মেয়েদের চেহারার খুঁত ধরা যেমন আবহমান কাল থেকেই চলে আসছে ছেলেদের নিয়েও কিছু কম নয় কিন্তু। এখনও কারো কারো মুখ দিয়ে গোঁফদাড়ি না ওঠা ধবধবে ফর্সা ছেলে দেখলেই মুখ ফুটে খনার বচনও বেরিয়ে আসে বাপু।

“যদি দেখ মাকুন্দ চোপা / এক পাও না বাড়াও বাপা”।

শুধু তাই নয়। রূপ যেন মেয়েদের একবগগা সম্পত্তি। তাই কোনো ছেলে অতীব সুপুরুষ হয়ে ঠিকমত মানুষ হয়ে না দাঁড়ালে মানে অকর্মণ্য রূপবান পুরুষ কে এখনো ‘মাকাল ফল’ বলা হয়। ছেলে মানেই সময়মত তাকে উপার্জনক্ষম হতে হবে। নয়ত আর কেমন ছেলে? নির্গন্ধা ইব কিংশুকাঃ আর নয়ত মাকাল ফল যা ভেতরে কালো আর তেতো। কিন্তু তাই বলে তা তো আর সে অন্তঃসারশূন্য নয়। অত্যন্ত ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ,পরিবেশবান্ধব ডালিমের মত লাল টুকটুকে মহাকাল বা মাকাল ফলকে বিকৃত করে মাকাল যে কেন বলে তাও জানা নেই তবে নিষ্কম্মা, পুরুষকে মাকাল ফল বলার পেছনে রয়েছে ময়মনসিংহের এক লোকগাথা।
এক সুন্দরী গৃহবধূ রাতের অন্ধকারে শাশুড়িকে বিষ প্রয়োগে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওই বিষ তাকেও খেতে হয়। বিষক্রিয়ায় দুজনই মারা যায়। মৃত্যুুর আগে শাশুড়ি পুত্রবধূকে অভিশাপ দেয়। ওই অভিশাপেই গৃহবধূ মাকাল ফলে পরিণত হয়। যার বাইরের রূপই সুন্দর, কিন্তু ভেতরটা কালো। তাই বলে বাইরে সুন্দর আর ভেতরে নিষ্ফলা এমন ফলের সঙ্গে হ্যান্ডসাম ছেলের তুলনা? ওদিকে আবার দুই বাংলার পল্লী অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের উপাস্য এক জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা মাকালঠাকুর। মেলাতে পারিনি আমি।
আবার দেখুন ‘গেঁড়ে মদনা’ বিশেষণ প্রয়োগ? সেটিও তো সুন্দর পুরুষের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হয় কারণ পুরাণের কামের দেবতা মদনদেব ছিলেন অতীব সুদর্শন। তবে তিনি খুব গেঁড়ে বা বেঁটে ছিলেন কী না তা আমার জানা নেই।
আসলে সুদর্শন পুরুষ হওয়াটাও বেশ চাপের। যেন কুৎসিত নারীর মতই। ঈশ্বর যেন ছপ্পড় ফুঁড়ে শুধু নারীদেরই নিখুঁত রূপসী করবেন। তার মানে পুরুষ কালো হতেই পারে। কিন্তু তবুও দেশে পুরুষদের ফর্সা হওয়ার ক্রিমের বিজ্ঞাপনও বলবৎ থাকবে। এমনি হিপোক্রেসি সমাজের।


ছবি সৌজন্যঃ কুর্চি, ঋণ পিনাকী


আমরা মোটাকে মোটু, হোঁদলকুৎকুৎ, বেঢপ বা খোদার খাসি, বেঁটে কে নাটা বলেও যেমন সুখ পাই তেমনি খোঁড়া কে ল্যাঙ্গড়া, লম্বাকে লম্বু বা কেশশূন্য ব্যাক্তিকে টেকো বা টাকলু বলতেও ছাড়িনা। সেই আশঙ্কাতেই বুঝি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের পণ্যায়নে কেশবান পুরুষের চুলের জেল্লাও নজর কাড়ে।
যুবক ছেলের দাড়িগোঁফ ঠিকঠাক না উঠলে, বুকে পর্যাপ্ত লোম না গজালে, পেশীবহুল না হলে সে আর কেমন ছেলে? তার ছেলে, মেয়ে উভয় বন্ধুরা যেমন হাসাহাসি করে, তেমনি সমাজমাধ্যমে আজকের ভাষায় ট্রোলও করতেও ছাড়েনা। আর তৃতীয়লিঙ্গের পুরুষের মেয়েলি ভাব বা নারীর পুরুষালি ভাব নিয়ে তো আর কথাই নেই। এত লেখালেখি, বিজ্ঞানের কচকচানি, ঋতুপর্ণ, শিখণ্ডী চর্চার পরেও তারা যেন হাস্যস্পদ হয়েই রইল। আবারো বলি প্রবাদের ভাষায় “ভবি ভোলার নয়”।
তা মানুষের শরীর নিয়ে লজ্জা দিয়ে হয়ত কেউকেউ খুব আনন্দ পায়। কোনও ব্যক্তির শারীরিক অবস্থাকে উপহাস করে উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে লজ্জায় ফেলাই হয়ত তাদের কাজ। তার দেহ মেদবহুল হোক বা চিকন, সে লম্বা হোক বা বেঁটে, লোমশ বা লোমহীন, শরীরের আকৃতি, প্রকৃতি যেমনই হোক আমরা কে তার বিচার করার? আসলে সে কেমন মানুষ সেটাই তো দিনের শেষে বিচার্য তাই নয়? ঈশ্বরপ্রদত্ত দেহের মধ্যে জৈবরসের টানাপড়েন ঠিক কতটা হবে, ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন, টেস্টোস্টেরনের ভারসাম্যে সমতা কতটা এসব আমি আপনি নয় স্বয়ং যিনি দেহ বানিয়েছেন তাঁরই এক্তিয়ারে। তাই আর কতদিন চলবে এমন? বুড়ো ভামেদের থাকতে দিন না নিজের মত করে। ভাম নামক জন্তুটিও কিন্তু বড়ই কিউট, দেখেছেন আশাকরি। মিশকালো চোখগুলো কুতকুতে হলেও স্পারকলিং কিন্তু নক্ষত্রের মত। হাবেভাবে চুপচাপ, আপাতভাবে ঝিমনো জড়ভরত মার্কা হয়ে নিজের মত থাকলেও সে কিন্তু খুব চতুর।
আর পাশের বাড়ির দামড়া ছেলেটির নাহয় বয়স পেরিয়েছে চাকরীর। তাই বলে সেটা তো পুরোটাই তার দোষে নয়। তাই কথাগুলো প্রয়োগ করার আগে একটু ভেবে দেখুব প্লিজ।

[বডিশেমিং-১]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মে ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
5 months ago

আকর্ষণীয় লেখা। ভালো লাগলো।

সৌরভ
সৌরভ
4 months ago

প্রয়োজনীয় বিষয়।