আজ কমরেডের মৃত্যুদিবস। জঙ্গলে আগুন লেগেছে। পলাশের বন। কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে পাশে। লালে লাল অথচ কোঁদল। বাদল দিনেও তারা আকাশের দিকে মুখ তুলে গায় মুক্তির গান। আজ কমরেডের মৃত্যুদিবস। জঙ্গলে আগুন লেগেছে।

রঞ্জন বলে একটা ছেলে ছিল। গালে সাদা দাড়ি। কাঁধে ঝোলা। সে শহরের পথে পাড়ি দিত জানুয়ারী মাসে। সময়টা যথোচিত। আগুনে রোদ। শীত শীত ঘন হয়ে বসার দিন। রঞ্জনের কেউ কেষ্টপুরে থাকত। আমরা ভিআইপি রোডে দাঁড়িয়ে চা খেতাম। গল্প হতো। সংক্ষিপ্ত। আমার বাস এসে গেলে যবনিকা পড়ে যেত। শেষ গল্পের। যার কভার করেছিল, মানে প্রচ্ছদ – অপরাহ্ন সেন। সে যা হোক, অনেকদিনের কথা। রুজি-রোজগারের জন্য সবাই ঘুরছে। নচিকেতা লোক লাগিয়ে দোকানে দোকানে খোঁজ নিচ্ছে। ক্যাসেট বিক্রি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ছে গাছে। রাস্তায় সিটি মেরে গাইছি, অন্তবিহীন পথ। অবলীলাক্রমে ঘন হচ্ছি বান্ধবীর সঙ্গে। যারপরনাই খিস্তি করছি কথায় কথায়। সেসময়ে রঞ্জন কবিতা লিখতো। ছাপাতো। কখনো কখনো অসুস্থ লোককে কোলে করে নিয়ে যেত হাসপাতাল।

সোমলতাও কবিতা লিখতো। সে রঞ্জনের বান্ধবী। কাঁধে ঝোলা। লম্বা বিনুনি। অসুস্থ অসুস্থ চাহনি। ভীষন রোগা ছিল সোমলতা। টিফিন পিরিয়ডে দু’জনে পোর্টিকোতে বসে প্রেম করতো। দূর থেকে আমি তারে দেখেছি। কাছে যেতাম না। সেটাই ছিল নিয়ম। অলিখিত। রঞ্জন মারা গেছে বছর কয়েক হল। রঞ্জনের মৃত্যুটা বেশ রহস্যময়। হাইওয়ের পাশে তার শরীরটা কাদা-মাটিতে লেপ্টে ছিল। স্কুটারটা পড়েছিল ফুট-চারেক দূরে। সেদিন ছিল ছাব্বিশে নভেম্বর। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমান সত্তর শতাংশ। রঞ্জন চলে গেল। তার পুঁজিতে তখন বড়জোর পাঁচটা একফর্মার কবিতার বই। শেষ বইয়ের নাম, কে বেশী সুখী। সত্যিই সেদিন কান্না পেয়েছিল। ঝকঝকে হিরের মতো কবিতার কাট্‌। সেখানে কোনো শর্টকাট ছিল না। কিন্তু, জীবনের শর্টকাটে রঞ্জন পড়ে গেল। সোমলতাকে তারপর বহুদিন দেখিনি। তারপর, একদিন তাকে আবিষ্কার করলাম কফি হাউসে। আমার পাশের টেবিলে। ছোট করে কাটা চুল, সালোয়ার কামিজ, চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা। সোমলতা। হাতে রঞ্জনের কবিতা সমগ্র।

সোমলতা আমাকে দেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি? আমি বললাম, কেন আসতে নেই?
সে বলল, না না, তা কেন? মানে, তুমি তো কফিহাউসে আসো না তাই জানতে চাইছিলাম।
তাকে বললাম, কেমন আছিস?
সে বলল, বিন্দাস।
‘বিন্দাস’ শব্দটা কিন্তু তখনো তথাকথিত বাঙালির মধ্যে সেরকম জনপ্রিয় হয় নি।
আমি হাসলাম। দেখলাম, তার অসুস্থ অসুস্থ চাহনিটা এক্কেবারে বদলে গেছে। কালো মোটা ফ্রেমের থেকে হালকা ফ্রেমেই তার মুখাবয়ব সুন্দর লাগছে।
আমি উঠতে উঠতে বললাম, দেখা হবে।
সে হেসে বলল, নিশ্চয়ই।

