১৩
আমি তো এমনি এমনিই বলি


চলুন একটু ঝগড়া করা যাক। এ কী কান্ড, পূর্ব কথনে এমন মধুরেণ সমাপনের পরে আবার ঝগড়া কেন!তবে বলি ঝগড়া তেমন তেমন হইলে ভাব টাব সব আলুনি মনে হয়।আয়না দেখে অমন ঝগড়া করিতে করিতে আমার পরিচালক হইতে সাধ হইয়াছিল একবার।কিন্তু লাও তো বটে আনে কে।পয়সা কোন দে গা? ঢাল নাই তরোয়াল নাই।তাহার উপর প্রধান সমস্যা হইলো এই যে আমার ঝগড়া, ভাব,লড়াই সবেতেই ভূমিকা এতো দীর্ঘ হইয়া ওঠে যে পর্দা উঠিবার কালে আমি ঘুমাইয়া পড়ি।সেই কতকাল পূর্বে আমার দাদামশাই একবার মৃত সৈনিকের পার্ট করিয়াছিলেন,সেইরূপ।ঝগড়া বাধাইবার কালে ভুলিয়াই গেলাম ঠিক কী লইয়া ঝগড়া বাধাইবো ভাবিয়াছিলাম।নেহাত ওই মানুষ অপার ভালোবাসিয়া আমার ভূমিকাকেই রাবড়ি ভাবিয়া খাইয়া লহেন বলিয়া আমার কিঞ্চিৎ যা খুশি তাই করিবার সুযোগ মিলিয়া যায়।
তবে সৌভাগ্য এই যে আজ আমি ঝগড়ার বিষয়বস্তু ভুলি নাই। ধরুন আপনাকে কেহ বলিল আপনি ঠিক আগের মতোই আছেন এখনো। ইহাতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হইবে সহজেই অনুমান করা যায়।বোধকরি খুবই পুলকিত হইবেন।কিন্তু আমার এক আত্মীয় বলিতেন কোন সদ্যোজাত শিশুকে দেখিয়া কেহ যদি বলেন সে ঠিক আপনার মতো দেখিতে,জানিবেন সে আপনাকে টিকটিকিইর মতো দেখিতে বলিলো।লাল পীতাভ কুঞ্চিত চর্ম কুতকুতে চোখের এত্তোটুকু ওই বস্তুটিকে চিৎপটাং হইয়া পড়িয়া থাকা টিকটিকির সঙ্গে স্বচ্ছন্দে তুলনা করা যাই।ভাবিয়া দেখিবেন কথাটায় খুব একটা মিথ্যা নাই। সেইরূপ আপনি যে স্তুতি শুনিয়া পুলকিত হইলেন তাহা আসলেই আপনার পরশির অতি কায়দায় স্মরণ করাইয়া দেবার আছিলা মাত্র আপনার মেঘে মেঘে বেলা গড়াইয়াছে অনেক। আপনাকে চমৎকার লাগিতেছে বা বেশ লাগিতেছে
তো! এই বাক্যই একজন মানুষের প্রশংসার পক্ষে যথেষ্ট।
ফিল্টার জল পরিশুদ্ধ করিবার নিমিত্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই যে মানুষ ছিল রুমাল হইলো বিড়াল করিবার পদ্ধতি আবিষ্কার হইয়াছে তাহাতেও মানুষের মনে এক বিভ্রান্তি তৈরি হয় বলিয়া আমার মনে হয়।যদিও কখনো চিকিৎসার প্রয়োজনে তাহা ব্যবহার করা হইলে কিছুটা গ্রহণযোগ্য বলিয়া মানিতেই হয়। কিন্তু মানুষের নিজস্ব যা কিছু বিলুপ্ত হইলে কোনো নিবারণ পন্ডিতই আর কিছু বাঁচাইতে পারিবে না একথা বিলক্ষণ স্মরণে রাখা উচিৎ। তবে হ্যাঁ এই সকল কল্পনা আর কারিকুরি অপূর্ব হইয়া উঠিতে পারে তখুনি যখন সেই স্বপ্নের বীজে ফলে সত্যিকারের ধান। মনের জরা মুক্তি ঘটিলে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের আর প্রয়োজনই পড়ে না। এতো যে গুনলো মানুষ এক দুই তিন সেই তো কুড়ির পরে রিপিট। বড়োজোর সব্যসাচী হইলে চল্লিশ। তারপর একে না ফিরিয়া উপায়ই নাই।ইহার বাহিরে যাহারা আজ পর্যন্ত যা কিছু হিসাবে নিকাশ করিয়াছেন তাহারা হয় ডাঁহা মুর্খ না হইলে অসম্ভব রকমের পন্ডিত। কারণ সেখানেও পরিধিতে গিয়ে ঠোকাঠুকি বাধা ছাড়া গোত্রান্তর নাই। এইসব কথা কত্ত পুরনো তবু একদম নতুন। কেউ বললেই না কথাটা ঠিক আগের মতোই সুন্দর। সুন্দর স্থির।নিশ্চল।তার স্থির থাকাটাই সমস্ত গতির নিয়ন্ত্রক।ওই পন্ডিতেরা তার কী যেন সব নাম টাম দেন।ওসব নাম না জানলেই বা কী!!


