বইয়ের মলাটের ওপর যে নাম লেখা, পরম মমতায় তার ওপর হাত বোলায় মেয়েটি। কত বয়স হবে? ৩৪ /৩৫। এবারের বইমেলায় ওর প্রথম বই বেরিয়েছে। চোখের জলে অক্ষর ঝাপসা, পাতা উল্টিয়ে দেখে চেনা শব্দগুলো গা ঘেঁসে পাশাপাশি বসে আছে। চোখ বুজে আসে আনন্দে, নিজের সৃষ্টিকে ছোঁয়ার আবেশে। কত দিন, কত রাত জেগে লিখেছে সে এই শব্দগুলো। আজ ছাপার কালো অক্ষরে তারাও চেয়ে আছে ওর দিকে। এখনও সে বিক্রির হিসাব নিকাশ বোঝে না। বইমেলায় বই বেরিয়েছে এটাই তার জীবনের প্রাপ্তি।

মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে যে ভদ্রলোক বইয়ের পাতা উল্টে দেখছেন, তাঁর এবারের বইমেলায় দশম কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর আবেগ সংযত কিন্তু বইয়ের পাতা ওল্টানোর সময় বুকের ধুকপুকানি সেই প্রথমবারের মত দ্রুত এবারও।
বড় চেনা দৃশ্য নয় কি?
এই স্বর্গীয় দৃশ্য ঘুরে ফিরে কম বেশি আমরা দেখি যেখানে, সেটাই আমাদের বইমেলায়। যে লেখকের সাহিত্যসমৃদ্ধ জীবনে ত্রিশটি বা তারও বেশি বই বেরিয়ে গেছে তিনিও বইমেলায় এসে তাঁর নবতম উপন্যাসটি দেখে সেই প্রথমদিনের মতই খুশি হন। হাতে নিয়ে দেখেন। প্রচ্ছদের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
সৃষ্টি এমনই। সৃষ্টির ভেতরে যে নিরলস পরিশ্রম, প্রয়াস, কল্পনা, অতৃপ্তি থাকে তাই দিয়ে তৈরি হয় উত্তম এক সাহিত্য। সাহিত্যিকের কলমে লুকিয়ে থাকে সেই ব্রহ্মাস্ত্র যাকে রাষ্ট্রশক্তি পর্যন্ত ভয় পান। অসির চেয়ে চিরকাল মসির জোর বেশি। এই সত্য থেকে মুক্তি নেই কারোর। সাহিত্যিকের নিজেরও নয় হয়তো। নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এই সাধনা সাহিত্যেই বড্ড বেশি । তাই বুঝি , সাহিত্য মানুষের এত প্রিয় ।

যিনি লেখেন, তিনি চান তাঁর বই যেন বইমেলায় প্রকাশিত হয়। যিনি পড়েন তিনি চান নতুন পুরোনো বই বেছে কিনতে। যিনি ছাপেন তিনি চান তাঁর প্রকাশনা থেকে আরও বই বেরোক। প্রকাশক হিসেবে মানুষ চিনুক তাঁকে, তাঁর সংস্থাকে।
বইমেলা আমাদের সবার স্বপ্নপূরণের জায়গা। লেখক পাঠক প্রকাশক , এই ত্রিবেণী সঙ্গম এখানে পরস্পরকে ছুঁয়ে রাখে নিবিড় ভাবে। এই অক্ষর ভুবনে এক মায়া তৈরি হয়। এক ঘোর লাগা মায়া।
কত মানুষ তাঁর স্বপ্নের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন এই বিশাল প্রাঙ্গণে । কিন্তু সেই সব সার্থক হয় , যখন কোনো উৎসাহী পাঠক বই হাতে নিয়ে নাড়েন চাড়েন কেনেন। বইয়ের তাক থেকে সেই বই চলে যায় পাঠকের সঙ্গে। পাঠকের পরিতৃপ্তি তো একজন লেখকের সৃষ্টির সার্থকতা, এটাই ধ্রুব সত্য।

বইমেলা আমাদের অন্যতম আবেগের নাম, অন্যতম উৎসবের নাম। আমরা এই উৎসবকে নিজেরা তৈরি করেছি, নিজেরা গড়েছি আর নিজেরাই এর এক একটা অংশ হয়েছি। সারাটা বছর আমরা অপেক্ষা করি এই উৎসবের। সেই যে সুমন বলেছিলেন

“তোমাকে দেখছি কফি হাউসের কাছে
তোমাকে দেখছি খুঁজছ পুরনো বই পুরনো কিম্বা নতুন মলাটে
আমি আসলে কিন্তু তোমাকে খুঁজবই।

তোমাকে দেখছি বই মেলা চত্বরে
তোমাকে দেখছি স্বতন্ত্রর স্টল অনুষ্টুপের ঠেলাঠেলি ভেদ করে….”

