লোকগান
সেই বাল্যবেলা থেকেই শুনে আসছি লোকগান। মাটিমাখা শিকড়সন্ধানী গান। মেঠোগান আরকী। অধিক সংখ্যক মানুষের গান। যেখানে স্বরলিপি বা গানের ব্যাকরণ খুব একটা প্রশ্রয় পায়না। সে গানগুলো অনেকটা নদীর জলস্রোতের আওয়াজের মত,পাখির কুহুতানের মত, ঝর্নার শব্দের মত। প্রকৃতির অভাবনীয় সুরে সেসব গানের স্বরগম বাঁধা।
বাউল,গান গাইতে গাইতে গ্রাম পরিক্রমায় চলে যাচ্ছে। একতারার বোল আর সুন্দর সুরের কাঁপনের গুঁড়ো ভেসে পড়ছে বাতাসে। যেন ”বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ /আমার বাড়িতে আসে/সই গো,বসন্ত বাতাসে।” “আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/আমার ঘরের কাছে এক পড়শি বসত করে।” আসলে এসব গানের যে সুর, তা মাটির থেকে উঠে আসা। এসব গান ধ্রুপদিয়ানায় বোনা নয়। এ গানের ঘরানা নেই, বাহিরানা আছে। মুক্ত বিহঙ্গের মত আছে অনন্ত আকাশ। তাই উঠনের দাওয়া থেকে নদীর কূল পর্যন্ত ভেসে যেতে লোকগানের কোনো অসুবিধাই হয় না।
“কোন মিস্তরি নাও বানাইছে/কেমন দেখা যায় /…
চন্দ্রসূর্য বাঁধা আছে নাওয়েরই আগায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়”।
জারিগান, সারিগান, ছাদপেটানোর গান, বিহু, গম্ভীরাগান, মাহুতবন্ধু, মনসাগান, গাজনগান,ভাদুগান, টুসুগান, ভাটিয়ালি, বাঁধনা, করমগান, বাউলগান, ফকিরিগান, বিয়েরগান হরকিসিমের লোকগান রয়েছে বৃহত্তর বাংলা জুড়েই। সবখানেই রয়েছে মাটির গন্ধ। সুতরাং মাটির স্বাদ পেতে, শিকড়ের সঙ্গে সংযুক্ত হতে লোকগানের কাছে হাঁটুমুড়ে বসতেই হবে।
রবীন্দ্রনাথ থেকে এ আর রহমান প্রত্যেকেই লোকগানের কাছে,বিশেষভাবে বাউল গানের কাছে ঋণী। “গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ”, বাউল সুরের আবিরেই রাঙানো।
সকালে গৃহস্থের বাড়িতে পট দেখাতে আসা পটুয়া মানুষটিও কী কম দিয়েছে? বাংলার লোকগানের ভাণ্ডার পূর্ণ করেছে সেও।” যা খাবেন যা বিলাবেন সেই তো ভবে সার/যমরাজ করিছেন সকল বিচার।” এমন লোকশিক্ষকও আজ পিছিয়ে পড়েছে অনেক দূর!
“ভাদু করি গো মানা/ সিউড়িতে সিনেমা দেখতে /একা যেও না।”
সেই আদি অকৃত্রিম মেঠোসুরের ভাদু গান,টুসু গানের শিল্পীরা কিন্তু আবার তাদের শিকড়ে ফিরতে চলেছে।তারা আসছে।কিছু শিল্পী হিন্দি গানের নকল করে ভাদু টুসু গাইলেও,তাঁদের অনেকেই আজ বুঝতে পেরেছে “ওরা আমাদের থেকে সুর নিলেও,আমরা ওদের থেকে নেব না”। এটাই তো দরকার। ধ্রুপদি গান চিরদিন লোকগানের কাছে ঋণী,তবু এখনও দেউলিয়া হয়ে যায় নি বাংলার লোকগান।
মনসা ভাসান,সিনান,জাগরণে কত কত গান যে শুনেছি!
