“আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়/ পারে লয়ে যাও আমায়”– এখনকার কর্মমুখর সদাব্যস্ত শ্রীরামপুর ফেরিঘাটের কোলাহলময় পরিবেশে বসে এই গানটি আর কেউ গাইবেনা। ‘পারে’ তো অবশ্যই যাবে, সে পারের নাম ব্যারাকপুর।

গরুড় পুরাণ বর্ণিত বৈতরণী নাইবা হলো, নদীতো বটে এবং যে সে নদী নয়, পবিত্র গঙ্গা । পেরোলেই অপরপারে ব্যারাকপুর — ক্যান্টনমেন্ট শহর। বর্তমানের রিতিমত ঝাঁ-চকচকে ও চারিদিকে বিজ্ঞাপন লাঞ্ছিত, দুদুটো আধুনিক জেটিযুক্ত ও প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কয়েকহাজার মানুষের কলকাকলি মুখরিত শ্রীরামপুরের পারঘাটটিতে দাঁড়িয়ে শেষ পারানীর কড়ি কন্ঠে নিয়ে এখন আর কেউ আর গেয়ে উঠবেনা ‘আমায় নিয়ে যাবি কেরে দিনশেষের শেষ খেয়ায়।’ কিন্তু একদিন সত্যিই তাই ছিল। সেকথায় পরে আসছি।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে লন্ডনের শুভদৃষ্টি হয়েছিলো গোধূলি লগ্নে। ঐ একই লগ্নে আজ থেকে প্রায় আশী বছর আগে আমার নিজেরও শুভদৃষ্টি হয়েছিলো শ্রীরামপুরের পারঘাটের সঙ্গে যখন আমার বয়স ছয়সাতের বেশি হবেনা।

এই পটভূমিকা জানাবার প্রয়োজনে আমাদের ফিরে যেতে হবে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে তার বছর দুয়েক পরের সময়টিতে। ভারতবর্ষের নাকের ডগায় তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জাপানী বোমারু বিমান। কলকাতায় এবং আশেপাশের অঞ্চলে আকাশ থেকে বোমা পড়ছে আর তার স্প্লিন্টার ছড়িয়ে পড়ছে মুড়িমুড়কির মতো। কলকাতার হাতিবাগান আর খিদিরপুরে বোমা পড়বার পর আতঙ্কে বহু মানুষ এইসব জায়গা ছেড়ে মরিয়া হয়ে দূরে দূরান্তে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করলো। আমার এখনও মনে আছে সেই সময় একটা ছড়া লোকের মুখেমুখে চলতো :
সা রে গা মা পা ধা নী
ব্যোম্ ফেলেছে জাপানি
বোমার ভেতর কেউটে সাপ
বৃটিশ বলে বাপরে বাপ।

শ্রীরামপুরে আমাদের তখন বৃহৎ পরিবার, সবাই ভীতসন্ত্রস্ত যদিও আমি তখন সেসব বুঝতে পারার বয়সে পৌঁছাইনি। কিন্তু এটুকু মনে করতে পারি যে আমাদের গোটা পরিবার ঐসময় একদিন শেয়ালদা স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে একেবারে পগারপার।চলে গিয়েছিলাম বহুদূরে অধুনা বাংলাদেশের রংপুর, যেখানে আমাদের পরিবারের খুব বড়ো একটা বাগান ও ফাঁকা জায়গা সমেত একটি বৃহৎ আকারের বাড়ি ছিল ।
তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় আমাদের সেই বাড়ির সামনে ‘একটু ফ্যান দাও’ বলে আর্তনাদ করা কঙ্কালসার মানুষের লাইন দেখেছি নিতান্ত শিশুবয়সেই কিন্তু সেই ক্লেশযন্ত্রনাময় ভূখামানুষের মিছিলের স্মৃতি এখনও ঘুমের মধ্যে আমাকে তাড়া করে। আমি ভুলতে পারিনি।

বুঝতে পারছি আমার বয়স বেশ অনেকটাই বেড়ে গেছে কারণ বয়স হলেই এইরকম সব বাতিক দেখা দেয়। আসল কথা ছেড়ে উল্টোপাল্টা ধানাইপানাই।শুরু করেছিলাম পবিত্র গঙ্গার কথা দিয়ে আর চলে এলাম মন্বন্তরে। কিসের থেকে কোথায়।

