লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি ভোর বেলায়। বাটন পুশ করেছি। নিচে থেকে লিফট ধীরে ধীরে উঠে আসছে এই সর্বোচ্চ ফ্লোরে। আমি নিচে নামবো। ভোরবেলা গঙ্গার ধারে একাকী ভ্রমণ। বিকেলের ভ্রমণ সঙ্গী ভোম্বল।
হঠাৎ আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। আমি নিমীলিত চোখে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলাম। আমি সেই অবস্থায় অনুভব করলাম লিফট আমার ফ্লোরে না থেমে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে। অবাক হবার অনুভূতি আমার নেই যেন। লিফট যে আরো ওপরে যেতে পারে না, তাও বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি নিচে নামবো, আবার বাটন পুশ করলাম। লিফট ওপরে উঠেই যাচ্ছে।
আমি মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে চোখ খোলবার চেষ্টা করলাম। তারপর অর্ধ নিমীলিত দৃষ্টিতে দেখলাম লিফট সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে অগুনতি মানুষ। সকলে যেন অবয়বহীন। কেবল মাত্র অস্পষ্ট মুখমণ্ডল। আরো লক্ষ্য করলাম সকলেই আমার পরিচিত এবং অতীত। ঐ তো ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে যে মুখমণ্ডল তিনি আমার পিতামহ। খুবই ছোটবেলায় তাঁকে হারিয়েছিলাম। তাঁকে চিনেছিলাম পারিবারিক এলবামে সাদা – কালো ফটো দেখে। লিফটের অভ্যন্তর থেকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।


পিতামহ ক্রমশঃ অদৃশ্য হলেন। স্পষ্ট হলো দিদিমার মুখ। আমার মনে পড়ে গেল গ্রীষ্মের স্কুল ছুটির দিনের কথা। সেই সময় প্রায় এক সপ্তাহ মামার বাড়িতেই কাটাতাম। দিদিমার সঙ্গে গঙ্গা স্নান করতে যেতাম। ফিরে এসে ঠাকুর ঘরে অনেকক্ষণ দিদিমা পুজো করতো। ধূপের গন্ধ, পাকা কলা, শশা আর গুড়ের বাতাসার ঘ্রাণ আমার চারপাশ ভরিয়ে দিল। দিদিমার মুখ ক্রমে মিলিয়ে গেল।
এই ভাবে একে একে আমার ছেড়ে যাওয়া প্রিয়জনদের উপস্থিতি আমি লিফটের মধ্যে আসা যাওয়া করতে দেখতে লাগলাম। আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে আছি।
দেখতে পেলাম আমার এক ছোট্ট বেলায় স্কুলের বন্ধুকে। এক সময় সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। একে অপরকে না হলে চলত না। লোকে আমাদের হরিহর আত্মা বলত। বছর খানেক আগে সেও চলে গেছে।
এইবার যার মুখটা স্পষ্ট হয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলো তাকে দেখে আমার চোখ ভিজে উঠলো। সে ছিল আমার পরম প্রিয়, বড়ো আদরের ভাগনা। সেই ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে বড় হয়ে উঠছিল। পড়াশোনায় খুব ভালো ছাত্র ছিল। মাত্র একুশটা বসন্ত পার করে সে আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছে অনন্তলোকে।
আমি কিছুক্ষণ মুহ্যমান হয়ে থাকি। কিছুক্ষণ পর আবার লিফটের ভিতর গতাসু প্রিয়জনদের অপসৃয়মান মুখগুলি দেখতে থাকি। হঠাৎ, এ কি! ভোম্বলের মুখ কেন ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে? আমার শরীর কাঁপতে থাকে থরথরিয়ে। ও যে আমার বৈকালিক ভ্রমণের পার্টনার! কাল বিকেলেও গঙ্গার ধারে বেড়ালাম, আড্ডা মারতে মারতে চা পান করলাম! বিগত প্রাণ মানুষের ভিড়ে সদা প্রাণবন্ত ভোম্বল কেন উঁকি মারছে? তবে কী? আমি দেওয়াল ধরে বসে পড়লাম লিফটের গেটের সামনে। মোবাইল বেজে উঠতে, সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ভোম্বলের ফোন!
তারপর! ফোন ধরে বললাম, হ্যাঁ, বল।
ও প্রান্ত থেকে ভোম্বলের ছেলে বললো, কাকু …

সহযোগিতার হাত বাড়াতে ওপরের ছবিতে ক্লিক করুন

[পরম্পরা ওয়েবজিন, জানুয়ারি ২৫, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

5 1 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Angsuman Ghosh
Angsuman Ghosh
3 months ago

দারুণ

পল্লববরন পাল
পল্লববরন পাল
3 months ago

দারুণ গল্প।
❤️🙏🏼❤️