ঘোমটা
“এবার অবগুণ্ঠন খোলো
গহন মেঘমায়ায় বিজন বনছায়ায়”
কপালে টিপ , শান্ত, আয়ত চোখ আর মাথায় ঘোমটা — বাঙালী বধূর এই মডেলটি আমপাবলিক আজও বেশ পছন্দ করে । মাথায় ঘোমটা নেই, মুক্তবেণী পিঠের পরে লুটিয়ে চলা চলবেনা।
আমার ছোটবেলায় মনে আছে সাবেকি ধ্যানধারণার প্রচলন আমাদের বাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। বাড়ির পরিবেশ দেখলে মনে হতো তখনকার দিনে বোধহয় ঘোমটা আর আভিজাত্য সমার্থক ছিল । আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতির বাতাবরণে কিছু কিছু কবিতার বা নাটকের ( তখন ‘থিয়েটার’ বলতো) বা গানবাজনার আলোচনাও কানে আসতো । তবে স্কুল কলেজের লেখাপড়ার চর্চাটা আজকের মতো ভয়ঙ্কর গুরুত্ব পেতো বলে মনে হয়না ।তাই আমাদের প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষ পরীক্ষা-টরীক্ষাগুলোতে আটকে না গেলেও, ফাউল না করে মোটামুটিভাবে টপকে যেতো । তখন হয়তো সেটাই জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ মনে হতো । তখন জীবনের গতি আজকের মতো এতো দ্রুত এবং জীবনযাপনটাও এতো বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবশ্যই ছিলোনা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে কিন্তু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় রিতিমত ভালো রেজাল্ট করাটাই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিয়ের অনেক বছর পরেও আমার ভাইঝি শিপ্রা নতুন করে শিক্ষাজগতে দাপটের সঙ্গে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবার মতো বিরল কৃতিত্বও দেখিয়েছিল।
আগের জমানায় মেয়ের বিয়েকে ‘কন্যাদায়’ ভাবার রেওয়াজ ছিল, যেটা এখনও কিছুটা আছে । যেন এই দায়টা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই তার বাবা-মা মহাপ্রস্থানের মেন রোডে গিয়ে স্বর্গে যাবার বাসের টিকিট কেটে ফেলবে । তাই কন্যা একটু বড়ো হলেই তাকে ভাবি পাত্রপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে ফাইভ-জি স্পিডে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করা শুরু হতো।
সেই ফরম্যাটে আমাদের মেজদি অর্থাৎ নমিতাকে গান শেখানো চলতো মনে আছে। পাড়ায় একজন সঙ্গীতশিক্ষক ছিলেন হরিহর রায় ওরফে হরুবাবু যিনি প্রায় প্রতিদিনই ঘন্টাখানেক মেজদিকে নিয়ে বসতেন । সঠিক সুরটা বোধহয় ছাত্রীর রপ্ত হচ্ছিলনা তাই একটিমাত্র গানের তালিম রোজ শুনতে শুনতে আমার নিজেরও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল । গানটা ছিল – ” দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে / আমার বাটে বটের ছায়ায় সারা বেলা গেল খেলে ” ইত্যাদি । নিজে গাইবার সময় ‘ দূর ‘ ‘রাখাল’ শব্দগুলো উচ্চারণের সঙ্গে তাল বোঝাবার জন্যে হরুবাবু নিজের হাঁটুতে সশব্দে নিষ্ঠুর চাঁটি মারতেন । কিছুদিন সেই গানের তালিম চলতে চলতে হঠাৎ জানতে পারলেন মেজদির বিয়ের কথা চলছে । সঙ্গে সঙ্গে দূরদেশী বেচারা রাখাল ছেলেটিকে বাঁশী হাতে বটের ছায়ায় বসিয়ে রেখে দিয়ে হরুবাবু মেজদিকে শেখাতে শুরু করলেন – ” এবার অবগুণ্ঠন খোলো ” গানটি । জানিনা কন্যার আসন্ন বিবাহ অনুসঙ্গে এই বিশেষ গানটির তাৎপর্য কতখানি ছিল । অবশ্যই নববধূর ফুলশয্যার রাতের ভাবনা নিয়ে অনেক রোমান্টিক কবিতা বা গান সৃষ্টি হয়েছে । “কভী কভী ” সিনেমায় শাহির লুধিয়ানভির কথায় , বিখ্যাত সুরকার খ্যায়ামের সুরে মুকেশের কণ্ঠে ” সুহাগ রাত হ্যায় , ঘুঙ্ঘট্ উঠা রহা হুঁ ম্যাঁয় ” অসাধারণ এই গানটি কি ভোলা যায় !