আমি বাড়ি ফিরতে ফিরতে রঞ্জনের কথা ভাবলাম। সাদা সাদা দাড়ি। কাঁধে শান্তিনিকেতনের ঝোলা। মুখে বিড়ি। হাতে ঝরঝরে লেখা।

‘অসুখ হলে বিছানায় শুয়ে গান গাও
অবাধ্যতার মধ্যে মোহ থাকে বা
তাকে জয় করার ইচ্ছে
চোঁয়া ঢেকুরের সঙ্গে অন্তর্বাসের
কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে
প্রাইমারিলি ভালো থাকাই যায়।
অপরাধ বলছে, সে অসুস্থ বিড়াল
বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতিই তার সম্বল
অথচ, উঠোনজুড়ে শৈশব দাপিয়ে বেড়ায়
কোলাহলই জীবন
ফিরে পাওয়ার তোড়জোড় –
এখনো একটু হলেও আছে।
হ্যালোজেন গলি থেকে অবাধ্য নিকোটিন
সাইকেলে পাড়ি দেয় উপত্যকার দিকে’।

সে নেই। ভাবতেই মন খারাপ হয়। রাতে এক পেগে হল না। বাড়িতে বললাম, আজ আর খাব না।
বিছানায় শুয়ে জেগে ছিলাম অনেকক্ষণ। গায়ে হাত পায়ে ব্যথা করছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাতে এসে দাঁড়াই। আমার বাড়ির নিচেই অটোস্ট্যান্ড। সেখানে এখনো ভীড়। লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি উদাসীন। দূরে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে একটা ট্রেন ডাউনের দিকে গেল। আমি উদাসীন। রঞ্জন বাংলা অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড পেতে পারত। কিন্তু পায় নি। কে পেল তাহলে? আরো একটা ট্রেন ডাউনের দিকে গেল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এটা কেন হল? কে এই সোমলতা? রঞ্জনের কথা ভাবতে গেলেই তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে কেন? আমি বাজারের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ লোডশেডিং হল। দূরে কারো গলার হার ছিনিয়ে কেউ পালিয়ে গেল। আমি ছাতেই বসে পড়লাম। এখন আর নিচে নামব না।

আজ আমার বাড়িতে কিছু লোক আসবে, বলেছে। তাই বাড়িতেই থাকব সারাদিন। আমার বউ অফিস যাবে। বাচ্ছারা স্কুল যাবে। যথাসময়ে কাজের লোক কাজ করে দিয়ে গেছে। আমি স্কচের গ্লাসগুলো শুকনো কাপড় দিয়ে ঘসে ঘসে ঝিলিক তুলছি। তারা যে কোনো মূহুর্তেই এসে যেতে পারে। দুপুর বারোটা বাজতেই স্নান করে নিয়েছি। বগলে ডিও লাগিয়ে একটা ফ্রেশ টি-শার্ট পরে বসে আছি। এসি চলছে। দরজায় বেল বাজল।
দরজা খুললাম, নিজের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা আছে কিনা দেখার প্রত্যাশী হলে বললাম, আয় রঞ্জন। সে সদাহাস্যমুখর। সে বলল, তোর জন্য পলাশ এনেছি। নিবি?
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আজ আমার মৃত্যুদিবস। তোর জন্য পলাশ এনেছি। নিবি না?
আমি চোখ সরিয়ে নিলাম, আয়, ঘরে আয়।
রঞ্জন আমার বসার ঘরে আসে। কাঁধের ঝোলা থেকে পলাশ বের করে আমার রাবারউডের টেবিলে রেখে বলে, আজ এক হাজার বছর নিয়ে এলাম। মৃত্যুর পর ঘন্টায় ঘন্টায় বছর, জানিস?
আমি আমতা আমতা করে বলি, তাই নাকি?
সে বলে, দেখবি?
আমি বসে বসে ঘামতে থাকি।
সে আবার বলে, দেখবি?
বাইরে জোরে জোরে কলিংবেল বেজে যাচ্ছে। আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দরজা খুলতে গিয়ে দেখি বসার ঘরে কেউ নেই। একটা শুঁয়োপোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে দিব্যি।