১৪
বিজয়া দশমী


রামচন্দ্র চোদ্দবছর বনবাসে কাটাইয়াছিলেন।আমার তাহা কবে যে অতিক্রম হইয়া গিয়াছে টেরও পাই নাই। সিনেমা খুব একটা দেখি না।ওয়েবসিরিজ টিরিজও না।বাংলা সিরিয়াল তো প্রশ্নই ওঠে না।তবে যাহা এতো মানুষকে আনন্দ দেয় তাহা ফেলিয়া দেবার নয়।প্রশ্ন এইটুকুই সম্প্রতি আমার ফোনে আসিয়া পড়া দুএকটি বাংলা বা হিন্দি ছবি দেখিতে গিয়া দেখিলাম সেই এক নারী নির্যাতন আর প্যানপেনে ফ্যামিলি ড্রামা।মেয়েরা উঠিয়া হাঁপাইয়ে হাঁপাইয়া সবাইকে ঘুম হইতে ডাকিয়া তুলিতেছে আর খাবার পরিবেশন করিতেছে।সবচেয়ে খারাপ লাগিল এই দেখিয়া ট্রাডিশন আমার পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত ধাবিত হইয়াছে।সরকারি চাকুরির স্বাভাবিক বয়স ধরিলে আমার অবসর গ্রহণের এখনো অনেক দিন বাকি।অতএব আমার পরবর্তী প্রজন্মের দম্পতিরা খুবই নব দম্পতি ধরা যায়।তাহা হইলে আজও সেই একই স্ক্রিপ্ট কি করিয়া মানুষ গিলিতেছেন? মানসিকতার পরিবর্তন কিছু কি ঘটে নাই? সব উত্তরাধিকার তো বহন করিবার নয়।সর্বপরি আমার চারপাশে চক্ষু উন্মিলন করিয়া আমি তাহা প্রত্যক্ষও করি না।আর ছবি তৈরি যাহারা করেন তাহারা বিখ্যাত সব ছবি টবি দেখেন নাই তাহা তো হইতে পারে না।আধুনিকতার মানে ঠিক কি,তাহা কী ভাবে বলিতে হয় তাহা তো তাহাদের অজানা নয়।সমাজ মাধ্যমে এইসব লইয়া অনেকে বিস্তর কথা বলিয়াছেন তবু অবস্থার পরিবর্তন হইলো না কী প্রকারে! বিশেষ করিয়া এখন যখন একটি ছবি যেকোনো প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় এবং সক্কলের কাছে পৌঁছয় তখন তাহা ব্যক্তির মানসিক বিকাশে একটি মুখ্য ভূমিকা নেয়।তাহারপরও আমরা যদি ওই এক চর্বিত চর্বন গিলাইতে থাকি তবে তাহারাও জাবরকাটা ভিন্ন অন্য কোনো কাজ করিবে না। ধর্মগ্রন্থ হিসাবে আমরা যেগুলো পাঠ করিয়া থাকি তাহাও কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাহিত্য হিসাবে অতি উচ্চমানের।সাধারণ মানুষের রুচিকে আন্ডারেস্টিমেট করার কোনো যুক্তিই নাই।তবে হ্যাঁ যতদিন তাহাদের সামনে তরল বিকল্পপথ খোলা থাকিবে ততদিন মানুষ তাহাই গ্রহণ করিবেন।মানুষের স্বভাব ধর্মও আসলে তাহাই। এখনো যদি জানিয়া লইতে হয় মেয়েরা বাড়ির বাহিরে পা ফেলিলেই ওঁৎ পাতিয়া আছে বিপদ, তবে কীভাবেই বা তাহারা সরকারি চাকুরির ঘেরাটোপের বাহিরে নিজেদের লইয়া আর ভাবিতে সাহস করিবেন। বিশেষ করিয়া যাহাদের মফস্বলের মধ্যবিত্ত তকমা সাঁটিয়া আছে দুই ডানা জুড়িয়া!

