্দু স্কুলে।
সেই সময় কলেজ স্কোয়ারে অল্পবয়েসীদের জন্য এক বিরাট ব্যাডমিন্টন কম্পিটিশন হত। সে বছর আমি তাতে অংশ নিয়েছিলাম। স্কুল শেষে খেলা ছিল। শীতকাল, বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়েছিল। গেটের মুখেই রাশভারী পিতামহ। জিজ্ঞাসা করলেন, এত দেরি কেন? উত্তর শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। রেগে উঠে ধমক দিলেন।
সে ধমক এতই কঠোর যে ভয়ে বিহ্বল হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এরপর যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি তা কে জানে?


ঘুম ভাঙলো শেষ রাতে। অনুভব করলাম কে যেন সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আধোঘুমে তাকিয়ে দেখি পিতামহ – মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, দাদুভাই, ছাদে এস।
ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ ধুয়ে ছাদে গিয়ে দেখি শীতের ভোরে শুধু মাত্র একটা পাতলা আলোয়ান গায়ে সেই ঋযিকল্প মানুষটি একাকী দাঁড়িয়ে আছেন –আকাশ ভরা তারার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন। আমায় দেখে হাসলেন। অদ্ভুদ স্নেহ মাখা সে হাসি। বললেন, তাকিয়ে দেখো, আকাশে কত তারা, কিন্তু আমরা কি ওদের সবার নাম জানি –জানি না। আর ঐ তারাটির দিকে তাকাও, দেখো কেমন জ্বলজ্বল করছে। যেন নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে চিনিয়ে দিচ্ছে। ওর নামই ধ্রুবতারা। যুগ যুগ ধরে মানুষ ওকে দেখে জীবনের দিক নির্ণয় করেছে। তাই পারলে ধ্রুবতারার মতো হয়ো, অজস্র তারাদের মাঝে হারিয়ে যেও না।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার কিছু ছবি।


না, ধ্রুবতারা তো অনেক দূরের কথা, তারা হয়েও উঠতে পারিনি।
আজ যখন তাঁর কথা চিন্তা করি তখন যেন চোখ বুজলেই দেখতে পাই সূর্যের পরন্ত আলোতে আমাদের টালাপার্কের বাসভবনের ঠিক গেটের সামনে বড় বোগানভেলিয়া গাছটার তলায় সেই মানুষটি একটি বেতের চেয়ারে বসে আছেন – ঠিক তখনই বুকের ভেতরটা কেমন যেন টনটন করে ওঠে – চোখের কোণা নিজের অজান্তেই ভিজে ভিজে লাগে। তখন কোনরকমে নিজেকে সামলে আবার নিজের কাজে মন দিই।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
9 months ago

শ্রদ্ধেয় লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা জানানোর জন্য ধন্যবাদ। সত্যি তিনি সাহিত্য জগতে বটবৃক্ষ!