ঘোড়ার আস্তাবল ছিলো একসময়। আর ঐ পুকুরে ঘোড়াদের চান। আশপাশ, ঘোড়ার পুকুর ধার। সেই থেকেই এই অন্চলটার নামই ঘোড়াপুকুর ধার। বড়াইচন্ডিতলা মন্দিরকে ডান হাতে রেখে পাশের সরু গলি দিয়ে একটু এগিয়ে বাঁপাশে উঠে গেছে গলিপথ। এই গলিপথ দিয়ে উঠে একটু এগিয়ে গেলে বাঁহাতে পড়বে মণিদাদুর হলুদ বাড়ি। রাস্তার পাশেই মণিদাদুর জানালা। মণিদাদু তখন অশক্ত। সবার মণিদাদু খালি চিঠি লিখতেন। দিনের বেলায় রাস্তার আলো জ্বললে বিদ্যুৎ দপ্তরে চিঠি। কর্পোরেশন কলে জল পড়লে চিঠি। বলতেন – দেশের সম্পদ যাতে নষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্ব তো দেশবাসীর।

গোস্বামীঘাটের চন্ডীমন্দিরের সামনেই ল্যাম্পপোস্ট। লোহার রড। রডের মাথায় লোহার কাজ করা ফ্রেম লাগানো কাঁচ। ভেতরে তিরতির করে জ্বলছে রেড়ির তেলে ভেজা পলতে। ল্যাম্পে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বছর তেরোর অরুন। অরুনচন্দ্র দত্ত। সন্তান সংঘের প্রতিষ্ঠাতা। পুলিস দেখতে পেলেই সিটি মেরেই ঐ ঘোড়াপুকুরের গলি, দৌড়।

মণীন্দ্রনাথ এখন ঘোড়াপুকুরের গলি দিয়ে বেড়িয়েই টুক করে ল্যাম্প পোস্টের পাশে হলুদ রঙের পাকা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লেন। রাত ন’টা। শীতকাল। আপাদমস্তক চাদর মোড়া। ১৯১০। অক্টোবর মাস। মতিলাল রায়ের বাড়ি।
ঘরের ভেতরে তখন মতিলাল রায়, রাসবিহারী বোস, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ।
‘বানিয়ে ফেলেছো? শক্তিশালী করতে হবে।’ রাসু তাকায় শান্ত মণির দিকে।
মণি ঘাড় নাড়ে, ‘হয়ে যাবে ঠিক, মশলা রেডি।’

জন্মঃ ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ মৃত্যুঃ ৭ এপ্রিল ১৯৭৬

রাসবিহারীর চোখ উজ্জ্বল হয়, ‘শোনো, তুমি মতির বাগানে বোমাটা টেষ্ট করবে। সাতটা সাতান্ন মিনিটে। উত্তুরে হাওয়া। সেই আওয়াজ প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে আমার বাড়িতে আমি শুনতে পাবো ঠিক আটটার সময়। আমি আর শিরে থাকবো বাড়ির ছাদে।’
চন্দননগরের ফটকগোড়ায় থাকতো পাশাপাশি বাড়িতে অভিন্নহৃদয় রাসু আর শিরে। রাসুর পেছনে শুধু নয়, বিপ্লবের প্রতিটি সাংগঠনিক কাজে চন্দননগরের শ্রীশচন্দ্রের অবদান অনুল্লেখ থেকে গেছে। অন্যসময় বলবো।
কালীপুজোর রাত। ঘড়িতে সাতটা সাতান্ন মিনিট হতেই মতিলালের বাড়ির ছাদ থেকে বোমা ছুঁড়ল মণি মতিলালাদের বাগানে।‌ কোনো শব্দ হলো না। দৌড়ে তুলে আনল মতি। আবার ছুঁড়ল। বিকট শব্দ, ধোঁয়া, পাঁচিলের প্লাস্টার খসে গেল।
কিছুক্ষণ বাদেই দৌড়ে এলো রাসবিহারী, ‘হয়নি হয়নি। এক চান্সে ফাটতে হবে। আরো কড়া করতে হবে!’