এখন তা কমলেও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু।”একটো ফুলের লেগে করো অভিমান/দুয়্যারে লাগিঙে দুবো ফুলেরই বাগান।”অথবা গাজন গানের সেই প্রাণ উদাস করা শিকড়ের টান-“বারোহাত কাঁকুড়ের তেরোহাত বিচি/সাজতে কুজতে সাঁঝ হলে বাঁচি”।
কেন?সন্ধ্যা হলে শিবের ঘরে আসবে সবাই, সব ভক্তদের কাছে সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে দাঁড়াবে।যেন সবাই সবার আত্মজন।এও তো মিলনেরই এক বার্তা,লোকগীতির যা মূল উপপাদ্য বিষয়।
সমস্ত লোকগানই মিলনের কথা বলে,মাটির অমলিন স্বাদে আমোদিত থাকে তার স্বর আর সুরের বাঁধনের মধ্যে না গিয়ে মুক্তির আনন্দে নদীর মত অচেনা বাহিরানায় ছুটে যায়।
যদিও কোনো কোনো শিল্পী লোকগানকেও স্বরলিপিতে বাঁধতে চান,তবু এ তল্লাটে তত কড়াকড়ি নেই।রতন কাহারের “বড়ো লোকের বিটি লো/লম্বা লম্বা চুল”,আশানন্দনের “লো ননদি আর দু মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে /ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে “,কুমুদকিঙ্করের ” তু কেনে কাদা দিলি /সাদা কাপড়ে/ইখন আমার হবে কী/পাড়ার লোকে কবে কী/বিনা দোষে ফেললি ফাঁপড়ে”।
অনিল চক্রবর্তীর “ও কণ্ডাকটর বাবু/ ভাড়া পাবি পয়সা লিবি/ তু ক্যানে ঢুঁসাই দিলি বল “বা নারায়ণ কর্মকারের “গুজে দিয়ে পলাশকুড়ি/ আমার নোটন খোঁপাতে/বলেছিলি ভালোবাসি/দাঁড়িন পিয়েল তলাতে”।অথবা অরুণ চক্রবর্তীর -“হেতাক তোকে মানাইছে নাই রে/তু রাঙামাটির দেশে যা”,চুঁচুড়া স্টেশনে ওই পলাশ গাছটিতো বেমানই ছিল।কিন্তু এই গানটি বা “হৃদ মাঝারে রাখব/ছেড়ে দেব না/ছেড়ে দিলে সোনার গৌর/আর তো পাব না” এদের ব্যবহার কোথায় না হল!
সত্যিই কী এসব অন্তর থেকে,মাটি থেকে উঠে আসা সুর ও পংক্তিকে কোনো বাঁধন দিয়ে বাঁধা যায়?বোধহয় যায় না।
তবে লোকগান নিয়ে ব্যবসা তো বড়ো কম হচ্ছে না! পূর্ণ দাস বাউল,গোষ্ঠগোপাল, লোককন্যা স্বপ্না চক্রবর্তী যেমনটি বিখ্যাত করেছিলেন লোকগানকে,সেপথ পরিত্যাগ করে কর্পোরেট জগৎ অজস্র তারের বাদ্যযন্ত্র দিয়ে কোরাসে সেই সঙ্গীতটির সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছে অন্য শব্দমালা।তাতে অবশ্যই টিআরপি বাড়ছে কিন্তু যাঁরা মূলটাকে খুঁজবেন,তাঁরা দিশেহারা হবেনই। এই ‘বহুরূপী’তেই –“পিরিতি কাঁঠালের আঠা/লাগলে পড়ে ছাড়ে না”,নবনী গোপালের এই অপূর্ব বাউল গানটিতেই যোগ হয়ে গেল”জেনেশুনে করগা পিরিতি”। এমনতো হামেশাই হচ্ছে “বড়ো লোকের বিটি”কে নিয়ে কত কী হল,সবাই দেখলেন।অভিনেতা সাহেব গুণাগারও দিয়ে গেল।এসব চলছে,চলবে।
শ্রোতা দর্শক এই আধুনিকটাকেই এখন নিচ্ছে,নেবেও।তবু প্রশ্ন,লোকগানের কাছেই এমন ভিখিরির মত হাত পাতা কেন বাপু?তোমাদের ধ্রুপদিয়ানার আধুনিক গান কি ফুরিয়ে ফাঁকা হয়ে গেছে?
[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]