১৫
কিছু কথা..ঠিক কেন

এক লেখা আর এক লেখার জন্ম দেয়,এরচেয়ে সত্যি আর কিছু নাই।তাইবলিয়া অনুকরণ আর অনুসরণ এক জিনিস নহে।একটু রকি ভাষায় বলিলে যাহাকে ‘ঝেঁপে দেওয়া’ বলে।সে যাক।আজ একটা অন্য প্রসঙ্গে দুচার কথা বলি।বড় কাগজ, ছোট কাগজ, মেজ কাগজ, ন কাগজ, সে একান্নবর্তী পরিবার আর কই।সব কাগজই পাততাড়ি গুটাইয়াছে প্রায়।বা টিমটিম করিয়া এখনো জ্বলিতেছে কাহারো ঘরে শিবরাত্রির সলিতার মতো। না, পড়া কমেনি মানুষের। বরং বাড়িয়াছে।এখন সবসময়ই কিছুনা কিছু পড়ে মানুষ। কিন্তু ওই এতো তুলো পিঁজিবে কে এর মতো লোকে পড়ে আর ভুলিয়া যায়।সারা পৃথিবীতে কতনা লেখা হইতেছে।বা হইয়াছে।কে আর কতটুকু পড়িতেছে।আর যদিবা পড়িতেছে মনেই বা রাখিতেছে ক’জন!
আজ একটু আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি।ভাবিয়াছিলাম সব কথা বলা হইয়া গেলে লিখিবার থাকিবে কি,কিন্তু এখন ভাবি যুগোপযোগী না হইয়া করিবই বা কী!আমি যাহা ভাবিতেছি তৎক্ষনাৎ তাহা মাটিতে পড়িবার আগেই লোকে ক্যাচ লুফিয়া লইতেছেন। মানে ধরা যাইতে পারে কড়াই হইতে কাঁচা তুলিয়াই পাতে ঢালিয়া দেবার মতো হইতেছে।এমনি করিয়া বহু নাম,বহু বিষয় আমি তুম দেখতে রহোর মতো ভাবিতেই থাকিয়াছি আর দেখিয়াছি তাহা আমারই পরিচিত কেউ অলরেডি লিখিয়া ফেলিয়াছে। তবে নিজের কথা বলিবার সুবিধা এই তাহা কখনো অন্যের কথা হয় না।কিন্তু কথা তো সাহিত্য নয়।তাহা পরিপাকের জন্য সময় প্রয়োজন।
হ্যাঁ যে কথা বলিতেছিলাম,সমাজ মাধ্যমে এখনো মাঝে মাঝে এতো চর্বিত চর্বন বিষয় উত্থাপিত হয়,আজ দেখিলাম আলোচনা হইতেছে ছোট কাগজেও এমন লেখা একএকটি লেখা হয় যে মাথা নত করিয়া থাকিবার মতো। আজ এতোদিন পরে এতোবার প্রমানিত এই কথা বলা মানে ডিসেম্বর মাসেও মাঝে মাঝে গরম পড়ের মতো ব্যাপার আর কি। তা ভালো, তবে কিনা ধারাবাহিক ভাবে লেখালেখির জগতে আছি প্রায় পঁচানব্বই সাল হইতে।আর শুরু? ওই কচি তারা কথা ফোটে নাই কাল হইতে।বাস্তবিকই।তাহাতে যাহা দেখিলাম তাহা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে বলিলে এই রকম।
