পর্ব ৫

ঢাকা বাতিঘরে লেখক

কলম-বাসি কথায় কলম নিয়ে বসেছি যে দেশের কথা বলতে, তাকে ছাপিয়ে মনের সবটুকু জমি জুড়ে আজ অন্য এক দেশের কথার চাষবাস। বাংলাদেশের মুখ, যা আজ নানা অচেনা রঙের রোদ আর ছায়ায় ঢেকে নানা অজানা চেহারায় চোখের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তাতে এতটাই বিভ্রান্তি যে কোন বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিলে আজকের বিবেচনা সাত দিন পরে নিজেকেই লজ্জায় ফেলবে না, তার তল পাচ্ছি না। দোদুল্যমান পেন্ডুলামের দুই প্রান্তে দুই বিপ্রতীপ ছবি প্রতিমুহূর্তে একে অপরকে ব্যঙ্গ করছে। তার একদিকে ছাত্রদের আত্মবলিদান, এক স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের যৌক্তিকতা যেমন সমর্থনের সঙ্গত দাবিদার, তেমনি অন্যদিকে বিদ্রোহ পরবর্তী সন্ত্রাস, বাংলাদেশের জনক বা রবীন্দ্রনাথের প্রতি তুমুল অপমান, মৌলবাদের ছায়া, সীমান্তে হিন্দু শরণার্থীর বিপুল সমাবেশ, সর্বোপরি দাঁত নখ বের করে প্রকাশ হওয়া এক সীমাহীন ভারতবিদ্বেষ বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্রসাধিত ত্বকের প্রতারক আচ্ছাদনের নিচে জমাট রক্ত লুকিয়ে রাখা ছিল অনেকদিন।


তবে এও কি সত্যি নয় যে সেই বিভেদের বয়স তো একশোও হলনা। তার আগের কয়েক হাজার বছর জুড়ে যে এক হয়ে থাকা, তার সিলমোহরছাপ কি পড়েনি তার অধিবাসীদের জিনে? যাপনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা জীবনের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশে কি রোপণ করেনি একই নীল আকাশ, সোনালি রোদ আর কৃষ্ণ মেঘবেলা? দু’বছর আগে জামদানি শাড়িবোনার হাল হক্কিকতের খোঁজে রূপগঞ্জের এক সাধারণ তাঁতি পরিবারে গিয়ে তো সেই আত্মীয়তার সুঘ্রাণের স্মৃতি নিয়েই ফিরেছিলাম।
মনে পড়ছে, নভেম্বরের শেষে যখন গিয়েছিলাম শীতলক্ষ্যার পাড়ের সেই গ্রামে, তখন নদীছোঁয়া জলজ বাতাসে শীতের আমেজ। পৌষের সূর্য তাপ হারিয়েছে অনেকটা। শহুরেপনার মেদবর্জিত নিবাসে বাহুল্যবর্জিত গার্হ্যস্থ। ঢোকার মুখে তাঁতঘর, ওরা বলে কারখানা। তার পেছনে মস্ত মাটির উঠোন পেরিয়ে বাসাবাড়ি। এক পংক্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটি ঘরের সামনে টিনের চালের লম্বা বারান্দা। বাঁদিকের ঘরটি মেহমানের খিদমত করার ঘর। ঘরের মাঝখানটিতে পরিপাটি সাজানো নিচু টেবিলের পাশে দুটি চকচকে নতুন স্টিলের চেয়ার পেতে রাখা। চিকনের কাজের টেবিলঢাকা। কাচের বাসন সাজিয়ে রাখা তার ওপর। সেখানেই অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা করেছেন সেলিমের মা আর বৌ।


হাত ধুয়ে বসলাম চেয়ারে। তার আধঘন্টা পরে খাওয়া সেরে দ্বিতীয়বার হাত ধোয়ার ফাঁকে বন্যার স্রোতের মত এসেছিল নয় নয় করে পঁচিশটা পদ। মাছ চাররকমের, মাংসের পদ তিনরকম। এর বাইরে ভাত, পোলাও, রকমারি তরকারি, ডাল, চাটনি, মিস্টি, ফল ইত্যাদি একের পর এক আসছে, আর তার ফাঁকে ফাঁকে আসছে নানা কথা আর গল্প।

খাবারের অংশ, বাঁয়ে ওপরে হাঁসের মাংস

গৃহকর্তা মারা গেছেন স্ট্রোক হয়ে দুবছর আগে। এখন দুই ভাই ঘরের সঙ্গে বার সামলায়। বার বলতে বংশগত জামদানি তৈরির কারখানা চালানো। বড়জন বিবাহিত। আজ সকাল থেকে এই সব কটি পদ রেঁধেছেন এদের বয়স্কা মা আর ওই বড় ছেলের বৌ। ছোট ছেলে সবে গ্র্যাজুয়েট হয়ে পারিবারিক ব্যবসা দেখার কাজ শুরু করেছে। নামটি মনে রাখার মত। ‘সজীব’। যেন নীরেনবাবুর রোদ্দুরের আলো। বলল
‘-হাঁসের মাংসটি খেয়ে দ্যাখেন। গুগলি খাওয়া হাঁস না, কাল বারো মাইল দূরে বোনের বাড়ির থিকা এই ধান খাওয়া হাঁস আনসি। খুব লরম’।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি
‘-বারো মাইল? গেলে কিসে?’
‘-কেন? সাইকেলে!’
আমাদের বিস্ময় বাঁধ মানে না। বলি,
‘-সাইকেলে? বারো বারো চব্বিশ মাইল? একটা হাঁসের জন্য?’
শুনে মুখে আলো জ্বলে উঠছিল সজীবের। এক মুখ হেসে বলেছিল-
‘-আর আপনেরা যে কত্তো মাইল দূর ইন্ডিয়া থিকা আমাগো বাড়ি আইলেন?