প্রথম পরীক্ষায় সফল না হলেও শক্তিশালি বোমা তৈরি হলো ঐ ঘোড়াপুকুর ধারের বাড়ির চিলেকোঠায়। বানিয়েছে মণীন্দ্রনাথ নায়েক। বোমার ওজন: এক পাউন্ড এগারো আউন্স।
১৯১২ সালের ২৩শে ডিসেম্বর বেলা ১১-৪৫ মিনিটে দিল্লীর রাজপথে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর রাসবিহারী, বসন্ত বিশ্বাসেরা এই বোমাটাই ছুঁড়ে মারল। নিভু নিভু বিপ্লবের আগুন আবার জ্বলে উঠলো। চন্দননগর থেকে বোমা ছড়িয়ে পড়ছে মিরাট থেকে খুলনা, পাঞ্জাব থেকে এলাহাবাদে। উল্লাসকর, হেমচন্দ্র সবাই জেলে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বোমা তৈরির ও সরবরাহের দায়িত্ব তখন ছোটখাটো চেহারার মণীন্দ্রনাথ নায়েকের উপর।
অত্যন্ত মিতবাক, প্রচারবিমুখ এই মানুষটি, এলাকার মণিদাদু যে হাতে বোম বানাতেন সেই হাতেই লিখতে পারতেন অসাধারন, ইংরাজী- বাংলা- ফরাসিতে। সেই সময়ে স্কটিশের কেমিস্ট্রিতে বিএসসি, শিবপুর বি.ই. কলেজের এমএসসি। ১৯১৫-১৯ ‘প্রবর্তক’ পত্রিকার সম্পাদনা। কারা লিখছেন সেই পত্রিকায়- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, থেকে শুরু করে সবাই। নন্দলাল বসু করছেন প্রচ্ছদ। এই মণিদাদু, ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে ফরাসী-ভারত বিধানসভার সদস্য। ১৯২০ সেনেটর। নাগরিক সুরক্ষা ও গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তারপর ‘প্রবর্তক’ এর বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির কাজে জীবন দান।
পুলিস বহুবার চেষ্টা করেও ওনাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। শান্ত বুদ্ধিমত্তায় উনি বেড়িয়ে গেছেন। তাই উনি আড়ালেই থেকে গেলেন। কোন ফলক বা মানপত্র পৌঁছল না তার বাড়ি।
স্বাধীনতার রজত-জয়ন্তী বর্ষে নানা অনুষ্ঠান। কলকাতা টাউন হলে হচ্ছে এক প্রর্দশনী – স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যবহৃত অস্ত্র সম্ভার। সেখানে একটা জায়গায় দেখানো হচ্ছিল লর্ড হার্ডিঞ্জকে ছোঁড়া বোমা তৈরির ইতিহাস, কৌশল। বলছেন ডেমোন্সট্রেটর বোমার উপাদান ও ওজন। সামনে দর্শক শুনছে। দর্শকের ওখান থেকে এক রোগা, ধূতি আর খদ্দরের সার্ট পড়া অতি সাধারণ এক মানুষ বললেন, আপনি ভুল বলছেন?
মানে!
মানে আপনি ভুল তথ্য দিচ্ছেন বোমার ওজন ও উপাদান সম্পর্কে!
কী পাগলের মতো বলছেন! কে আপনি! কে এখানে ঢুকতে দিয়েছে!

আমার নাম মণীন্দ্রনাথ নায়েক।

সবাই চমকে উঠে তাকায় অতি সাধারণ এই লোকটির দিকে। তিনি ছিলেন অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি এই অনুষ্ঠানে। কিন্তু ঘর্মাক্ত সাধারণ পোশাকে অতি সাধারণ অ্যাপিয়ারেন্সে কেউ চিনতেই পারেনি। উনি বলে গেছেন এই ঘটনা স্মৃতিচারণে।

আমরাও কি চিনেছি আজও!
চারপাশে যখন অরাজকতা, অসহিষ্ণুতা, নৈরাজ্য সেই সময়, সেই সময়, মণিদাদু একবার এসো, স্মৃতিতে, জেগে থাকো, প্লীজ, মণিদাদু একটু জাগিয়ে রাখো…

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মে ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
5 months ago

আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের কত কথা যে অজানা থেকে গেছে। খুব ভালো লাগলো এমন একটি মানুষের কথা পড়ে ।

পল্লববরন পাল
পল্লববরন পাল
4 months ago

মাথা নত হয়ে আসে এইসব সাধারণ স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর সামনে – লজ্জায় আত্মগ্লানিতে – কী হাল করলাম আমরা সেই স্বাধীনতার।

ধন্যবাদ রজতবাবুকে। এমন আয়না আরো ধরুন আমাদের মুখের সামনে।