কলম পিষিতেছি তো পিষিতেছি।সেই কিশোরীবেলা।জেলা শহরে বেশ নাম ডাক,আদর।কত্তো কত্তো কাগজে প্রকাশিত হইতেছে ওর কবিতা।মনে তখন দুঃখু সেই সিংহদুয়ার খোলে নাই।কিন্তু আমার চারপাশের মানুষজন, আমার কবিতার শিক্ষকেরা চিনাইয়াছেন ভালো কাগজ কাহাকে বলে।সত্যিকারের কবিতাপত্র ঠিক কেমন। তেমই একদিন এক বিরাট হল ঘরে শোরগোল, কি না একজন ওই ওই সেইখানে লিখিয়া ফেলিয়াছে।এবং সেই খবর আমাকে খুব উচ্ছ্বসিত ভাবে দিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে শিখাইয়াছিলেন অল্পপত্রের ভূমিকা কি! সেইদিন বুঝিলাম। কি বুঝিলাম? বুঝিলাম দুঃখ পাওয়া কাহাকে বলে।হ্যাঁ তারপর বহুবার আমি সেইসব জায়গায় লিখিয়াছি বটে।
তখন আমি আরও অনেক লিখিতেছি।ওই মেজ,সেজ।আমার এক লেখক বন্ধু,যিনি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে যুক্তও বটে,আমাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেন অমুক কাগজের লেখক। তার এই উল্লেখের মধ্যে দিয়া আমি টের পাইতাম,কি জানি কী টের পাইতাম।আসলে তিনি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।ভালো বন্ধুর অমন সূক্ষ্ম কথা মনে রাখিতে নাই।
আরও একটু আগাইয়া যাই। একবার এক পত্রিকা অফিসে গিয়াছি।তখন আমি ওই অলরেডি অনেক ডানাওয়ালা কাগজে লিখিয়া ফেলিয়াছি।এমনকি তাহাদের কাগজেও। তথাপি বেশ জড়োসড় আর সংকুচিত। সম্পাদকের টেবিলে গিয়া রাখিলাম বহু পুরনো এবং ঠিক যেন স্বল্প পত্রও নয় এমন একটি পুজোসংখ্যা। বলিলাম দেখিবেন যদি সময় পান পড়িবেন, এখানে আমার একটি উপন্যাস আছে।তিনি এমন অবজ্ঞা ভরে সেই পত্রিকা খানিক নাড়াইয়া সরাইয়া রাখিলেন যে অস্ফুটে যেন বলিয়াই ফেলিলেন এটা কী এবং কেন! সত্যিই সেইসব পত্রিকার ছাপা টাপা এমনই অস্পষ্ট এবং বড় পত্রিকার কাছে এমনই মলিন যে যেন নিজেকে বুঝাইলাম,ধ্যাৎ কী দরকার ছিল এই ভারী বইটা টানিয়া আনিবার।
আর আস্ফালন? বাব্বা যা দেখিয়াছি! কেউ কেউ তো চিনিতেই পারিতেন না প্রায়। তবে হ্যাঁ তা মুষ্টিমেয়।এসবের বাইরে ব্যতিক্রমী মানুষজনে ভরে ছিলেন এবং আছেন চারপাশ।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো হ্যাঁ সেইসব জা’গাতেও আছেন। যাহারা মনে করেন লেখার একমাত্র পরিচয় লেখা।সেখানে লেখকও বুঝি কিছুটা গৌণ হইয়া যান।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]