বইমেলার দিনগুলোয় সত্যি অনায়াসে খুঁজে পাবেন অর্ধেকের বেশি শহরকে এই প্রাঙ্গণে। ব্যস্ত কল্লোলিনী বা তার আশেপাশের মফঃস্বল যেন এখানে এসে থমকে যায় এই কয়েকদিন। হাজারও কাজের ফাঁকে মাথায় ঘোরে বইমেলা যেতে হবে।কারণ, বইয়ের এমনই টান, এমনই আকর্ষণ। অফিসের কাজ সেরে, স্কুল কলেজ শেষ করে, সংসারের কাজ সামলে ঠিক সময় বের করে মানুষ হাজির হন মেলা চত্বরে। ভিড়ে ঠাসা মানুষকে অগ্রাহ্য করে হাতে তুলে নেন নিজের পছন্দের বই।

আমিও সেই কোন ছোটবেলা থেকে বাবা মায়ের হাত ধরে এই বইয়ের জগতে এসেছি। তখন
অবাক হয়ে দেখতাম চারপাশের বইগুলো। ছোটবেলায় বাবা রাশিয়ান বুক স্টলে নিয়ে যেতেন। কী সুন্দর সেই পাতাগুলো, আর তেমনই সব গল্প। বাকি আরো স্টল ঘুরে ঘুরে বই কেনা হত। তখন বইমেলা হত ময়দানে। বাড়ি ফিরে ছোটদের রামায়ণ মহাভারত বা উপেন্দ্র কিশোর রচনাবলী কিংবা ফেলুদা সিরিজ বের করে মাথার কাছে নিয়ে শুতাম। আমার বই, এই আমার ছোট জীবনের সম্পদ তখন। সারাদিন উল্টে পাল্টে দেখছি, পড়ছি। পড়া শেষ হলে অপেক্ষা করছি আবার পরের বছর মেলায় যাওয়ার।

এখন বইমেলায় গিয়ে স্টলের পর স্টল ঘুরি ,ছুঁয়ে যায় হাত, মনে হয় এ এক অপার্থিব দুনিয়া, যেখানে শব্দেরা বাঁধা পড়েছে। অনুভব আর আবেগ মিশে গেছে কালো অক্ষরে। স্বপ্ন আর কল্পনা মিশে হাজার হাজার গল্প ,উপন্যাস, নাটক , প্রবন্ধ তৈরি হয়েছে। ছন্দের মিলমিশে কবিরা প্রেম বিরহ বিদ্রোহের গাথা গেয়েছেন ,আর তারপর দুই মলাটে তারা ধরা দিয়েছে এই বিরাট বিপুল মেলা প্রাঙ্গণে।
এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেখে তার ঐতিহ্য বহন করার ধারাবাহিকতা। আমিও আমার সন্তানকে নিয়ে আসি। সেও আমার মত বই চেনে। বই জানে। বই কেনে। এই পরম্পরা সমানে চলছে। আর চলবেও। এও আমাদের সমাজের কাছে একপ্রকার দায়বদ্ধতা।

মনে পড়ে , কলেজ থেকে বেরিয়ে কতদিন ময়দানের বইমেলাতে গেছি। ছুঁয়ে দেখেছি প্রিয় লেখক বা কবির বই । তখন সোশ্যাল মিডিয়া না থাকায় সাহিত্যিকদের সেইভাবে আমরা চিনতাম না। বড় প্রকাশনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে অবাক হয়ে দেখতাম তাঁদের। এরাই লেখেন কালজয়ী উপন্যাস, প্রেমের গল্প, চোখে জল আনা কবিতা? লেখেন দেশভাগের পালাবদল? শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়েছে কতবার।
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ময়দান থেকে বইমেলা মিলন মেলা প্রাঙ্গণ পেরিয়ে এখন লবণ হ্রদের করুণাময়ীতে।
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা শুরু হয়েছে ১৯৭৬ সাল থেকে। ক্রমে ক্রমে তার পরিধি বেড়েছে। বিস্তার বেড়েছে। প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে। খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের পাশাপাশি নতুন লেখক, নতুন কবি এসেছেন। পাঠক বেড়েছে। আজকের প্রজন্ম বই পড়ে না, এই ভুল ভেঙে গেছে স্টলে স্টলে ভিড় দেখে। যে যেমন ধারার, যেমন ভাষার বই পড়েন, জানবেন আসলে তারা আদতে সাহিত্য পড়েন।