যাইহোক, ১৯৪৫ এ মিত্রশক্তির কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণ ও যুদ্ধ শেষ হবার পর
আমাদেরও শেষপর্যন্ত রংপুরে বছর তিনেকের প্রবাস তুলে দিয়ে ঘরে ফেরার পালা।
আবছা মনে পড়ে ফেরার সময় সন্ধ্যায় ব্যারাকপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম , বলা উচিৎ আমাকে ও আমাদের সব ভাইবোনেদের নামিয়ে নেওয়া হলো। তারপর সেখান থেকে সেখানকার গঙ্গার ঘাটে, যাকে বলা হয় ধোবিঘাট। এখন সেখানে বাঁশের ফ্রেমের ওপরে কাঠ পেতে চলার পথ, কিছুটা হেঁটে পৌঁছতে হয় অপেক্ষারত মোটর-চালিত নৌকার কাছে , লোকের মুখেমুখে ‘ভটভটি’। তার আগে চলতো লঞ্চ যেটা গঙ্গানদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ফলে ১৯৮৮ সালের পরে আর চালানো সম্ভব হয়নি । তারও আগে চলতো সাধারণ ডিঙি নৌকা। শুনেছি ক্যান্টনমেন্ট শহর হবার জন্যই নাকি ব্যারাকপুর প্রান্ত থেকে নদী পারাপারের খেয়া ঘাটে সিমেন্টের পাকাপোক্ত জেটি বানানো নিষিদ্ধ। বর্তমানে কাঠের পাটাতন-শোভিত যে অস্থায়ী চলার পথটি রিতিমত চালু রয়েছে , তখন নিশ্চয়ই সেসব কিছুই ছিলোনা কারণ আমরা সবাই তো সেই ভরসন্ধ্যায় বিস্তৃত কাদার পিচ্ছিল পথ ধরে সাবধানে হাঁটি হাঁটি পা পা করে নৌকায় উঠে দাঁড়বাহিত পালতোলা নৌকায় ছলাৎ ছলাৎ করে শ্রীরামপুরের দিকে যাত্রা করেছিলাম।
আবার সেই গঙ্গার ধারেই ফিরে এলাম ,আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা , নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে থাকা গঙ্গা ।
আহা, মন চল নিজ নিকেতনে…

শেষপর্যন্ত আমাদের নিয়ে নৌকা নিরাপদেই পৌঁছে গেল শ্রীরামপুর পারঘাট। তখন নিয়মকানুন মেনে সময় ধরে পারাপারের ব্যবস্থা তেমন কিছু ছিলনা। যাত্রীরা নিজেরাই অপেক্ষারত কোনো নৌকার মাঝির সঙ্গে কথাবার্তা বলে জলে ভেসে পড়তো। তবে ঘাট বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু একটা ছিলো তো বটেই। সেই ঘাট বহুকাল আগে কী ছিলো, কেমন ছিলো এসব জানতে গেলে একটু অতীত ইতিহাসের পাতায় উঁকি মেরে দেখতে হবে। চলে যেতে হবে পলাশীর যুদ্ধের দশবছর পরের সময়টাতে। তখন শ্রীরামপুরের, থুড়ি ফ্রেডরিকনগরের ঘাট সম্পর্কে শেষ গভর্ণর F.E.Elbeberling এর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে :
“There are 13 public and private ghats or landing places in the town, several of them very substantial. One of them, Joogul Addy’s Ghat, there is a building consisting of two rooms and a veranda erected by one Joogul Addy in the year 1767 for the benefit of the sick and the dying when carried to the riverside.

অর্থাৎ, ১৭৬৭ সালে কোনো এক যুগলকিশোর আঢ্য মহাশয় দুটি ঘর ও একটুকরো বারান্দাসমেত এইখানে একটি ঘাট নির্মাণ করেন কিন্তু নদী পারাপারের ব্যবস্থা করার জন্য আদৌ নয়। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ গঙ্গাপ্রাপ্তির আগে কয়েকটি দিন এই ঘরে থাকার জন্য আসতেন , অর্থাৎ যাকে বলে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। জীবন সায়াহ্নে যার মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া অন্য কিছু করার ছিলনা । মনের কোণে একটিই বাসনা – ‘হরি দিনতো গেলো সন্ধ্যা হলো, পার করো আমারে’। কিন্তু কে পার করে দেবে, তিনি কোথায়? তাঁর আসার জন্য ভবের ঘরে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানা আছে কি?

