রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-চেতনার নেপথ্যে রয়েছে এক গভীর ভাববাদী জীবনদর্শন, সৃজনশীল শিল্পীসত্ত্বা আর বিজ্ঞানসানসিকতার মেলবন্ধন। তাঁর গানে বিজ্ঞান প্রসঙ্গ বরাবরই আমার কাছে আকর্ষণীয় আর বিস্ময়কর মনে হয়েছে। মহাবিশ্ব এবং বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে তাঁর ছিল অসীম কৌতূহল। বলা যায় রবীন্দ্রনাথের মনে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল তাঁর বালক বয়সেই, যখন তিনি গৃহশিক্ষদের কাছে পড়েছেন চারুপাঠ, পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবৃত্যান্ত। তাছাড়া প্রকৃতিবিজ্ঞান, মানবদেহের খুঁটিনাটি বিষয়েও ছিল তাঁর অসীম উৎসাহ। হিমালয় ভ্রমণের সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে আকাশের গ্রহনক্ষত্রের সঙ্গে যে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন, সেটাই সম্ভবত কিশোর রবির মনে বিজ্ঞানচেতনার বীজ বপন করেছিল। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর শিক্ষার মুখ্যবিষয় ছিল উপনিষদ ও বিজ্ঞান।

‘বালক’ পত্রিকায় ছোটদের উপযোগী করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, ভূ-বিদ্যা, প্রাকৃতিক ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার ভার ছিল রবীন্দ্রনাথের ওপর। তাই তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সেকথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।’

বিজ্ঞানের বিস্ময়কর রহস্য অনুসন্ধানের অদম্য আগ্রহ তাঁর সৃজনশীলতাকে দিয়েছে এক দুর্লভ প্রাণশক্তি, বিজ্ঞানের আবহে সম্পৃক্ত হয়েছে তাঁর রচনাসম্ভার। কবি অনুভব করেছিলেন যে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও গতিশীলতার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, তার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। অসীম শূন্যে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য-তারার সমাবেশ কাল থেকে কালান্তরে আবর্তিত হয়ে চলেছে নীরবে এক অদৃশ্য শক্তির ইশারায়। সেই অনুভূতিইই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনায়, কবিতায়, গানে। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথের অনেক গানই রচিত হয়েছে বিজ্ঞানের আলোকিত পটভূমিকার, যার প্রতিটি ছন্দ-বাক্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব। ‘মহাশূন্য থেকে বিশ্বসৃষ্টির রহস্য’, ‘বিগ ব্যাং এর মহা বিষ্ফোরণ’, ‘মহাজাগতিক বস্তুপিণ্ডের অজানা অনন্তের দিকে ধেয়ে চলা’, সবই কবির ভাবজগতে গভীর আলোড়ন তুলত, তাই তিনি সারাজীবন ফিরেছেন অসীমের সঙ্গে সীমার মিলনের খোঁজে। এসবের উত্তর তিনি খুঁজেছেন তাঁর গানে- ‘জানার মাঝে অজানার সন্ধানে’। তাই ‘রবীন্দ্রগানে বিজ্ঞান’ প্রসঙ্গটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক।