বইমেলা সত্যি এক মিলন মেলা । দলবেঁধে পরিবার বন্ধুদের সঙ্গে মানুষ আসেন। বই কেনেন , বই দেখেন। পরিচিত হন সাহিত্যিকদের সঙ্গে। একজন নতুন লেখক পরিণত হন। তাঁর বই বিক্রি তাঁকে উৎসাহ দেয় নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠতে। পাঠক খোঁজেন নিজের পছন্দের বই। বিভিন্ন মানুষ, তাঁদের ভিন্ন পছন্দ। তাঁরা আসেন দেখেন কেনেন।
শুধু সাহিত্যকে ভালোবেসে মেলার এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়ান মানুষ। হাতের ঝোলায়, কাঁধের ব্যাগে ঠেসে রাখেন বই।
কেউ বড় অঙ্কের বই কিনে ব্যাগ ভরেন আবার কোথাও কোনও কলেজ পড়ুয়া দুটি একটি বইয়ের সঙ্গে বইয়ের ক্যাটালগ নিয়ে নিজের স্বপ্ন গোছায় । সাধ্য আর সামর্থ্যের সঙ্গে ব্যালান্স করে নিজের মতো। এই পরিমিতি বোধও আমাদের জীবন দর্শন শেখায়।

ভিড়ের মাঝে দেখা হয় কত পরিচিত মানুষের সঙ্গে। আপনার আমার মত তিনিও এসেছেন বইয়ের মেলায়। আমার পছন্দের বন্ধুটিও বই ভালোবাসেন, এ এক আত্মতৃপ্তি আমাদের। আমরা সবসময় সমমনস্ক মানুষকে বন্ধুবৃত্তে রাখি, তাই না!

খেয়াল করে দেখবেন, মেলার একধারে দল বেঁধে সারিবদ্ধ থাকে খাবারের স্টল। মেলা ঘুরে ক্লান্ত মানুষ এসে বসেন , খান। জটলা করে গল্প করেন । কার ঝুলিতে কোন বই রয়েছে, কে কোনটা কিনেছেন বা কেনেননি তাই নিয়ে আলোচনা চলে। স্মৃতিতে রাখতে চলে সেলফি নেওয়া। এদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কান পেতে শুনবেন বইয়ের নাম। স্টলের নাম। লেখকের লেখার ধারা নিয়ে আলোচনা। কে বলতে পারে, সন্ধান মিলতে পারে আরও কয়েকটি ভালো বইয়ের।

কত অতৃপ্ত মুখ দেখবেন, দূরত্বের কারণে হয়তো পছন্দের সব বই কিনে উঠতে পারেননি। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে বলছেন, কলেজ স্ট্রিট গিয়ে বাকি বইগুলো নিয়ে নেব’ খন।
শুধু বইয়ের টানে প্রতি বছর বারবার বইমেলায় ফেরেন মানুষ। জমানো টাকা খরচ করেন বইয়ের জন্য। বাড়ি ফিরে বই বের করে হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নেন। নতুন বইয়ের সেই গন্ধ, যার কাছে দেশী বিদেশী পারফিউম হার মানবে।
বইমেলা আমাদের উজাড় করে দেয় বই, আমরা দুহাত ভরে নিয়ে আসি সেইসব মনিমানিক্য। এখানেই বইমেলার সাফল্য। এখানেই বই কেনার আনন্দ।
আমরা জানি দেশে বিদেশে অনেক বইমেলা হয়। কিন্তু কলকাতার বইমেলার মত এমন প্রাণের টান বুঝি আর কোথাও নেই।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Sumit Lal Chowdhury
Sumit Lal Chowdhury
7 months ago

বইমেলাকে আপনার কলমের সৌজন্যে আরেকবার স্নিগ্ধ আলোয় দেখলাম, অনুভব করলাম। স্মৃতিচারণ আপনার হাতে অমর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভালোলাগা, শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা রাখলাম রচনাটির পাশে।