” এবার অবগুণ্ঠন খোলো ” কিছুদিন ধরে প্র্যাকটিস চলছিলো , তখন হরুবাবুকে বলা হলো দিন দশেক পরে মেয়ে দেখতে আসবে তদানীন্তন সি.পি অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রভিন্স, বর্তমানে ছত্রিশগড়ের অন্তর্গত রায়পুরের এক প্রবাসী বাঙ্গালীপরিবার । পরদিন থেকে হরুবাবু মেজদিকে একটাই হিন্দী ভজন শেখাতে শুরু করলেন । যথাসময়ে ভাবি পাত্র ও পাত্রপক্ষের কয়েকজন মেজদিকে দেখতে এলেন । সুন্দরী ও উজ্জ্বল গৌরবর্ণা মেয়েকে দেখে সকলের খুব পছন্দ হয়ে গেলো । গানের কথা উঠলো । তাদের অনুরোধে মেজদি প্রথমে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও পরে ছত্রীশগড় নিবাসী চোস্ত হিন্দীতে অনর্গল কথা বলতে অভ্যস্ত মানুষদের সামনে সাহসে ভর করে সদ্যশেখা একটিমাত্র হিন্দী ভজনটিও গেয়ে দিয়েছিল । এই ঘটনার বহুবছর পরে মেজদির স্বামী অর্থাৎ আমাদের সবার প্রিয় রাজাদা বলেছিলেন যে সেদিন তোমার মেজদি দ্বিতীয় গানটা কোন ভাষায় গেয়েছিলেন আমরা কেউ বুঝতে পারিনি ।
সেই প্রজন্মের মহিলারা ঘোমটা ছাড়া হয়তো চলাফেরাই করতেন না, এমনকি নিজের স্বামীর সঙ্গেও কথা বলতেন মাথায় ঘোমটা দিয়ে । আমার মাকেও দেখেছি ঘরে বা বাইরে সবার সামনেই ঘোমটা দিয়ে থাকতেন । বাবার এক দূরসম্পর্কের দাদা ছিলেন যিনি মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতেন । একটু গম্ভীর প্রকৃতির , রাশভারী এবং কিছুটা রক্ষনশীল ছিলেন । তখনকার দিনে ভাসুর সম্পর্কের কারো সঙ্গে বাড়ির মহিলারা সরাসরি কথা বলতেন না । সেই জ্যাঠামশাই এলে তিনি আমার মাধ্যমে মায়ের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতেন । মা নিজেও আমার সাহায্যে ভাববাচ্যে উত্তর দিতেন । অবশ্যই সেইসময় ঘোমটা থাকতো ঠিকঠাক ও আঁটসাঁট ।এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে। বেশ কয়েকবছর পর একদিন কলকাতায় আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আমি আর মা গিয়েছি । বিকেলে কোনো এক সময় তাদের বাড়ির টেলিফোনে রিং হতেই কাছাকাছি থাকার জন্যে আমিই রিসিভারটা তুললাম । ওপারে আমাদের সেই জ্যাঠামশাই । গম্ভীর গলায় বললেন – “তোর মাকে ফোনটা একটু ধরতে বলতো, একটা খুব দরকারী কথা তাকেই সরাসরি বলবো” । আমি একথা মাকে বলতেই মা প্রথমেই তাঁর অগোছালো ঘোমটা ঠিকঠাক করে নিয়ে ফোন ধরলেন । এরপর যতক্ষণ কথা চললো, একহাতে ফোন আর অন্যহাতে নিজের ঘোমটা টানটান করে ধরে ছিলেন যাতে কোনোরকম অসাবধানতাবশত ঘোমটা স্থানচ্যুত না হয়।
[পরম্পরা ওয়েবজিন, ডিসেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]
দারুন সুন্দর লেখা! রাজা দা হিন্দি ভজন শুনে বুঝতে পারেনি, কি ভাষায় দিদি গান গাইলো! অনেক দিন মনে থাকবে!