রবীন্দ্রনাথ কি সচেতনভাবে তাঁর সৃষ্টিতে বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্য রেখেছেন?
নিশ্চিতভাবে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে ‘বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্য’কে পরিবেশন করেছেন সচেতনভাবেই। প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, জগদীশচন্দ্র বসুর মত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। তাঁদের নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, গবেষণায় তাঁর অসীম আগ্রহের কথা জানা যায় সমকালীন নানা চিঠিপত্র আর প্রবন্ধাতিতে। আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আলোচিত হয়েছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে আপেক্ষিতাবাদের জটিল বিষয়গুলি। সৌরজগৎ, নক্ষত্রলোক, অনুপরমানু আর প্রকৃতির রহস্যলোকের সন্ধানে তাঁর অনুসন্ধিৎসার অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যের বিস্তৃণ প্রাঙ্গণে। তিনি সচেতনভাবেই লিখেছেন, ‘প্রথমদিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্ত্বার নূতন আবির্ভাবে – কে তুমি, মেলেনি উত্তর’ কিম্বা ‘বলাকা কবিতায়, ‘মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে, বলিতে না পারে স্পষ্ট করি, অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি’। এগুলি কবির ‘সৃষ্টিতত্ত্ব-জিজ্ঞাসা’র প্রেক্ষিতেই লেখা। আবার ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’, ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে, হে নটরাজ’, ‘আকাশভরা সূর্যতারা’, আলো আমার আলো ওগো ইত্যাদি গানগুলিতেও রয়েছে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিশ্বরহস্যের নানান ইঙ্গিত। তাঁর সাহিত্যে কবি নটরাজকে কল্পনা করেছেন বিশ্বচালিকাশক্তি হিসাবে। যা আদতে গ্রাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। তারই প্রভাবে গ্রহনক্ষত্র, সৌরজগৎ, নীহারিকামণ্ডলী নিজের নিজের কক্ষপথে সুশৃঙ্খলভাবে অনাদিকালধরে আবর্তিত হয়ে চলেছে। বিভিন্ন মাঘোৎসবের গান রচনার পিছনেও প্রচ্ছন্নভাবে তাঁর বৈজ্ঞানিক মানসিকতার আভাষ পাওয়া যায়। তাঁর জীবনদর্শন, উপনিষদীয় চিন্তাধারা, সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের আরশিতে যেভাবে দেখেছেন, তাইই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর গানে-কবিতার, কখনও সচেতন, কখনও প্রচ্ছন্ন, কখনও বা কালতালীয়ভাবে।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
6 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
কমলেন্দু
কমলেন্দু
8 months ago

খুব ভাল লাগল। গদ্যের এমন ভাবনার নিদর্শন পাই।
‘মাসিমা, আমার মনের স্বকীয় একটা স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি আছে, তারই গুণে আমার হৃদয়ের ভারী কথাগুলোও মুখে খুব হাল্কা হয়ে ভেসে ওঠে, তাই বলে তার ওজন কমে না।’

Dr Asis K Sinha
Dr Asis K Sinha
8 months ago

নতুন দৃষ্টিতে ও আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের মনসের সৃজনশীলতার প্রয়াস খুব মনোগ্রাহী হয়েছে। ডাঃ সরকারকে সাধুবাদ। প্রত্যয় রাখি ভবিষ্যতে আরো সুচিন্তিত ও সুগবেষিত উপস্থাপনায় ডাঃ সরকার আমাদের আরো ঋদ্ধ করবেন।

Sarmistha Sarkar
Sarmistha Sarkar
8 months ago

সমৃদ্ধ হলাম🙏

Sramana Saha
Sramana Saha
8 months ago

ঋদ্ধ হলাম ডাঃ পূর্ণেন্দু বিকাশ‌ সরকারের এই সুগবেষিত প্রবন্ধটি পড়ে।‌ রবীন্দ্রগানে বিজ্ঞান প্রসঙ্গ নিঃসন্দেহে একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়, এবং স্বল্প পরিসরের মধ্যে ডাঃ সরকারের সুচারু কলমে উপস্থাপিত তথ্যসমৃদ্ধ এই সুখপাঠ্য লেখাটি খুবই আনন্দ দিল। আগামীতে‌ এমন আরও লেখার অপেক্ষায় থাকব।

ANIRUDDHA DE
ANIRUDDHA DE
7 months ago
Reply to  Sramana Saha

অনেক কিছু জানলাম পূর্ণেন্দুদার লেখায়। এই চিত্তাকর্ষক, অথচ কম আলোচিত বিষয়ে আরো লেখার আশা রাখি।

Aniruddha Ghosh
Aniruddha Ghosh
7 months ago

আমরা ঋদ্ধ হলাম। আপনার লেখার পরিধি আমাদেরকে যারপরনাই আনন্দিত ও আশ্চর্যাম্বিত করে।