অনেকবছর পরে মালিক ঘাটটির মালিকানা ছেড়ে দেবার পর কালের গ্রাসে এই পরিত্যক্ত ঘাটটির জীর্ণদশা দেখে ১৮৪৪ সালে ফ্রেডরিকনগরের ( পরবর্তীকালে যার নাম হয় ‘শ্রীরামপুর’) তদানীন্তন ডেনিশ গভর্নর সম্পূর্ণ ঘাটটিকে খুব ভালো করে মেরামত করে দেন। কিন্তু লোকের মুখেমুখে এটি আজও ‘যুগল আড্ডির ঘাট’ নামেই পরিচিত।
কোনো এককালে গঙ্গাযাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট ঘর দুটির একটিতে বর্তমানে কালী আর অপরটিতে শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে আরও একটি ঘর তৈরি করে সেখানে জগন্নাথ দেবের স্থান করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন কতদিন আগে হয়েছে সেটা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারবেনা । তবে এইসব কর্মকান্ডের আর্থিক সহায়তা যারা করেছেন তাদের নামাঙ্কিত ফলক দেখে মনে হয় ষাট/সত্তর বছর কিংবা তার কিছুটা আগে হতে পারে। তবে ঘর ফাঁকা দেখে দেবদেবীরা অনুপ্রবেশ করেননি, তাদের আবাহন করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
এখন সেখানে তাঁদের আদরযত্নের অভাব নেই । পুরোহিত আছেন, রিতিমত নিত্যসেবা হয় এবং অনেক মানুষ ফেরিতে ব্যারাকপুর যাওয়ার পথে বা ফিরে এসে এইসব দেবদেবীর সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করেন , কেউকেউ পুজো দেন। পারঘাটে এদৃশ্য মাঝেমাঝেই দেখা যায়।
স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা ও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে যারা কর্মরত তাদের জন্য এই ফেরিঘাট দিয়ে যাওয়া-আসা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। যাত্রীদের সঙ্গে তাদের বাহন অর্থাৎ সাইকেল, স্কুটার,বাইক সেই ভটভটিতেই পারাপার করে।
বিগত দিনের লঞ্চ চলাচলের কথা আমার খুব মনে পড়ে। কত সহজেই চারপাঁচ মিনিটে
পৌঁছে যাওয়া যেত। আমরা বন্ধুরা মিলে কখনো কখনো পারঘাট থেকে লঞ্চে করে ব্যারাকপুরে গিয়ে শান্ত সুন্দর রিভারসাইড রোডে ঘুরে বেড়াতাম।
এখন আর সেইসব দিন ফিরে আসবেনা।
তখনকার দুকুলছাপা ভরাগঙ্গার চেহারা এখন শুধুই স্মৃতি, একটা নস্টালজিয়া। আজ সে বিগতযৌবনা , কোনোমতে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে বহমান আছে। তার সুদীর্ঘ যাত্রাপথে দুপারে অনেক জায়গায় ভয়াবহ ধ্বস নেমে সেখানকার মানুষদের উদ্বাস্তু করে দিচ্ছে। ভাঙতে ভাঙতে কোনো দূর ভবিষ্যতে তার নতুন পথের বিন্যাস হবে কিনা জানিনা। তবে তার বিস্তির্ণ দুপারে অনেক অসহায় মানুষের সুখদূঃখের কথা শুনতে শুনতে গঙ্গা বয়ে চলবে আর শ্রীরামপুরের পারঘাটে অর্থাৎ যুগল আড্ডির ঘাটে বর্তমানে মাথাপিছু সাতটাকা পারানির কড়ি দিয়ে সকাল সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ব্যারাকপুরে যাবার এই জলপথে মানুষের যাওয়াআসা চলতেই থাকবে ,চলতে হবেই। মনমাঝির হাতে বৈঠা তুলে দিয়ে ‘আমি আর বাইতে পারলামনা’ বলে কেউ হাল ছাড়তে পারবেনা।

[পরম্পরা ওয়েবজিন, ফেব্রুয়ারি ২৪, সূচিপত্র]

0 0 ভোট
Article Rating
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
পংক্তির ভেতর মন্তব্য
সব মন্তব্য
পার্থ সারথি বণিক
পার্থ সারথি বণিক
8 months ago

অনিলেশ বাবুর এই স্মৃতিচারণ – ইতিহাসের কয়েকটা পাতায় দ্রুত উঁকি দেওয়া – বেশ লাগল!

Swagata Bhattacharya
Swagata Bhattacharya
8 months ago

গঙ্গার ধারার মতই সুললিত,সাবলীল লেখা…….মন ছুঁয়ে গেলো।