বুকের মধ্যে শীতলক্ষ্যা ঢেউ তুলেছিল সেদিন।

বাঁয়ে সজীব

বিপরীত চিত্রের অভিজ্ঞতা হয়েছিল কিন্তু আগেই। আর বিস্ময়করভাবে, সেটা আমেরিকার বুকে।

ইউনিভার্সিটি

যে ইউনিভার্সিটিতে আমার মেয়ের পড়াশোনা করতে আসা, সেখানে তার ডিপার্টমেন্টে বেশ ক’জন বাঙালি। সদ্য ছেড়ে যাওয়া বিভাগীয় প্রধানও ছিলেন বাঙালি। নতুন ছেলেমেয়ে গেলে পুরনো ছেলেমেয়েরা তাদের নানাভাবে সাহায্য করে। সাহায্যের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পড়ে থাকার বাড়ি খুঁজে পেতে। পি এইচ ডি-র ছেলেমেয়েদের হোস্টেল নেই। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই দেখতে হয়। সীমিত খরচে ঠিকঠাক সঙ্গির সঙ্গে ভাগ করা অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান তারাই করে দেয়। একটা নতুন দেশের ভিন্ন ব্যবস্থার সঙ্গে করমর্দন করিয়ে দেবার দায়টাও তারাই নেয়।
সে সবই হল। নতুন আসা ছাত্রদের মধ্যে অন্তত জনা তিনেক বাঙালি। তবে সকলেই বাংলাদেশের মানুষ। ঢাকার বুয়েট-এর (BUET – Bangladesh University of Engineering & Technology) স্নাতক। এক সিনিয়র এবং এক পোস্ট-ডকের ছাত্র দম্পতি একই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাসিন্দা। তাদের একজনের বাড়িতে ঢাকা থেকে বয়ে আনা হারমোনিয়ামে নিয়মিত রবীন্দ্রনাথের বিচরণ। অগাস্টে যাওয়া থেকে ডিসেম্বর অব্দি দিনে আমেরিকা আর সন্ধ্যে থেকে রাতে বাংলার বুকেই বসবাস। আমাদেরও প্রথমবারের বিচ্ছিন্নতায় ম্রিয়মাণ দিনরাতে কিছু স্বস্তি, নিরুপায় প্রবাসে মেয়ে মনের আরাম তো কিছুটা হলেও পেয়েছে।

নতুন ছাত্রীদের মেলা

জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে পটপরিবর্তন। কোথায় যেন কিছুর আয়োজন চলছে, তার খবর কিছুটা যত্নেই যেন লুকনো থাকছে সান্ধ্য আড্ডায়। কখনো এই দুজন, কখনো অন্য দুজন অনুপস্থিত, যার কারণটা কেউ বলতে চাইছে না। এক একদিন আড্ডাই বাতিল।
শেষে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নেমন্তন্নের চিঠি মেয়ের হাতে। ভাষা দিবসের উদযাপনের অনুষ্ঠানে তার আমন্ত্রণ। তবে দর্শকের আসনে। বাংলাদেশের সমস্ত ছেলেমেয়েরা মঞ্চের কুশীলব। সান্ধ্য আড্ডার প্রত্যেকেই অংশী সেই অনুষ্ঠানে, আমার মেয়ে আর ক’জন এপার বাংলার ছেলেমেয়ে ছাড়া। সেদিন তাদের চোখের ভাষাতেও যেন অন্য বর্ণমালার ইঙ্গিত। প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে যা বলে দিচ্ছে, দু’দেশের মাটির ওপর শুধু নয়, তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ভূমির ওপরেও র‍্যাডক্লিফ রেখার অস্তিত্বটাই সত্যি। সীমান্তের কাঁটাতার সত্যি, সীমান্ত বিরোধও সত্যি। তাই দুরত্বটুকুও সত্যি।
প্রসঙ্গত, ভাগ করে থাকা অ্যাপার্টমেন্টেও আমাদের মেয়ের সঙ্গী হয়নি নতুন আসা বাংলাদেশি মেয়েদের কেউ। খানিকটা উদ্যোগী হয়েই এক পাঞ্জাবী মেয়ের সঙ্গে তার থাকার ব্যবস্থা দেখে দিয়েছিল সিনিয়র বাঙালি দাদা দিদিরা।
পরবর্তী নানা প্রসঙ্গে আমেরিকার বাংলাদেশি সমাজকে এই দূরত্ব সযত্নে রক্ষা করতে দেখেছি।

কিন্তু তাহলে সজীবদের বাড়ির ওই আতিথেয়তা কি অভিনয়?
না, মানুষ ব্যক্তিগত পরিসরে যা, অনেকক্ষেত্রেই সমষ্টিগত আচরণে তার থেকে আলাদা, কখনো বা সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বৈপরীত্যের আছন্নতায় আপনাকে আপন জায়গায় ধরে রাখার শক্তিই তার আসল শিক্ষা।
সেই পাঠ কমবেশি বাকি রয়ে গেছে আমাদের সকলেরই।

[পর্ব – ৪]

[পরম্পরা ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর ২৪, সূচিপত্র – এখানে ক্লিক করুন]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
Syamali Bhadra
Syamali Bhadra
1 month ago

খুব ভাল লাগছে পড়তে

BHASKAR DAS
BHASKAR DAS
21 days ago
Reply to  Syamali Bhadra

ধন্যবাদ আপনাকে