‘আমরা কাহিনীমাত্র। আমাদের দগ্ধ করা যায়, কিন্তু ধ্বংস করা যায় না।’
বইমেলা একেবারে জমে গিয়েছে।লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের গমগমে উপস্থিতির ফাঁকে রয়ে গিয়েছে কিছু মুখচোরা বইও। তাদের কথা বলতে ইচ্ছে হয়। দিবাকর ভট্টাচার্য তেমনই এক নিভৃতচারী লেখক। তাঁর প্রয়াণ হয়েছে দুদশক আগে। কিন্তু লেখক মৃত হননি। বরং তাঁর জন্মই হয়েছে মৃত্যুর পরে! আসলে দিবাকর তাঁর পরিবারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সমস্ত পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার জন্য। ভাগ্যিস, পুত্র রঞ্জন তা করেননি। বাবার লেখা নষ্ট না করে সেই পাণ্ডুলিপিগুলি থেকেই বেছে বেছে তিনি তৈরি করেন নতুন পাণ্ডুলিপি।

অনলাইনে সংগ্রহ করতে, ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন


নবারুণ ভট্টাচার্যই প্রথম লেখক দিবাকরকে ছড়িয়ে দেন মনস্বী পাঠকের মাঝে। ভাষাবন্ধন থেকে বেরিয়েছিল ‘চরাচরসারে’। অবশ্য এর আগেও আরেকটি প্রকাশনী একটি ছোট্ট বই প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই বইটি সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছয়নি। কিন্তু ‘চরাচরসারে’ মুগ্ধ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আবুল বাশার, চিন্ময় গুহর মতো সারস্বত ব্যক্তিত্বদের! বাংলা সাহিত্যের আকাশে সাদা বিদ্যুৎরেখার মতো ঝলসে উঠলেন দিবাকর। যিনি সাদা কাগজে কলমের স্পর্শে তৈরি করেছেন আপন ভুবন। যে ভুবন কখনও সম্পূর্ণ মৌলিক, কখনও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের স্পর্শে তৈরি করেছেন এক নতুনতর আখ্যান।
এবারের বইমেলাতেও তিনি উপস্থিত তাঁর নতুন বই নিয়ে। পরম্পরা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘চার আখ্যায়িকা’। সদ্যই হাতে পেয়েছি। পড়েও ফেলেছি। আর তারপর… বলা যায় স্তব্ধবাক হয়ে গিয়েছি। এ বই নিছকই চারটি আখ্যানের সংকলন মাত্র নয়। অতীত ভারতবর্ষের চার অসামান্য মানুষ গুণাঢ্য, বিলহণ, ভর্তৃহরি, বাণভট্টের কাহিনি লিখেছেন দিবাকর। কিন্তু তাঁরা সেই অর্থে প্রোটাগনিস্ট নন। এই বইয়ের চারটি আখ্যানের নাম ‘কাহিনীমাত্র’, ‘কবিতামাত্র’, ‘শব্দমাত্র’ ও ‘অক্ষরমাত্র’। হ্যাঁ, তারাই এই চার আখ্যানের মুখাবয়ব৷ এমন অভিনব আইডিয়া! এবং তাদের অসামান্য প্রকাশ৷
লেখক নিজেই নিজের লেখার উপরে তৈরি করে গিয়েছিলেন কুয়াশা। এমন কুয়াশা, যা একসময় ফাইল খেত সব কাহিনি, বাক্য, অক্ষরকেই। কিন্তু পুত্রের আনা রোদে ফের ঝলসে উঠছে ট্রাঙ্কবন্দি লেখারা। এই অসামান্য গদ্যপ্রয়াস কি হাতে নিয়ে দেখবেন পাঠক?
ইতিমধ্যেই দিবাকরের বাকি বইগুলি সমাদৃত হয়েছে। তাঁর লেখা যাঁরাই একবার পড়েছেন, খোঁজ করেছেন পরের বইয়ের। যাঁরা পড়েননি, তাঁদের বলি, একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। এই অদ্ভুত সময়ে, আলোছায়ার জীবনের ভিতরে দিবাকর ভট্টাচার্য আসলে অনতিক্রম্য এক লেখকের নাম। তাঁর লেখা থেকে যাবে। আমাদের মতো সামান্য কলমচির কাছে তিনি এক দুর্দম লাইটহাউস। লেখার প্রেরণা দেন, ভাবতে শেখান, ‘এভাবেও ভাবা যায়?’

[পরম্পরা ওয়েবজিন, মার্চ ২৪, সূচিপত্র]