আজ কমরেডের মৃত্যুদিবস। জঙ্গলে আগুন লেগেছে। পলাশের বন। কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে পাশে। লালে লাল অথচ কোঁদল। বাদল দিনেও তারা আকাশের দিকে মুখ তুলে গায় মুক্তির গান। আজ কমরেডের মৃত্যুদিবস। জঙ্গলে আগুন লেগেছে। আমি আর সোমলতা একটা মোমবাতির সামনে বসেছি। আমাদের স্যুপ সার্ভ করা হয়েছে। সোমলতার আজ জন্মদিন। তাকে তানিশ্‌কের ডায়মন্ড রিং প্রেজেন্ট করলাম। সে খুশি। মহিলারা হিরে পছন্দ করে। আমাদের স্টার্টার আসছে। আমরা নিরামিশাষী। মাছ-মাংসে আমাদের আসক্তি নেই। সাদা ওয়াইনটা সত্যিই বেশ ভালো। এই সব সন্ধে অবিস্মরনীয় হয়ে থাকে।
তাকে বললাম, খুশি?
সে আদুরে গলায় বলল, হুঁ।
আমি বললাম, ফিরে যাবে?
সোমলতা বলল, নাহ্‌।
মনে হল, তাকে আদর করি। কালো শাড়িতে যে কোনো মেয়েকেই দুর্ধর্ষ লাগে। হিরেটা সত্যিই ভালো দিয়েছে। আমাদের ডিনার শেষের পথে।
তাকে বলি, লং ড্রাইভে যাবে?
সে মোলায়েম গলায় বলে, যেতে পারি।

সোমলতা আর রঞ্জনের ফটোগ্রাফের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দুজনেই আমার খুব কাছের লোক। আমাকে হয়তো কিছু বলতেও বলা হতে পারে। সোমলতা আর রঞ্জন হারিয়ে গেছে। একের পর এক। আর, তাদের ঝকঝকে প্রতিভা। আমি চেয়ারে বসে আছি। অনেক পলাশফুল আমার সামনে জড়ো করা হয়েছে। পলাশ আমার ভালো লাগে। পলাশ বোল্ড। সেদিন রঞ্জন আমাকে সে কথাই বলতে এসেছিল। সে আমার হাত ধরে বলেছিল, পারবি না?
আমি প্রথমে ‘হ্যাঁ’ বলিনি। কিছুদিন ভাবার সময় চেয়েছিলাম। ভাবলাম। রঞ্জন না সোমলতা – কে বেশি কাছের মানুষ। মনে পড়ে যায়, রঞ্জন বলেছিল, ‘অপরাধ বলছে, সে অসুস্থ বিড়াল’। ভোটটা রঞ্জনকেই দিলাম। সে আবার এল, এবার তাকে আশ্বস্ত করলাম। এটুকু তো করাই যায়। আমি জানি, পুলিশ আসবে। আসুক। ওদিকে মাইক টেস্টিং হচ্ছে। আমি উদ্যোক্তাদের বলি, একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমার কাজ আছে।
শিবাজী বলল, স্যার, এরা দুজনেই আপনার বন্ধু ছিলেন না? মনে মনে বললাম, হবেও বা।

অনুষ্ঠানের শেষপর্যন্ত থাকতে পারিনি। পুলিশ আসেনি। অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল। আমি সভা চলাকালীন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শান্তির ঘুম। সেটা না হয় একটু দীর্ঘই হোক।

[লেখকের অন্য রচনা]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জুন ২৪, সূচিপত্র]

3 2 ভোট
Article Rating
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Soumitra Chakraborty
Soumitra Chakraborty
10 months ago

অসাধারণ! তবে অগ্রসর পাঠকদের জন্য। আমজনতার খাদ্য নয়। খুব ভালো হয়েছে। আরও লিখিস এবং পড়াস। ভালো থাকিস।