হলদিয়ার কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের গল্প

যা বলছিলাম আমি আর চান্দ্রেয়ী মেকানিক্সে ‘ডি’ পেয়েই লাফাতে লাফাতে সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম। শুধু এই ভেবেই তখন উত্তেজনা যে আমরা ‘কোর’ সাবজেক্ট পড়তে পারব।
স্যার’রা এসে ক্লাসে এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতেন যে কেন আমরা বায়োটেকনলজি পড়তে এসেছি। বেশিরভাগ সবাই বলতাম ডাক্তারিতে চান্স না পাওয়ার জন্য। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে ডিপার্টমেন্টের ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হল। আমাদের সঙ্গে প্রত্যেকেরই সখ্য ছিল। আমরা একটা থ্রি সিটার ঘরে থাকতাম সেকেন্ড ইয়ারে ক্যাম্পাসের কাছেই একটা হোস্টেলে। একতলায় ঘর। আমি, চান্দ্রেয়ী এবং অনিন্দিতা। অনিন্দিতা ইনফরমেশান টেকনোলজির ছাত্রী ছিল। সেকেন্ড ইয়ারটা আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আমরা তিনজনেই মোটামুটি জানতাম আমাদের তিনজনের মধ্যে অনিন্দিতাই প্রথম চাকরি পাবে। এবং ট্রীট হিসেবে আমাদের মদ্যপান করাবে। এই ধারণা লালন করে আমরা ছিলাম বছর দেড়েক। থার্ড ইয়ারেই অনিন্দিতা চাকরি পায় এবং আমাদের অলিখিত শর্ত পূরণ করে।
আমাদের এই কাঠের দেওয়ালের একতলার ঘরে মারাত্মক ইঁদুরের উপদ্রব ছিল। তারপর আমরা বিষ দিয়েছিলাম। দু’একটা মরেও ছিল। তারপর আর আসে নি। তখনই প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে ইঁদুরের গায়ে আতপ চালের গন্ধ থাকে এবং প্রাণীদের মধ্যে ‘অ্যালার্ম কল’ হয়।

এই ঘরেই আমাদের জীবনের প্রথম একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়। প্রথম “দুই এক্স’ সিনেমা দেখা। তাও অত্যন্ত ভদ্র প্রজাতির সিনেমা ছিল। আমাদের রীতি ছিল শেষ সেমেস্টার পরীক্ষার দিন সারা রাত জেগে সিনেমা দেখে ভোরের হলদিয়া লোকালে বাড়ি ফেরা৷ তা আমরা জেনে এলাম ‘বেয়ার উইটনেস’ বলে একটি সিনেমা বেশ ভালো ‘কাটছে’ বাজারে। অবশ্যই বয়েজ হোস্টেল মারফত খবর। তা সিডি ভাড়া করার দোকানে গিয়ে নাম বলতেই বেরিয়ে এল সিডি। আমরা রাতভর জীবনে প্রথমবার সেই টাইটানিকের ঢাকাঢাকি দৃশ্যের অভিজ্ঞতার পর প্রাপ্তবয়স্ক অভিজ্ঞতার ভাগীদার হলাম। পরে হাজার খুঁজেও এই সিনেমাটি আর পাই নি।

আমাদের ক্লাসে অনেক ছেলেরাই আমাদের সঙ্গে খুব সহজভাবেই মিশত। প্রদীপ্ত, অরিজিতের কথা তো আগেই বলেছি। সন্দীপ ভদ্র, শঙ্খজিৎ অধিকারী, অতনু সাহা, কোহিনুর বিশ্বাস, সোহম নাগ এবং অবশই বব্রুবাহন রায়। বব্রুবাহন ( আমরা ছোট করে ‘বব্রু’ বলেই ডাকতাম) আমাদের সঙ্গে সেকেন্ড ইয়ারে বেশি কথা বলত না। বেশ একটু উন্নাসিকই ছিল। কিন্তু মারাত্মক পড়ত। তবে থার্ড ইয়ারে গেট ক্র‍্যাক করার পর আর খুব একটা পড়াশুনো করত না। একবার আমাদের HOD র ঘরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘ I am the king of Immunology। খুব রাগ হয়েছিল তখন। ইমিউনোলজির Kuby ‘র বই ওর গুলে খাওয়া শুনেছিলাম। থার্ড ইয়ার থেকে অবশ্য আমাদের সঙ্গে ভালোই কথা বলত।


আমাদের হলদিয়ার হোস্টেল জীবনের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন নন্দন স্যার। নন্দন ভট্টাচার্য৷ আমাদের HOD. এছাড়া অরুণকুমার মাইতি বা একেএম স্যারও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। নন্দন স্যার আমাদের Recombinant DNA Technology পড়াতেন। নিজের এসি ঘরে মাটিতে বসিয়ে প্রোজেক্টরর ক্লাস নিতেন। স্মরণীয় সময় কাটত। স্যার এমনি নির্বিবাদী ছিলেন, কিন্তু রেগে গেলে মারাত্মক রূপ ধারণ করতেন। একবার মহালয়ায় আমরা বাড়ি চলে এসেছিলাম বলে এত রেগে গিয়েছিলেন যে সবাইকে।বাড়িতে ফোন করে করে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমার ফোনটি আমিই ধরেছিলাম। এক বাক্যে সবাইকে টেনে এনেছিলেন হস্টেলে। জবর এক প্রস্থ উত্তম-মধ্যম খেয়ে চলে এসেছিলাম বাড়ি।
আমাদের হস্টেলে ইনস্টলমেন্টে রঙ খেলা হত। যদি কেউ দোলের সময়ে বাড়িতে থাকত, তাহলে সে যখন ফিরত তখন রং খেলা হত। এখনেই জেনেছিলাম বোরোলীন মাখলে রং হাল্কা হয়ে যায়৷
এরপর প্রায় ফাইনাল ইয়ারের কাছে আমরা ক্যাম্পাসের ভিতর এলাম। এখানে আবার সামনে একটা ছোট লন ছিল, রাতে সেখানে আড্ডা বসত। তাই রাতের পর রাত জেগেই কাটত। ডিপার্টমেন্টে কোনও সেমিনার থাকলে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ক্লাসে থাকতাম। নন্দন স্যার হাসিমুখে আমাদের এসকর্ট করতেন।
সেকেন্ড ইয়ারে সিনিয়রদের সঙ্গে থাকতে আসার সময়ে আমাদের কলেজে এবং হস্টেলে র‍্যাগিং হয়েছিল। কিন্তু কখনও তা মাত্রা ছাড়ায় নি। পরে সিনিয়রদের সঙ্গে খুব ভালো সখ্য হয়েছিল।
হলদিয়ার এই চার বছর আমাদের সবার জীবনের সবচেয়ে বর্ণময় ছিল। পরের পর্বে কলেজের আরও কিছু ঘটনা দিয়ে সমাপ্তি।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, অক্টোবর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

4.5 2 ভোট
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Mala Bagchi
Mala Bagchi
2 days ago

Khub bhalo laagche porte. Porer episoder jonno wait kore thaklam . All the best.