কিশোরীবেলা থেকেই আমি সামান্য কোলকুঁজো। তা নিয়ে আমার পরিজন (প্রিয়জন?)দের মাথাব্যথার শেষ ছিল না। এখনো নেই। মধ্যপঞ্চাশ ছাড়িয়েও নিস্তার নেই। কেউ আবার ধামাচাপা দিতে কোলকুঁজো কে লক্ষ্মীমন্তও বলে হালকা করতেন। আসলে এটি কিশোরীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকশিত হবার সময়েই শুধরে দেবার চেষ্টা করেছিলেন মা। কিন্তু সেই মা’ই যে আবার তখন ফ্রকের সামনে ফ্রিল লাগিয়ে বুঝিয়ে দিতেন প্রতি মুহূর্তে যে “তুমি বড় হয়েছ”। আমাকে যেমন গড়েছেন তিনি তেমনি হয়েছে। শিরদাঁড়ায় গলদ থেকেই গেছে।বয়সানুপাতে একটু বেশিই দীর্ঘাঙ্গী ছিলাম যে। সেইসঙ্গে খুব রোগা। (ভাগ্যিস কেউ ধুচুনির সঙ্গে তুলনা দেয়নি) জানেন তো? রান্নাঘরের একধরণের বিশেষ ঝুড়ি ‘ধুচুনি’ও কিন্তু খুব কাজে আসে চাল ধোয়ার জন্য বা চুনোচানা মাছ ধরতে। তা তৈরী হয় সরু সরু বাঁশ বা বেতের শলাকা দিয়ে।
তা যা বলছিলাম লম্বা মেয়ে বুক চিতিয়ে ছেলেদের মত হাঁটবে তখনও তো তারা বলবে মেয়ে-মদ্দা ( মরদ>মদ্দ>মদ্দা)। তারা আবার ভুলে গেছিলেন স্বয়ং মা দুর্গার মর্দানির কেরামতিতে পুরুষ বধের কথা। তাই বুক চিতিয়ে হাঁটতে শিখিনি। সেখানেও জ্বালা যে।
এই সেদিন এক বন্ধু বলছিল। তার দাঁত সামান্য উঁচু থাকায় মাড়ি বেরিয়ে আসত। তাকে তার আত্মীয় শীতকালে দাঁত বের করে হাসলেই বলতেন “মুখ বন্ধ কর নয়ত দাঁতে ঠাণ্ডা লেগে যাবে”। ছোটবেলায় রোগা ছিলাম বলে আর দাঁত সামান্য উঁচু থাকায় আমাকেও খেপিয়ে “মাড়ি” বলতেও ছাড়েনি লোকজন। তাই আগে আগে হাঁটলে পেছন থেকে “কুঁজো” আর “মাড়ি” এ দুই বিভূষণ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। i can forgive but not forget.
তারপর তো নতুন বৌ দেখে এসে অন্দরমহলের মেয়েদের সে বউয়ের চোখ-চর্চায় সরব হওয়া। সে বেড়ালচোখো কারণ চোখের মণি নীলচে, তার চিনেদের মত নরুণচেরা চোখ…আমার চোখ নিয়ে কেউ আদিখ্যেতা শুরু করলেই রঙ নিয়ে শুনতে হত পাছে চোখের জন্য বিখ্যাত হয়ে যাই। এসব শুনে শুনে হদ্দ আমি। কারণ আমার আশেপাশে তখন সবাই ডাকসাইটে সুন্দরী।

ভাগ্যিস আমার নয় কিন্তু যে নারীর কপালের মধ্যভাগ ঢিবির মত উঁচু হত তা নাকি সৌন্দর্যের পক্ষে হানিকর…সে যুগে এমনটাই ভাবা হত। আগেকার দিনে বডিশেমিং নিয়ে কারোর মাথাব্যাথা ছিল না। বিশেষতঃ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের দাবিয়ে রাখতে তার চেহারায় সামান্যতম খুঁত পেলেই কেউ ছেড়ে কথা কইত না। বরং তার সেই সামান্য দৈহিক খুঁত নিয়ে ঢাক পিটিয়ে তাকে আড়ালে রাখা ছিল সমাজের মূলমন্ত্র। তাই বুঝি ‘উটকপালী’, উৎকপালী বা উঁচকপালী বলে সেই মেয়ে অলক্ষণা কারণ তার উঁচু কপাল।

ছবিঃ ডা. গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

সে কুদর্শনা তাই দুর্ভাগা বলে বিশ্বাস লোকের। এসব বাগধারা লোপ পেয়েছে যুগে যুগে আর উটকপালী মেয়ে জয় করে নিয়েছে নিজের ভাগ্য নিজেই। তাই বুঝি এ বাগধারা সচারচর ভদ্র পরিবেশে ব্যবহৃত হয়না আর।

আবার বড়বড়, খোঁচা খোঁচা দাঁতের অধিকারিণী কে সমাজের মাথারা ‘চিরুণদাঁতি’ বা যার দাঁত চিরুণির মত ফাঁকফাঁক… তা বলতেও ছাড়তেন না। বিয়ের পাত্রী দেখতে গিয়ে সে মেয়ে সুলক্ষ্মণা কী না তা তার শাড়ি গোড়ালির ওপর তুলে প্রত্যক্ষ করেই বিচার্য হত কারণ পায়ের পাতায় যদি আর্চ না থাকে তাহলে সে তো ‘খড়মপেয়ে’। তার নাকি প্রবল বৈধব্য যোগ তাই সে অলুক্ষুণে।

কিশোরী মেয়ের সামনের দিক সামান্য ফুলে উঠলেই যাদের অবিরাম নজর সেদিকে… তা সে ঘরের মেয়েই হোক বা পরের সেই মেয়ের যৌবনে বুক আয়তনে ও পরিধিতে ঠিকঠাক মত সুডৌল না হলে পুরুষের যেন ভাত হজম হয়না। আর ছেলেদেরই বা দোষ দিই কেন বারেবারে মেয়েরাও তো সেই মেয়েটিকে দেখে “ও তো ছেলে” বা “দেখ, দেখ ওর তো কিস্যুই নেই” কিম্বা অন্তর্বাসের সাইজ নিয়েও তারা যথেষ্ট হাসাহাসি করতেও ছাড়েনা…এসব নিজের কলেজ জীবনেই দেখা।

তা এইসব বডিশেমিং নিয়ে পরিহাস, উপহাস আর কদ্দিন চলবে? মনোবিদের চেম্বারে “পারসোনালিটি ডিঅর্ডার” নামক মানসিক রোগের স্বীকার তো এ প্রজন্মেও শুনছি। কী লাভ ঈশ্বরপ্রদত্ত চেহারার খুঁত নিয়ে, আঘাত দিয়ে মন্তব্য করে? অন্যে কষ্ট পেলে আপনার আনন্দ বুঝি কিন্তু আপনি কিন্তু এ যুগে বেমানান। তা যতই শ্যামবর্ণা মা কালীর পুজো করুন না কেন।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, এপ্রিল ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়
6 months ago

একেবারে ছোটবেলা থেকে এই দেখার চোখ তৈরি করে দেয় সমাজ । বড় হয়ে ভাবতে শেখে, এমন মানুষ সংখ্যায় কম । ভালো লাগলো লেখাটা ।

Dr Dipak Banerjee
Dr Dipak Banerjee
6 months ago

সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো!
বলিষ্ঠ লেখা! অভিনন্দন।

শিশির দাশগুপ্ত
শিশির দাশগুপ্ত
6 months ago

দুর্দান্ত লেখা। চমৎকার এক্সপ্রেশন।